মান্নার কণ্ঠে উত্তমের লিপে বাংলা গানে র‍্যাপের ছাপ! রইল তুমুল জনপ্রিয় সেই গানের ইতিহাস

Uttam Kumar-Manna Dey: পরিচালককে বললেন, “‘আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম’— মান্নাদার মতো ভারতবর্ষের কোনও শিল্পীই গাইতে পারবে না।” খুব একটা ভুল যে বলেননি, তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই। মান্না দে-ই নেপথ্যসঙ্গীতে রয়ে গেলেন।

সিনেমার জগতেও আর চার পাঁচটা উপস্থাপনার ক্ষেত্রের মতো গতের চল বেশি। ধরুন, আপনার বাড়িতে অতিথি এসেছে। আপনি কিছু মিষ্টি, তেলেভাজা সাজিয়ে পরিবেশন করলেন। দেখা গেল মিষ্টি তিনি তেমন পছন্দ করছেন না। তেলেভাজাতেই তাঁর ঝোঁক বেশি। পরেরবার থেকে খাবার পরিবেশনের সময় আপনি সেইটেই মাথায় রাখবেন। ঠিক সেরকম, মাচায় যদি কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নাচ করে, তবে ফলাফল খুব একটা সুখকর হবে না। এই যে একটি বিশেষ জিনিস স্থানকালপাত্র ভেদে গ্রহণ, এ যেমন প্রেক্ষিত নামক একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তৈরি করে, যার কাঁধে ভর দিয়ে সমস্ত অর্থ-অনর্থের জগৎ দাঁড়িয়ে রয়েছে, আবার এই প্রেক্ষিতই সময় বিশেষে এক একটা সীমাবদ্ধতার খোপ টেনে দেয়। পূর্বনির্ধারিত এই খোপ কাজের থেকে অকাজ করে বেশি। একেই বলে গত। বাংলা সিনেমাতেও এই গতের বিপুল প্রভাব ছিল, আছেও। যে কয়েকজন হাতে গোনা পরিচালক সেটা ভেঙে কাজ করার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের মধ্যে সরোজ দে অন্যতম। সরোজ দে-র নাম বললেই অনিবার্যভাবে ‘কোনি’-র নাম চলে আসবে। এ সেই গতের প্রভাব। তবে ‘কোনি’ ছাড়াও বাংলা ছবির জগতে আরও বেশ কয়েকটি অভূতপূর্ব কাজ তিনি করে গেছেন। তার মধ্যে একটি হল উত্তমের লিপে মান্নার কণ্ঠে গান। এমনকি র‍্যাপ মিউজিকের ছোঁয়া পর্যন্ত ছিল তাতে। আজ তাই নিয়ে আড্ডা জমুক বরং।

নতুন গায়ক-গায়িকদের নিয়ে কাজ করা সরোজ দে-র একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বলা যায়। সুধীন দাশগুপ্তের মতো মানুষকে ছবির জগতে প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন এই সরোজ বাবুই। ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে তারাশঙ্করের লেখায় সুর করলেন সুধীন দাশগুপ্ত। কোনও বাদ্যযন্ত্র ছাড়া কেবলমাত্র একটি দোতারার রিদমে মান্না দে-কে গাইতে বললেন সরোজ দে। “ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি”! সে গান যে কী পরিমাণ হিট হয়েছিল, সে কথা সকলেরই জানা। আজও একটি প্রজন্মের অবহেলায় অবজ্ঞায় দুঃখ ভারাক্রান্ত মন সেই গানের কাছে ফিরে ফিরে আসে। আশ্রয় চায়। কাছের মানুষদের কাছে সরোজবাবু ছিলেন কালুদা। এই কালুদার হাত ধরেই আরতির ‘বিলম্বিত লয়’ ছবির একের পর এক হিট গান। “এক বৈশাখে দেখা হল দুজানায়/ জষ্ঠিতে হল পরিচয়”—সবাই চাইছিলেন লতার কণ্ঠ। কিন্তু পরিচালকের জেদের কাছে হার মানতে হয়। রয়ে যায় এক অনন্য সৃষ্টি।

ওঁর এক সাগরেদ জয়ন্ত ভট্টাচার্য নিয়ে এসেছিলেন আরেক গায়িকাকে। কলকাতা বেতারে তখন কাজ করতেন অতন্দ্র ঘোষ দস্তিদার। তাঁর মাধ্যমেই দীনেন্দ্র চৌধুরীর পল্লীগীতির দলে একটি মেয়ের গান খুব পছন্দ হয় তাঁর। নিয়ে আসেন সুরকার বাহাদুর খানের বাড়িতে। সবারই খুব পছন্দ। কিন্তু সরোজ বাবু এঁকে দিয়ে আধুনিক গান গাওয়াতে নারাজ। বললেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াব। পল্লীগীতি গায়িকার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত পেল এক অনন্য মাত্রা। আর প্লে ব্যাকের জগতে আমরা পেলাম অরুন্ধতী হোমচৌধুরীকে। যে ছবি সরোজ দে-র কথা উঠলেই মানুষের মুখে মুখে ঘোরে, সেই ‘কোনি’ ছবিতেও সঙ্গীত-পরিচালক কাকে নিয়েছিলেন জানেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসাবে খ্যাত চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে। সরোজ বাবুর চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই এমন উলটোপথে চলত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, তা গ্রহণ করতে দর্শকের কোনও অসুবিধা তো হয়ইনি, বরং বিপুল সাফল্য পেয়েছে সেইসব কাজ।

আরও পড়ুন-বাথরুমে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল উত্তমকুমারকে! কী ঘটেছিল সেদিন

সেই সরোজবাবু ‘শঙ্খবেলা’ করছেন, নায়কের ভূমিকায় উত্তম। বেশ জটিল একটি চরিত্র। নায়কের লিপে নেপথ্যসঙ্গীতের জন্য ভেবেছেন মান্নাকে। এদিকে সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত তাঁর কালুদাকে বলেছেন, “আপনার মতো আমারও উত্তমকুমার মানেই হেমন্তের গান বড় একঘেয়ে লাগছে। বরং আমার আর পুলকবাবুর তৈরি গানগুলো কিশোরকে দিয়ে গাওয়ান। ‘বেটার রেজাল্ট’ হবে।” তাই শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতামত চাইলেন পরিচালক। গীতিকার দীর্ঘদিন এই সুযোগটিই খুঁজছিলেন। উত্তমের লিপে মান্নার একটা গান হোক— তাঁর বড় ইচ্ছা। তিনি পরিচালককে বললেন, “‘আমি আগন্তুক, আমি বার্তা দিলাম’— মান্নাদার মতো ভারতবর্ষের কোনও শিল্পীই গাইতে পারবে না।” খুব একটা ভুল যে বলেননি, তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই। মান্না দে-ই নেপথ্যসঙ্গীতে রয়ে গেলেন।

সেই গানেরই একটি অংশ খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বর্তমানে যাকে আমরা র‍্যাপ মিউজিক বলি, তার আদল এসে গিয়েছিল সেই ১৯৬৬তেই। তখন অবশ্য র‍্যাপ কাকে বলে গায়ক, সুরকার, গীতিকার, পরিচালক কেউই জানতেন না। জানার কথাও নয়। কিন্তু “মাঝখানে গোটা দুই স্টেডিয়ামে ফুটবল নেই/ সাহারার দুপুরেতে গায়ে কেন কম্বল নেই/ আল্পসের চুড়োতে উটপাখি উড়ছে/ ভদকার ডুব জলে সিগারেট পুড়ছে/ কার টুপি হল যে নিলাম”— এই অংশটিতে র‍্যাপ মিউজিকের একটা আদি ছাপ লক্ষ্য করা যায়। সেদিক দিয়ে দেখলে, উত্তমই এই জাতীয় গানের জনপ্রিয়তা বাড়ান বাংলায়। উত্তমের লিপে জনপ্রিয় ছবির গান না হলে অমন একটি ‘উদ্ভট’ গান সে সময় কতদূর চলত বলা মুশকিল।

‘দম্পতি’ ছবিতেও কমল দাশগুপ্ত এই স্টাইল ব্যবহার করেছিলেন। রবীন মজুমদারের গাওয়া ‘নীলপরী স্বপ্নে জাগালোরে জাগালো’ গানটি ইউটিউবে পাওয়া যায়। তার শুরুর অংশটুকু শুনলে দেখবেন, “নীলপরি গো নীলপরি/ স্বপ্নলোকের অপ্সরী/ বাসন্তিকার সঙ্গিনী গো কল্পলতার মঞ্জরী/ নীলপরী/ যৌবনেরই কুঞ্জবনে ছন্দ মধুর গুঞ্জরনে/ চাঁদের আলোর ঢেউ তুলে আজ মর্তে এসো রূপ ধরি/ নীলপরি”— এই অংশটা বিটের সঙ্গে র‍্যাপের মতোই গাওয়া। তবে বলাবাহুল্য কৃষ্ণাঙ্গদের যে সঙ্গীতদর্শন র‍্যাপের প্রাণ, তা এতে ছিল না, কিন্তু অধুনা বিখ্যাত ভারতীয় র‍্যাপের কোনটিতেই বা তার ছাপ রয়েছে? কেবল পোশাক পরিচ্ছদ অনুকরণটুকু ছাড়া! যাই হোক, এ ধরনের উদাহরণ বাংলা গানে সে সময়ই পাওয়া যাচ্ছে— এটা নেহাত মামুলি ব্যাপার না। বরং বাঙালির গর্ব তারা কমল দাশগুপ্ত বা সুধীন দাশগুপ্তের মতো সুরকার পেয়েছে। তবে প্রতিদানে বাঙালি বরাবরই কাতর। কমল দাশগুপ্তের মতো সুরকার বিস্মৃত বহুদিন। তাঁকে নিয়ে পরে কখনও ফের আড্ডা দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন-স্টিয়ারিং বুকে লেগে স্পট ডেথ— সিনেমায় আর ফেরা হয়নি ছবি বিশ্বাসের

‘শঙ্খবেলা’র গান নিয়ে উত্তমের খানিক সংশয় ছিল। আদৌ মান্নার গলায় গানটা চলবে কিনা তা ঠিক আঁচ করতে পারছিলেন না মহানায়ক। “কে প্রথম কাছে এসেছি” গানটা নিয়ে মামাকে বলেছিলেন, “মামা গানটা লিখেছে ভালো। কিন্তু নিজেই নিজের সর্বনাশ করেছে। ওর বন্ধু মান্না দে-কে দিয়ে গানটা গাইয়েছে। আমার গলার সঙ্গে মান্না দের গলা মিলবে না, গানটা মার খাবে।” অথচ সে বছরই সত্যজিতের পরিচালনায় ‘নায়ক’ করছেন উত্তম। এইখানে তাঁর ভিতরের টানাপোড়েনের একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গ্ল্যামার ছেড়ে বিনা প্রসাধনে বসন্তের দাগ মুখে যিনি অভিনয় করতে রাজি হচ্ছেন, রাজি হচ্ছেন গ্ল্যামারকে বিনির্মাণ করতে, প্রায় একই সময়ে তিনি মান্নার গলা তাঁর সঙ্গে মিলবে না, অর্থাৎ পাবলিক যা শুনতে অভ্যস্ত, তা শুনতে না পেয়ে গানটা চলবে না বলে আশঙ্কা করছেন। এইখানেই অরিন্দমের পর্দার বৃত্ত ছাড়িয়ে উত্তম খোদ ট্র্যাজিক নায়ক।

পুলকবাবু ভরা সভায় সে কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন বটে। তবে পরিচালক বসেছিলেন গীতিকারের পাশেই। কানে কানে বললেন, “যা খুশি বলুক, শুনবেন না। গান হিট করবেই।” সেবার কার কথা ফলে গিয়েছিল, তা আর নাই বা বললাম। তার নজির পরের ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-র গানগুলোতে রয়েছে গিয়েছে। চিরকালীন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বাংলা ছায়াছবির গানের ইতিহাসে সে এক নতুন মোড়। এবং যার কৃতিত্ব কেবল এবং কেবলমাত্র সরোজ দে ওরফে কালুদার। ফের সময়ের নিরিখের ব্যাপারটা খানিক আসে। একটা সময়ে জনস্রোত যাঁকে ‘পাগল’ বলে, সেই দলছুট যে কত বড় মাইল ফলক রেখে যাচ্ছেন, তা বোঝে আগামী। আদতে আগামীর জন্যেই তো পায়ের ছাপ রেখে যাওয়া। সে যতটুকুই হোক না কেন! বর্তমান আত্মকেন্দ্রিক হলে বিচারের খাতায় অতীতের যে বাকির ঢের জমে উঠবে! সেই ঋণ সে শুধবে কীসে? ভেবে দেখুন, আমাদের যা কিছু অর্জন, যেগুলি মানুষের স্বীকৃতি পেয়েছে, সবই তো অতীতের। বর্তমান গড়ায় অতীতে। তাই দোষারোপ থাক। বরং চেষ্টা হোক অতীতের দূরত্ব কমানোর! তাতে সোনার সেঁউতিও মেলে, দুধভাতের অভাবও আর তেমন ফোটে না।

 

তথ্যঋণ-

কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায়

More Articles