বৃষ্টি নামিয়েছিলেন গানে গানে! ভক্তের তালিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ফৈয়াজ খাঁ আজও অচেনা

'আলো ক্রমে আসিতেছে'। টোরির ধ্রুপদী আঙ্গিকে এক্ষুনি বেজে উঠবে  উজ্জ্বল রেখাব। আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পূব আকাশ থেকে উঁকি দেবে দশটা পাঁচটার সূর্য। এভাবেই নাগরিক জীবনে কর্মব্যস্ত সকাল আসে। তার রঙের বর্ণমালাকে স্বরগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রণিপাত জানান শিল্পী। শোনা যায়, অবন ঠাকুর নাকি গল্প আঁকতেন এবং ছবি লিখতেন। এমন বর্ণিল উপমাতেই তাঁকে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বটেই তো। তাঁর হাতের কালি কলমে ফুটে উঠেছিল 'ক্ষীরের পুতুল'এর অমন আশ্চর্য সব চিত্ররূপময় সব বর্ণনা। তবে, আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি সে অর্থে রং তুলি বা কালি কলমের মানুষ ছিলেন না। তাঁর দীর্ঘ জীবনের খাস জমিন জুড়ে ছিল শুধু তানপুরার চারটি তারের অষ্টপ্রহর ধুকপুকুনি। আর এই চার তারের মিঠে ধ্বনিতেই তিনি অবলীলাক্রমে কেবলই জন্ম দিতেন দৃশ্য আর শব্দের। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ; সংগীতজ্ঞ কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যাঁকে তুলনা করছেন ফতেহপুর সিকরির বুলন্দ দরওয়াজার বিরাটত্বের সঙ্গে। 

সে ছিল এক প্রাচুর্যের উনিশ শতক। হিন্দুস্থানের শিল্পকলার ভাণ্ডারে তখন অফুরন্ত প্রাচুর্য। এরকম সময়, আগ্রার নিকটবর্তী সিকন্দ্রা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেন এক শিশু। তারপর কালে কালে তিনি হয়ে উঠলেন আগামী শতাব্দীর মুক্তিসূর্য। শাস্ত্রীয় সংগীতের এ রাজা ধীরাজের নামের আগে জুড়ল মস্ত পদবি, 'আফতাব এ মৌসিকি'। বিস্ময়ের কাল বিশ শতক। এ শতাব্দীর জল হাওয়াতেই তো বেড়ে উঠেছিলেন উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ এবং রঙ্গিলা গায়কীর দ্রোণাচার্য উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ। বেশুমার চাহনেওয়ালার কাছে কিংবদন্তি তিনি। আর কে না জানে, সকল কিংবদন্তির জীবনরেখার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে হাজার গল্পকথা। তেমনই কিছু গল্পের টুকরো তুলে ধরতে চাইছি আমরা।

আতা হুসেন খাঁ তখন তালিম নিচ্ছেন আগ্রার নিজস্ব গায়নরীতিতে। থেকে থেকেই চলে যান বরোদায়, মামু ফৈয়াজ খাঁর বাড়ি। সেখানে তিনি থাকেন, গলা সাধেন, অগ্রজর কাছ থেকে বুঝে নেন রাগদারী। সে সময়ের নিয়ম ছিল এমনই। গেলাম, শিখলাম, চলে এলাম, এ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান তখন হত না। তালিম নিতে গেলে গুরুগৃহে এসে থাকো, তাঁর খিদমত খাটো, তারই মধ্যে মধ্যে পরম যত্নে শিখে নাও পরম্পরার চিজ। এমনটাই ছিল রীতি। তা যাই হোক। এরকমই একদিন অপরাহ্নে তানপুরা হাতে আতা হুসেন সাহেব বসেছেন রেওয়াজে। প্রারম্ভের নোম তোম আলাপ সেরে সবে ধরেছেন ধামার বা মধ্য বিলম্বিতের কোনও বন্দিশ। তিনি জানেন না, খাঁ সাহেব গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন তার পেছনে, মুখে আলতো হাসি নিয়ে শুনছেন শিষ্যের রেওয়াজ। এমন সময়, আতা সাহেবের আওয়াজ ছাপিয়ে তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা তান। এমনই তার হুঙ্কার যে আতা হুসেনের হাত থেকে তানপুরা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। মুখ তুলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। সে সময় সুরকে সঠিক ভাবে পেশ করতে কেটে যেত বছরের পর বছর। একেকজন উস্তাদকে কম করে হলেও তিন থেকে চার ঘণ্টা মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে হত। আওয়াজে যথাযথ তাসীর না হলে শ্রোতা আর অতক্ষণ ধরে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর গান শুনবেই বা কেন? এ কথা মাথায় রেখেই শৈশবকাল থেকে তালিম নিতেন শিক্ষানবিশরা। নইলে কি আর সুরের মায়ায় নিছক কাঠের যন্ত্র পর্যন্ত অযান্ত্রিক হয়ে ওঠে?

আরও পড়ুন-নিগ্রহ, ধর্ষণ, পুলিশের তাড়ায় বিপর্যস্ত অভিজিতের ইচ্ছেপূরণের নাম অভীনা

আরেকদিনের কথা। গল্পটা জানা যায় সৈয়দ মুজতাবা আলীর লেখায়। ইলেকট্রনিক মাইক্রোফোনের যুগ তখন শুরু হয়ে গেছে। মঞ্চে তার ব্যবহারও ঘটছে কিছুকিছু। কিন্তু রসিক শ্রোতা মাত্রই ঢালাও ফরাসের উপর বাবু হয়ে বসে মজলিসি ভঙ্গিতে গান বাজনা শুনতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। একটু অবস্থাপন্ন সংগীতপ্রেমী হলে তাঁর বাড়িতে নিয়মিত মজলিস লেগেও থাকে। বোরোদার এরকমই এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গাইবেন খাঁ সাহেব। শহরে সেদিন বাঁশপোড়া গরম। দ্বিপ্রাহরিক তাপমাত্রা ১১৪ ডিগ্রি। গৃহকর্ত্রী বায়না জুড়লেন, মেঘমল্লার শোনাতে হবে। খাঁ সাহেব মেঘমল্লার ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে শুরু হল বৃষ্টি। নবজলধর আর কাঁহাতক নিস্পৃহ নিরাসক্ত বসে থাকতে পারে? তৈয়ারির ঠাসবুনোটের কাছে এসে একসময় পরাস্ত তো তাকে হতেই হয়।  সভাস্থলে সকলে চমকে উঠলেন। মুজতাবা সাহেবের কথায়, 'মহফিলে হুলুস্থুল পড়ে গেল'। পরদিন খাঁ সাহেব বিষণ্ণবদনে মুজতাবা আলীকে বললেন, 'আচ্ছা সৈয়দ সাহেব, লোকে আমাকে এরকম লজ্জা দেয় কেন বলুন তো? আমি কি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারি?'

কবীর সুমন পঙ্কজকুমার মল্লিককে নিয়ে বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, 'হিমালয় পর্বত যদি গান গাইতে পারত, তবে সেটা নিশ্চই পঙ্কজ মল্লিকের মতো হত'। এ কথা সম্ভবত খাঁ সাহেবের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সে পর্বতের সুর আর আমরা পুরোদমে শুনে উঠলাম কই। যা দেখেছি তা তো কেবল হিমশৈলের চূড়াটুকু। রেকর্ড এ খাঁ সাহেবের যেটুকু যা পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই ওঁর বয়সকালের গান। শরীরে তখন ছড়িয়ে পড়েছে টিবি। গলা জবাব দিতে শুরু করেছে। মৃত্যুর ছ'মাস আগেও অল ইন্ডিয়া রেডিওয় দেশ রাগে গান গেয়েছিলেন তিনি। সিংহের গলায় তখন ব্যাধি। গাইতে বসেন একটা পিকদান সঙ্গে নিয়ে। একটু করে গান, তারপর গলায় রক্ত উঠলে সেটা পিকদানে ফেলে আবার সুরের অরণ্যে প্রবেশ করেন। আগ্রা ঘরানার কূলপ্রদীপ উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ। শোনা যায়, একবার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে রবীন্দ্রনাথকে রামকেলি রাগে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি। রবি ঠাকুর খুশি হয়ে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন ২১ টা মোহর, এবং বলেছিলেন, 'এই ভদ্রলোক আমার জীবনের পঞ্চাশটা বছর কেড়ে নিয়েছেন।'

More Articles