সেই অবিস্মরণীয় ৭১! শত শত বাঙালি ভাইয়ের রক্তপাতের ইতিহাস ভোলা যায় না

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল আমাদের পূর্ব প্রান্তের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছরের মতো এবারেও পালিত হচ্ছে গৌরবময় বিজয় দিবস। ৯ মাসের টানা মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তান সেনা। বাংংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ণ শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিল ভারতও। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ সংগ্রামে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। 

১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় শত্রু পাকিস্তানকে পরাস্ত করতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ  মুজিবকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে মিত্রশক্তি সম্পর্ক স্থাপন করে পাক সেনাকে পরাজিত করে অভ্যুদয় ঘটে ছিল বাংলাদেশের। সেই দিনটিকে স্মরণীয় রাখার জন্য প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর পালিত হয় বিজয় দিবস। তবে এই বছরের বিজয় দিবসের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে।এ বছরটা স্বাধীন বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীবর্ষ। দেখতে দেখতে পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে গেল বাংলাদেশের বিজয়। তবে এই বিজয় দিবসের পিছনে রয়েছে অনেক না বলা ইতিহাস। রয়েছে বহু মানুষের রক্তের ঋণ, মুজিবের হার না মানা মনোভাব, ইন্দিরা গান্ধীর কূটনীতি, সর্বোপরি পাকিস্তানের বাহিনীর সঙ্গে লাগাতার সংঘর্ষের রোমহর্ষক ইতিহাস। 

 শুরু করা যাক একটু পিছনে থেকেই। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও স্বাধীনতা পায়নি বাংলাদেশ। সেই সময় বর্তমান বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীনে, পূর্ব পাকিস্তান। সালটা ১৯৭০, বাংলাদেশ উপকূলে আছড়ে পড়ল এখনো পর্যন্ত ঘটা পৃথিবীর সবথেকে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ভোলা। মারা গেলেন প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক। বারংবার অনুরোধ সত্বেও পাক প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং আওয়ামি লিগের কোনও কথাই শুনতে রাজি হলো না। তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের অব্যবস্থা তো ছিলই, তারপর ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাংলাদেশের নাগরিকদের কোনও সাহায্য না দেওয়ার কারণে বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে জমতে শুরু করল ক্ষোভ। সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

এই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে ওইদিন পাকিস্তানি সেনা বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল। সেই সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং সামরিক শাসক ছিলেন তিনি। জানা যায়, তার আদেশেই পাকিস্তানি সেনা বাংলাদেশি নাগরিকদের উপর এই হত্যালীলা চালিয়েছিল। তৎকালীন সময়ের আন্তর্জাতিক একটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, '৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করো, দেখবে বাকিরা আমাদের হাত চাটবে।' কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঠিক তার উল্টোটা।

২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি প্রতিরোধ রীতিমতো গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙ্গালীদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হলো। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো নির্দ্বিধায়। মারা গেলেন বহু সাধারণ মানুষ। কতজনকে পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেছিল তার এখনও ইয়ত্তা নেই। লক্ষাধিক বাঙালি মারা গিয়েছিলেন ওই অপারেশন সার্চলাইটে। অপারেশন সার্চলাইট শেষ হয়ে গেলে ওইদিন রাত্রেই পাকিস্তানের সেনার হাতে গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ মুজিবের গ্রেফতারির পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সংগ্রাম যেন আরো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। দেশভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষদের ক্ষোভ জন্মাতে শুরু করেছিল। আদতে এই মুক্তিযুদ্ধ এবং এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আসল কান্ডারী ছিল ব্রিটিশরা। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ করার কথা চলছে তখন ব্রিটিশরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ করে দিলেন ভারত। যেহেতু ভারতের পশ্চিম প্রান্ত অর্থাৎ পাকিস্তান এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পরিমাণ বেশি ছিল তাই তাদের নিয়ে অবিভক্ত পাকিস্তান তৈরি হলো।

অন্য দিকে মাঝখানে রইল হিন্দু  জনঘনত্বের ভারত। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা। শোষণ এবং নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে গড়ে উঠতে থাকে একাধিক মুক্তিযুদ্ধ এবং সংগ্রাম। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছিল এই মুক্তিযুদ্ধের। তারপরে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করা, ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য আন্দোলন, ১৯৫৮ সালে মার্শাল আইনের বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে ভোলা সাইক্লোন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামি লিগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা। এবং আরও অনেক সংগ্রামের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। 

এর মধ্যে বেশ কিছু আন্দোলনের প্রধান মুখ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট তথা আওয়ামি লিগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট এর পরে এই আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ নেয়। ঠিক তারপরের দিন ২৬ মার্চ একেবারে প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলেও, তার আদেশ করা পথ অনুসরণ করেই দীর্ঘ ৯ মাস ধরে পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চালায় আওয়ামী লীগ। 

অবশেষে আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত ১৬ ডিসেম্বর। তৎকালীন পাকিস্তানের কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী ভারতের পূর্ব প্রান্তের সেনা কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আত্মসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর করেন জেনারেল নিয়াজী। যুদ্ধে জয়ী হয় ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথবাহিনী। গঠিত হয় স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দিনটি চিহ্নিত হয় বিজয় দিবস হিসেবে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে এক নতুন রাষ্ট্রের, যা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আস্তে আস্তে নিজেদেরকে প্রমাণ করে আসছে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।

ভারত এবং বাংলাদেশের জন্য একটা স্মরণীয় দিন ১৬ ডিসেম্বর। ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করেছিল বাংলাদেশ। ২৪ বছরের পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে উঠেছিল নতুন সূর্য। ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে শ্রমিক কৃষক সবাই বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করেছিলেন। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে। নাম বদল করেছিল পূর্ব পাকিস্তান, হয়েছিল বাংলাদেশ। অপারেশন সার্চলাইটের ঠিক দু'দিন পরে বাংলাদেশকে পূর্ণ সমর্থন করতে রাজি হয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ত্রিপুরা, অসম এবং মেঘালয় সীমান্তে গড়ে তোলা হয়েছিল একাধিক শরণার্থী শিবির। বাংলাদেশি সেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। আর বাংলাদেশ থেকে যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে এদিকে এসেছিলেন সেই রিফিউজিদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিল ভারত সরকার। তবে ভারতের উপরেও আক্রমণের রোষ পড়েছিল। ১১টি ভারতীয় সেনা শিবিরে বিমান হামলা করা হয় পাকিস্তানের তরফ থেকে। ৩৯০০ ভারতীয় সেনা শহিদ হয়েছিলেন ওই মুক্তিযুদ্ধে। তার সাথে সাথেই আহত হয়েছিলেন ১০ হাজার ভারতীয় সেনা। কিন্তু এত সংগ্রাম বিফলে যায়নি। ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান। আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী। ইতিহাসের পাতায় একটা সুবর্ণ দিন। ৫০টি বছর পার করে ফেলেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। কিছু  বিচ্ছিন্ন ঘটনার খবর আসলেও ভারত এবং বাংলাদেশের কাছে আজকের দিনটি একই রকমভাবে স্মরণীয়। সেই অবিস্মরণীয় ৭১ আজকে ২০২১-এ এসেছে, স্মরণীয় থাকুক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর।

More Articles