কোন তিন রথে চেপে মাসির বাড়ি যাবেন জগন্নাথ?

১৪ দিন ধরে জড়িবুটি দিয়ে চিকিৎসা চলে তাঁর। তারপরে জ্বর থেকে উঠে রথে চেপে তিনি যাত্রা করেন মাসির বাড়ি। এই রথযাত্রা শুরু। কথিত, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম তিন বিগ্রহ রথে চেপে...

শাস্ত্রে রয়েছে, জগন্নাথ যখন রথে আসীন, সেসময় কোনও ভক্ত জগন্নাথ দর্শন করলে তাঁর আর পুনর্জন্ম হয় না। তিনি মুক্তিলাভ করেন। বৈষ্ণব ধারার এই উৎসব বাংলাতেও জনপ্রিয়, তবে পুরীর রথযাত্রা পৃথিবীবিখ্যাত। প্রচুর ভক্ত এইদিন ভিড় জমান পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে।

অন্যান্য পুজোর মতোই বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে রথযাত্রার। প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম পূর্ণিমাতেই জগন্নাথের স্নানযাত্রায় আয়োজন হয় মহাসমারোহে। মন্দিরের ভেতর থেকে বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় স্নানমণ্ডপে। তারপরে সুগন্ধি জলে স্নান করেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। যে কুয়োর জলে বিগ্রহ স্নান করানো হয়, তা বছরে খোলা হয় এই একটিবারই। জল বের করে আবার ঢেকে দেওয়া হয় কুয়োর মুখ। স্নানের সঙ্গে সঙ্গে সাজিয়ে তোলা হয় বিগ্রহকে। ১০৮ ঘড়া জলে স্নানের পর বিশ্রাম। এ সময় নাকি জগন্নাথের জ্বর ওঠে। তাই ঘরের ভেতরে রাখা হয় তাঁকে। ভক্তরাও তখন বিগ্রহের দেখা পান না। এই ক'টা দিন পুজোও বন্ধ থাকে তাঁর।

১৪ দিন ধরে জড়িবুটি দিয়ে চিকিৎসা চলে তাঁর। তারপরে জ্বর থেকে উঠে রথে চেপে তিনি যাত্রা করেন মাসির বাড়ি। এই রথযাত্রা শুরু। কথিত, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম তিন বিগ্রহ রথে চেপে যান মাসির বাড়ি অর্থাৎ গুণ্ডিচার মন্দির। সাতদিন সেখানে থেকে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসেন তাঁরা। একে বলে উল্টোরথ।

আরও পড়ুন: স্নানযাত্রা থেকে রথ, ১৫ দিন কেন বন্ধ থাকে জগন্নাথের গর্ভগৃহ? যে পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে

জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতি বছরই নিম কাঠ দিয়ে বানানো হয়। জগন্নাথের বিগ্রহের জন্য শ্যামবর্ণের, এবং বলরাম-সুভদ্রার জন্য হালকা বর্ণের নিমকাঠ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর পর, এই বিগ্রহের গায়ে ওঠে প্রায় ২০৮ কেজি সোনার গয়না। রথযাত্রায় তিনটে বিগ্রহের জন্য তৈরি হয় তিনটে আলাদা আলাদা রথ। এই রথগুলো তৈরির প্রক্রিয়াও আলাদা, রথগুলোর আকারও আলাদা। মূলত নিম কাঠ দিয়েই রথ তৈরি হয়। এই কাঠ জোগাড় করা শুরু হয় বসন্তপঞ্চমী থেকেই। পুরীর কাছেই দাশপাল্লা আর রানাপুর জঙ্গল। সেখান থেকেই গাছ কেটে আনা হয়। যা কাটা হয়, প্রতি বছর লাগানো হয় তার দ্বিগুণ পরিমাণ গাছ। যাই হোক, কাঠ কাটাকাটির কাজ শুরু হয় রামনবমী তিথি থেকে আর রথ তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়া তিথি থেকে। যদিও রথ নির্মাণে কোনওরকম ধাতুর ব্যবহার হয় না। রথের পেরেকও কাঠেরই পেরেক। আসুন এই তিনটি রথের সম্বন্ধে জেনে নিই আজ‌।

নন্দীঘোষ
জগন্নাথের ৪৫.৬ ফুট উঁচু রথের নাম নন্দীঘোষ। এতে ষোলোখানা চাকা থাকে। মোট ৮৩২টি কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় এই রথ, এর মাথায় পতপত করে উড়তে থাকে নিশান। সেই নিশানের নাম ত্রৈলোক্যমোহিনী। রথে জগন্নাথের সঙ্গী হন মদনমোহন। পঞ্চাশ গজ লম্বা এক একটি দড়ি বেঁধে টানা হয় রথগুলি। এর মধ্যে নন্দীঘোষের দড়িটির নাম ‘শঙ্খচূড়া নাগুনি’৷ জগন্নাথের রথে সওয়ার হন গোবর্ধন, কৃষ্ণ, নরসিংহ, রাম, নারায়ণ, হনুমান, রুদ্র প্রভৃতি ৯ জন দেবতা৷ নন্দীঘোষে গারুদা নামে এক রক্ষীও থাকেন৷ নন্দীঘোষের রং লাল এবং হলুদ। এটা বিষ্ণুর পছন্দের রং। নন্দীঘোষের চারটি ঘোড়ার নাম শঙ্খ, বলহাকা, শ্বেতা ও হরিদশ্ব। চারটিই সাদা। জগন্নাথের সারথির নাম মিতালি।

তালধ্বজ
বলরামের রথটি পাক্কা ৪৫ ফুট উঁচু। নাম তার তালধ্বজ। এই রথে বলরামের সঙ্গী হন রামকৃষ্ণ৷ তালধ্বজ রথে ৬ ফুট ব্যাসের মোট ১৪টি চাকা রয়েছে৷ মোট ৭৬৩টি কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় এই রথ৷ তালধ্বজের রক্ষীর নাম বাসুদেব৷ সারথি সাত্যকি। এই রথের মাথাতেও রয়েছে নিশান। নাম তার উন্যানী৷ এই রথের দড়িকে মনে করা হয় স্বয়ং বাসুকি নাগ৷ বলরামের রথেও ৯ জন দেবতা থাকেন৷ এঁদের মধ্যে আছেন কার্তিক, গণেশ, সর্বমঙ্গলা, মৃত্যুঞ্জয়, মুক্তেশ্বর প্রভৃতি৷ তালধ্বজের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোড়া, দীর্ঘশর্মা এবং স্বর্ণাভ। চারটি ঘোড়াই কালো। বলরামের সারথির নাম দাঁড়ুকা।

দর্পদলন
সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন, এটা ৪৪.৬ ফুট উঁচু। রথে থাকেন সুভদ্রার সঙ্গিনী সুদর্শনা। দর্পদলনের মাথায় থাকা পতাকার নাম নদম্বিকা। রথের রশির নাম স্বর্ণচূড়া নাগুনি৷ সুভদ্রার রথে থাকেন ৯ জন দেবী৷ এঁদের মধ্যে রয়েছেন চণ্ডী, চামুণ্ডা, বনদুর্গা, শুলিদুর্গা, শ্যামাকালী, মঙ্গলা, বিমলা প্রভৃতি৷ দর্পদলনের চারটি ঘোড়ার নাম রুচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিতা। চারটি ঘোড়ারই র‌ং লাল। সুভদ্রার সারথি অর্জুন।

সবার আগে তালধ্বজ এগিয়ে যায়, পিছনে থাকে দর্পদলন— আর সবার পিছনে মন্থর গতিতে আসে বিরাট চেহারার নন্দীঘোষ। সেই রথের চলন দেখতেই ভিড় জমান হাজার হাজার ভক্ত। লোকসমাগমে পুরীর সমুদ্রতীর এই ক'দিন একেবারে থিকথিক করে। রথযাত্রার এই তিনটি রথ নির্মাণে কিন্তু আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার একেবারেই হয় না। রথ তৈরির যে বিভিন্ন মাপজোখ থাকে, তা নেওয়া হয় মূলত হাত দিয়েই। ১৪০০ কারিগর একসঙ্গে রথগুলো তৈরি করেন। সে এক হই হই কাণ্ড। প্রথমে তৈরি হবে চারি নাহাকা। অর্থাৎ চারটে স্তম্ভ। এর ওপরেই ধাপে ধাপে গড়ে উঠবে রথ। এসময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই দেখতে পাবে জগন্নাথ দেবকে। রাজকীয় চালে ভক্তদের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যাবেন তিনি, আর রাস্তার দু'পাশে তাঁকে দেখে মোহিত ভক্তরা পুণ্যার্জন করবে। ভগবান নিজে যেখানে ভক্তের দরবারে আসেন, সেই অনুষ্ঠান জগতের আর চার-পাঁচটা অনুষ্ঠানের থেকে তো বিশেষ হবেই। তাই পুরীর রথযাত্রাকে ঘিরে ভক্তদের উন্মাদনাও কম নয়। মোক্ষলাভের আশায় প্রত্যেক বছর পুরী হয়ে ওঠে মহামানবের সাগরতীর, মিলনের ক্ষেত্র।

.

More Articles