দিলীপ ঘোষকে রাজ্য থেকে সরিয়ে লাভ হলো কাদের?

শুধুই দলের কর্মীদের একাংশই নন, এই পরিস্থিতিতে দিলীপবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, দলের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যও।

 

“৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে দেখালে ওঁদের কথা মেনে নেব। না হলে ভাবব, বিজেপিকে ড্যামেজ করার জন্য ওঁরাই তলায় তলায় সেটিং করেছেন তৃণমূলের সঙ্গে। বাংলায় বিজেপি বেড়েছে বলে তৃণমূল-সিপিএমের যতটা কষ্ট হয়েছে, আমাদের পার্টির অনেক লোকের কষ্ট হচ্ছে তার থেকেও বেশি।”

 

বক্তা দিলীপ ঘোষ। এবং এখানে 'ওঁদের' বলতে স্পষ্ট বোঝানো হয়েছে বঙ্গ বিজেপির অফিসিয়াল গোষ্ঠীকে।

 

ফলে, প্রশ্ন তোলাই যায়, দিলীপ ঘোষকে 'রাজ্যছাড়া' করে দলের অভিজ্ঞ শীর্ষ নেতৃত্ব যে ঐক্য-ফরমুলা সেট করলেন, তা কতখানি কার্যকর? বঙ্গ-বিজেপি তো যেমন ছিল, তেমনই আছে।

 

আরও পড়ুন: বাংলায় আবার শূন্য থেকে শুরু! শাহি পরিকল্পনায় সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বঙ্গ বিজেপির দাপুটে নেতারাই

 

বঙ্গ বিজেপির কিছু নব্য এবং অনভিজ্ঞ নেতাদের লাগাতর নালিশের জেরে শাহ-নাড্ডার বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত, দিলীপ ঘোষকে এবার সরিয়ে দাও বাংলা থেকে৷ তাই-ই হয়েছে। দলীয় ঘোষণা অনুযায়ী, রাজ্য বিজেপির ত্রিসীমানায় নেই দিলীপবাবু। এখন তাঁকে বিহার, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, আন্দামান, মেঘালয়, মণিপুর, ত্রিপুরা এবং আসামে দলকে শক্তিশালী করার ভার দেওয়া হয়েছে৷ এরপরেই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন ওঠে, দেশের ৭ রাজ্যে এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিজেপিকে শক্তিশালী করতে যোগ্যতম এবং দক্ষতম নেতা হিসেবে দিলীপ ঘোষকেই যখন শীর্ষ নেতৃত্ব 'ম্যান ফ্রাইডে' হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তখন তাঁকেই কেন বাংলার দুর্বলতম নেতৃত্বকে সবল করার দায়িত্ব দেওয়া হল না? ৮ রাজ্যের জন্য যিনি যোগ্য, নিজের রাজ্যে কোন যুক্তিতে তিনি অযোগ্য চিহ্নিত হলেন? আসলে তাঁর নামে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেছেন বঙ্গ বিজেপির ক্ষমতাসীন শিবিরের অনেকেই। সম্ভবত সেই কারণেই দক্ষতা বা যোগ্যতাকে নয়, দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দলীয় কোন্দলকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

 

তাঁকে 'বাংলা ছাড়া' করার দলের এই সিদ্ধান্ত যে দিলীপ ঘোষ ভালোভাবে নেননি, তা স্পষ্ট হয়েছে ইদানী‌ং তাঁর বলা অনেক কথাতেই৷ কেন্দ্রীয় বিজেপি এই মুহূর্তে দিলীপ ঘোষের রাজনৈতিক ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে দিলেও তিনি যে নিজের মতেই চলবেন, তা নিশ্চিত করে দিয়েছেন তিনি। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা বর্তমান সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই জানিয়েছেন, "বাংলার যেখানে খুশি যাব, কে আটকাবে আমাকে।" রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, শাসক তৃণমূলকে নয়, একথার মাধ্যমে তিনি নিজের দল বিজেপিকেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যতই তাঁকে নতুন দায়িত্ব দিক, প্রথম থেকেই দিলীপবাবু স্পষ্ট করেছেন, কোথাও যাচ্ছেন না, বাংলাতেই থাকছেন। বলেছেন, তিনি বুক চিতিয়ে, চোখে চোখ রেখে লড়াই করেন। কেউ বললেই তিনি পাল্টে যাবেন বলে যাঁদের ধারণা, তাঁরা সেই ধারণা পাল্টে ফেলতে পারেন। যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেন, তাঁদের নাম না করেই দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ওইসব লোকদের কোনও যোগ্যতা নেই। ওদের পাত্তা দিই না। নাম মুখে নিই না। এরা পার্টিকে কী দিয়েছে। নতুন দায়িত্ব এবং তা পালন করা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, রাজ্যে বসেই তিনি কৌশলী ভূমিকা নেবেন। দলের ঘনিষ্ঠদেরও তিনি বাংলায় থাকার কথাই জানিয়ে বলেছেন, “কোথাও যাচ্ছি না, বাংলাতেই থাকছি। প্রথমে এক- দু’বার যাব। কাজ শুরু করে দিয়ে চলে আসব। এখানে বসে থেকেই যা করার করব। সবই তো ভার্চুয়ালি হবে। যা রিপোর্ট নেওয়ার অ্যাপের মাধ্যমেই পেয়ে যাব৷" পাশাপাশি দিলীপবাবু বলেছেন, শুভেন্দু অধিকারী কোনও জননেতা-ই নন, মেদিনীপুরের নেতা। বলেছেন, সুকান্ত মজুমদারের তো সংগঠন চালানোর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।

 

দিলীপ ঘোষ ইস্যুতে এই মুহূর্তে বঙ্গ বিজেপির অন্দরে যখন অস্বস্তির ঝড় উঠেছে, তখন একবার পিছনের দিকে যাওয়া যাক।

 

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নানা দল থেকে দলে দলে সুবিধেবাদী নেতারা বিজেপিতে গিয়েছেন। অনেকে থেকে গিয়েছেন, অনেকে ফের দলবদল করেছেন। বাংলার দলবদলুদের ঠিকানা যে একমাত্র বিজেপিই হতে পারে, তেমন পরিস্থিতি তৈরি করার পিছনে দিলীপ ঘোষের অবদান অনস্বীকার্য। তবে কালক্রমে দেখা যায়, অন্য দল থেকে আসা লোকজনই দিলীপ ঘোষকে আর তেমন পছন্দ করছেন না। দিলীপের পক্ষে ও বিপক্ষে দলের মধ্যেই নানা উপদল তৈরি হয়ে যায়। উপদলগুলোর একাংশ দলের অন্দরে দিলীপের বিরুদ্ধেই মত প্রকাশ করা শুরু করে। এইসব উপদলের মাথায় চেপে বসেন দলে নবাগতরাই। দিলীপ ঘোষের পুরনো সতীর্থদের কেউ কেউ হাত মেলান এইসব উপদলের সঙ্গে৷ ফলে সমস্যা বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে ধারাবাহিক নালিশ জানিয়ে একসময় 'ফল' পায় দিলীপ-বিরোধীরা। মেয়াদ শেষের আগেই রাজ্য সভাপতির পদ থেকে অপসারিত হন দিলীপ ঘোষ। অনেক নাম টপকে ওই আসনে বসেন সাংসদ সুকান্ত মজুমদার। নির্দিষ্টভাবে কোনও দায়িত্ব না দিয়েই দিলীপ ঘোষকে দেওয়া হয় বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদ। মুখে কিছু না বললেও কাজকর্মের মাধ্যমে দিলীপ ঘোষ বুঝিয়ে দেন, তিনি বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। দলের অন্দরের বক্তব্য, তখন থেকেই দিলীপ ঘোষ কার্যত অফিসিয়াল গোষ্ঠীর সমান্তরাল সংগঠন চালাতে থাকেন‌।


সেই চাকা এখনও ঘুরেই চলেছে।

 

দলে দিলীপ-পন্থীদের সাম্প্রতিক অভিমত, দিলীপ ঘোষ শীর্ষ নেতৃত্বের অবিচারের শিকার হয়েছেন। বাংলার বিজেপির মাথায় অনেক বড় বড় নেতাকে এতদিন বসানো হলেও দলকে এত সাফল্য দিলীপ ঘোষের আগে কোনও সভাপতিই দিতে পারেননি। এত সাংসদ, বিধায়ক, প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ বৃদ্ধি এর আগে হয়নি। দিলীপবাবু নিজে পর পর বিধানসভা ও লোকসভা, দু'টি ভোটেই জয়ী হয়েছেন। আসলে দিলীপবাবু ঠোঁটকাটা মানুষ স্পষ্ট কথা বলেন, তাই হয়তো দলের একাংশের বিরাগভাজন হয়েছেন‍। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বোঝা উচিত ছিল, এই পরিস্থিতিতে দলে কার অথবা কাদের অপরিহার্যতা বেশি।

 

দিলীপবাবু যে ঠোঁটকাটা, তার পরিচয় রাজ্যের রাজনৈতিক মহল বার বার পেয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্বকে নিজের স্টাইলে প্রায় রোজ বিঁধছেন। এতদিন নিজের দলের একাংশের বিরুদ্ধে তেমনভাবে প্রকাশ্যে সরব না হলেও এখন, রাজ্য থেকে কার্যত অপসারিত হওয়ার পর, সমানে তোপ দেগে চলেছেন বঙ্গ বিজেপির অফিসিয়াল গোষ্ঠীর দিকে। বঙ্গ বিজেপির আদি-নেতাদের হয়ে বারে বারেই মুখ খুলে প্রতিবারই নব্য ও অনভিজ্ঞদের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন দিলীপ। সেই 'কার্যক্রম' এখনও থামেনি৷ তাঁর মন্তব্য নিয়ে বিভিন্ন সময়েই বিতর্কও হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই তাঁর সমালোচনাও করেছেন। দলের শাসক গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে দিনকয়েক আগে দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “আমি তো বাংলার দায়িত্বে নেই। এবার পার্টিটাকে জিতিয়ে দেখান। ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে দেখান।” বোঝাই যাচ্ছে, দিলীপ ঘোষ নাম না করে সুকান্ত-শুভেন্দুদেরই নিশানা করেছেন। এইটুকুতেই শেষ নয়, দলের অন্দরে তাঁর 'শত্রুদের' কড়া আক্রমণ করে দিলীপ বলেন, “৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে দেখালে ওঁদের কথা মেনে নেব। না হলে ভাবব, বিজেপিকে ড্যামেজ করার জন্য ওঁরাই তলায় তলায় সেটিং করেছেন তৃণমূলের সঙ্গে৷ বাংলায় বিজেপি বেড়েছে বলে তৃণমূল-সিপিএমের যা কষ্ট হয়েছে, আমাদের পার্টির অনেক লোকের কষ্ট হচ্ছে তার থেকেও বেশি‌।”

 

আসলে দিলীপবাবু মানতে পারছেন না, নির্বাচনে তাঁর হাত ধরেই বঙ্গ বিজেপির এই উত্থানের পরেও, তাঁকেই বাংলার সংগঠনে এভাবে ব্রাত্য করে অন্য রাজ্যে পাঠানোর সিদ্ধান্তটি৷ দলের সর্বভারতীয় সহ- সভাপতির দাবি, “আমি যদি ভুল থাকতাম তাহলে পার্টি এগোত না।”


ফলে এই মুহূর্তে 'অপসারিত' দিলীপ ঘোষকে নিয়েই বঙ্গ বিজেপিতে চর্চা তুঙ্গে। দলের অন্দরের চর্চা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বৃহত্তর রাজনৈতিক আঙিনাতেও। দিলীপ ঘোষের ধারণা হয়েছে, তাঁকে বাংলা থেকে সরানোর পিছনে অফিসিয়াল গোষ্ঠীর কিছু নেতার কলকাঠি নাড়ানোর বড় ভূমিকা রয়েছে‌। দলের একাংশও তেমনই মনে করছে। ওদিকে দলের অন্দরের দিলীপ-শিবিরের দাবি, দলের পুরনো নেতাদের পক্ষে কথা বলেই বর্তমান ক্ষমতাসীন শিবিরের বিরাগভাজন হয়েছেন তিনি।

 

দলের অন্দরে কোন্দল ধামাচাপা দিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিলীপ ঘোষকে সরিয়ে অফিসিয়াল গোষ্ঠীকে 'ক্ষমতাশালী' করলেও রাজ্য দলের বড় অংশের প্রশ্ন, যাঁর হাত ধরে বঙ্গ বিজেপির নির্বাচনী উত্থান, তাঁকে কেন বাংলার সংগঠনে বারবার অপাঙক্তেয় করে রাখা হচ্ছে? কেন তাঁকে এভাবে অন্য রাজ্যে পাঠানো হচ্ছে? এর পিছনে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে রাজ্য বিজেপির ক্ষমতাসীন শিবিরের কয়েকজন নেতার ভূমিকা৷ পাল্টা এমন অভিযোগ তুলে বঙ্গ বিজেপির পুরনো নেতা-কর্মীরা দিল্লিকে বুঝিয়েছেন, এই ঘটনায় তাঁরা ক্ষোভে ফুঁসছেন‍।

 

শুধুই দলের কর্মীদের একাংশই নন, এই পরিস্থিতিতে দিলীপবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, দলের প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যও। সংবাদমাধ্যমে লকেট বলেছেন, "দিলীপ ঘোষ তো বাংলার নেতা, তাই বাংলাতেই থাকবেন। আমাকেও উত্তরাখণ্ডের দায়িত্ব দিয়েছিল দল। দায়িত্ব পালন করে বাংলাতেই ফিরেছি৷ তেমনই ৮টি রাজ্যের 'বুথ সশক্তিকরণ'-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দিলীপ ঘোষকে। এটা আমাদের গর্বের বিষয়। সেই কাজ হয়ে গেলে দিলীপদা যেমন বাংলার নানা প্রান্তে ঘোরেন, তেমনই ঘুরবেন।” বঙ্গ-বিজেপির এই কাছাখোলা পরিস্থিতিতে দিলীপ ঘোষের পাশে দাঁড়িয়ে শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, "সবার মনে রাখা উচিত দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বেই বিজেপি ২০১৯ সালে ১৮টি লোকসভা আসন পেয়েছিল। ২১ সালে ৭৭টি বিধানসভা আসনও পেয়েছে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির জন্য। বঙ্গ বিজেপি দিলীপ ঘোষ ছাড়া অসম্পূর্ণ।"

 

এদিকে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে গোটা দেশের সঙ্গে বাংলাতেও চলবে বিজেপির দলীয় কর্মসূচি, 'বুথ সশক্তিকরণ অভিযান'। কে থাকছেন বাংলার দায়িত্বে? বিজেপি সূত্রের খবর, সম্ভবত উড়িষ্যার বিজেপি নেতা বৈজয়ন্ত পান্ডা থাকবেন এ-রাজ্যের দায়িত্বে। সুতরাং, ধরেই নেওয়া যায় বঙ্গ বিজেপিকে ফের 'বহিরাগত' তোপের সামনেই দাঁড়াতে হতে পারে।

 

এদিকে শোনা যাচ্ছে, বঙ্গ বিজেপির ধুন্ধুমার এই পরিস্থিতির মধ্যেই নাকি রাজ্যে আসছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। কথা আছে, আগামী ৬ জুন রাজ্যে এসে পরদিন, ৭ জুন কলকাতায় কার্যকারিণী বৈঠক করবেন নাড্ডা। ওই বৈঠকে দিলীপ-শিবির মুখ বন্ধ করেই থাকবেন, এমন গ্যারান্টি কিন্তু দলের কেউই দিতে পারছেন না।

More Articles