অশান্ত কাশ্মীর ভরিয়ে তুলছেন সবুজে, দু'লাখের বেশি গাছ লাগিয়েছেন 'বৃক্ষমানব'

পঞ্চাশোর্ধ্ব হামিদ শ্রীনগরের বাসিন্দা। উপত্যকার জনশূন্য এলাকায় দু'লাখেরও বেশি গাছ লাগিয়ে হামিদ কাশ্মীরের বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে উপত্যকায় ১০ লাখ বৃক্ষরোপণ করবেন।

 

পথের হাজার বাধা অতিক্রম করে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা মুখের কথা নয়। আর এই চলার পথে যাঁদের সাফল্য আসে, তাঁরা দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যান বহুকাল। এমনই একজন ব্যক্তিত্ব কাশ্মীরের আব্দুল হামিদ ভাট। পঞ্চাশোর্ধ্ব হামিদ শ্রীনগরের বাসিন্দা। উপত্যকার জনশূন্য এলাকায় দু'লাখেরও বেশি গাছ লাগিয়ে হামিদ কাশ্মীরের বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে উপত্যকায় ১০ লাখ বৃক্ষরোপণ করবেন।

কাশ্মীরের বাসিন্দা হামিদের বয়স ৫৬ বছর। পেশায় একজন স্কুটার মেকানিক এবং রহিম মোটরসের মালিক। তাঁর দোকান শ্রীনগরের অন্যতম বড় গাড়ির ওয়ার্কশপ। ব্যবসায়ী মোগল হামিদের মনের ইচ্ছে, সর্বদা সবুজে মোড়া কাশ্মীর উপত্যকা গঠন। কাশ্মীরের একটি সংবাদপত্র সূত্রে খবর, ওয়ার্কশপ থেকে হামিদ যে অর্থ উপার্জন করেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ 'রহিম গ্রিনস' নামক একটি সংস্থায় বিনিয়োগ করেন তিনি।

সবুজপ্রেমী হামিদ জানিয়েছেন যে, তিনি কাশ্মীরের শুষ্ক সমভূমিতে ইতিমধ্যেই ২ লাখেরও বেশি গাছ লাগিয়ে ফেলেছেন। মধ্য কাশ্মীরের বুদগাম অঞ্চলের সুথারণ বনভূমির হাজার হাজার আলপাইন গাছ কাঠ পাচারকারীদের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ধু ধু প্রান্তরে পরিণত হয়েছিল সেই এলাকা। কিন্তু হামিদের শ্রম বদলে দিয়েছে পুরো ছবিটা। দশ বছর আগে সেখানে গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন হামিদ ভাট। আজ স্বমহিমায় ফিরে এসেছে সুথারন বনভূমি। হামিদের কথায়, "আমি খুব আনন্দিত। আপনি যদি ১০ বছর আগে এখানে আসেন, তখন একটি মরুভূমির রূপ নিয়েছিল এই এলাকা। প্রায় সমস্ত গাছ কেটে ফেলা হয়েছিল। মাত্র পাঁচ থেকে দশটা গাছ অবশিষ্ট ছিল। তবে আজ এটি একটি সুন্দর সবুজ বন।"

আরও পড়ুন: হাতে তির-ধনুক, না মাওবাদী নন, অস্ত্র হাতে গাছ বাঁচাচ্ছেন এই আদিবাসী মেয়েরা

হামিদ আরও জানিয়েছেন, "আমার কিন্তু তহবিল সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার থেকেও সাহায্য পাই না। আমি আমার ব্যক্তিগত উপার্জিত অর্থ ব্যয় করছি এই কাজের জন্য।" সাধারণ সামাজিক মানুষের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। জীবনে কিছু অর্জন করার পর তা সমাজকে ফিরিয়ে দিতে হয় প্রত্যেককে । সেই থেকেই হামিদের এই পদক্ষেপ।

গ্রামবাসীদের উৎসাহ তাঁকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করে। ১০ লক্ষ বৃক্ষরোপণের স্বপ্নপূরণের জন্য তিনি শের-ই কাশ্মীর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইতিমধ্যেই হাত মিলিয়েছেন। আলপাইনের জঙ্গল তৈরির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ১ লাখ চারা সরবরাহ করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সকলেই এই বদল সম্পর্কে অবগত। তবে অবাক কাণ্ড হলো, যারা একসময় এই জঙ্গলের কাঠ চুরি করে বাজারে বিক্রি করত, আজ তারাই এগিয়ে এসেছে হামিদকে সাহায্য করতে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া জমিতেই হামিদের স্বপ্নের চাষ এগোচ্ছে ধীর গতিতে। আলপাইনের নার্সারি তৈরি হবে ওই জমিতে।

তাঁরা আশাবাদী, আলপাইনের জঙ্গল এই উপত্যকায় ঘুরতে আসা মানুষের কাছে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে। প্রত্যয়ী হামিদের গলায় শোনা যায়, "এই পথ কঠিন। কিন্তু আরও আরও গাছ লাগানোর ইচ্ছা আমাকে কখনওই থামাতে পারেনি। তাই শেষ পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে যাব।"

২০১৯ সালের ফরেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় ভূখণ্ডের ২৪.৫৬% এলাকায় বনাঞ্চল রয়েছে। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ভারতে অতীতের তুলনার বনভূমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫,১৮৮ বর্গ কিলোমিটার। তবে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর। সাম্প্রতিক সময় উপত্যকায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে গাছের পরিমাণ। ফলস্বরূপ, গবেষকদের ধারণা, এর ফলে উপত্যকার জীবভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে কাশ্মীরের বন্যার কথা আজও অমলিন হয়নি সেখানের অধিবাসীদের মনে। ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় উপত্যকার মানুষদের। সেই সময় ৩ লক্ষ ২৭ হাজার হেক্টর চাষের জমি নষ্ট হয়ে যায়। বাদাম, আখরোটের মতো গাছগুলি বড় হতে ১০ থেকে ১৫ বছর সময় প্রয়োজন। সেখানে আগামী কয়েক বছরে যেভাবে বনভূমির পরিমাণ কমেছে, তাতে ভূমিধ্বস, আকস্মিক বন্যার সম্ভাবনা প্রবল।

উত্তর কাশ্মীরের অবস্থাও প্রায় একইরকম। স্থানীয় দুই যুবক ওয়াসিম আহমেদ এবং রিয়াজ খান প্রতিনিয়ত দেখেন এলাকার দেওদার, পাইন গাছগুলির মৃত্যু। চোরা-কাঠপাচারকারীরা সাফ করে দিচ্ছেন বনাঞ্চল। নিজেদের মতো করে এর বিরূদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজ করেন তাঁরা। তাঁদের কথায়, "উন্নয়ন এবং পর্যটনের নামে আপসহীনভাবে সুবজ ধ্বংস করা হচ্ছে উপত্যকায়। অথচ এই বন আর বনের মানুষরাই আমাদের পরিচয়।" কিন্তু এর শেষ কোথায়, তাঁর উত্তর নেই। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে হামিদের বৃক্ষরোপণের পদক্ষেপ অনন্য। তাঁর স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগলে ধীরে ধীরে উপত্যকা ফিরে পাবে তার সবুজ পরিচিতি।

 

 

More Articles