ট্রেন্ডিং ভেগান লাইফস্টাইল! জানেন শরীরে বাদ পড়ে যাচ্ছে কোন কোন জরুরি পুষ্টি?

Vegan: ভেগানদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, লং-চেইন ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়োডিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং জিঙ্ক থাকে না

আমিষ নিরামিষের দ্বন্দ্ব চিরকালীন। আর বাঙালি তো চিরকালই মাছে ভাতে। রবিবারে পাঁঠার মাংস কবজি ডুবিয়ে না খেলে ভাত হজম হয় না। কিন্তু সম্প্রতি এই মাছে-ভাতের আমিষ বাঙালিও নাকি ভেগান হয়ে যাচ্ছে। পাবদার তেল ঝাল বাদ, বিরিয়ানি, পেস্ট্রি, বার্গার সব বাদ। নিরামিষে দুধ-পনির-ছানার কোফতা কালিয়াও পছন্দ নয় এখন! খাদ্যরসিক বাঙালি শেষে কী না ভেগান! ১ নভেম্বর, ২০২২ ‘বিশ্ব ভেগান দিবস’। ‘ভেগান’ শব্দটার সঙ্গে কিন্তু কয়েক বছর আগেও কল্লোলিনী কলকাতার পরিচয় ছিল না। ভেজিটেরিয়ান বা শাকাহারী বলতে সকলেই বুঝি। কিন্তু ভেগান বা ইংরেজিতে যাকে উচ্চারণ করা হয় ‘ভিগান’ নামে, সেটা আবার কী? একটা সময় এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেত আম বাঙালির মাথায়। বাড়িতে হয়তো কোনও অতিথি আসার কথা। আপনি জানেন যে তিনি শাকাহারী, মানে মোটেই মাছ-মাংস খান না। স্বাভাবিক ভাবেই ডাল, পনির বা ছানার কোনও জমাটি পদ রঁধে রাখলেন। পরে জানতে পারলেন আপনার অতিথি ভেগান, তখন তো মাথায় হাত! খেতে দেবেন কী? কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য। ভিগানিজম নিয়ে সারা বিশ্ব মাতামাতি করছে। আন্দোলন-বিপ্লব চলছে। পিছিয়ে নেই মহানগরীও। কলকাতার আনাচ কানাচে এখন ভেগানদের ছড়াছড়ি।

প্রথম কীভাবে এই ভেগান নামের জন্ম?

আধুনিক যুগে প্রথম ভেজেটারিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৭ সালে, ইংল্যান্ডে। তার মাত্র তিন বছর পর, গ্রাহাম ক্যাকার্সের উদ্ভাবক সিলভেস্টার গ্রাহাম ‘আমেরিকান ভেজেটারিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসবিটারিয়ান মন্ত্রী হওয়ায় তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল অনেক। সেই সুবাদে আমেরিকা সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বেশ দ্রুতই ভেজেটারিয়ানিজমের জয়জয়কার শুরু হয়। এরপর প্রায় এক শতাব্দী পর, ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ডের কাঠমিস্ত্রি ডোনাল্ড ওয়াটসন ‘ভেগান সোসাইটি’ নামের নতুন একটি সংস্থা তৈরি করেন।

ভেগান কী, উপকারিতাই বা কী?

শুধুমাত্র শাকসবজি যাঁরা খান তাঁদের ভেজিটেরিয়ান বলা হয় এই কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু Vegan শব্দটির অর্থ অনেকটাই অজানা। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের অনেকের মত, দীর্ঘজীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে নিরামিষ খাবারের মধ্যে। আবার অনেকের মত প্রাণীজ প্রোটিন না খেলে শরীরের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি হয়। নিরামিষ আমিষের এই দ্বন্দ্ব শতাব্দী প্রাচীন। নিরামিষাশীরা যখন প্রাণীজাত সমস্ত খাবারের সঙ্গে আড়ি করেন, তখন তাদের বলে ভেগান- এমনই বললেন নিউট্রিশনিস্ট ইন্দ্রাণী ঘোষ। অর্থাৎ শুধু মাছ মাংস নয় ভেগানরা ডিম, দুধ আর দুধের যে কোনও খাবার যেমন ছানা, দই, পনির, সন্দেশ, রসগোল্লাও খান না। এমনকি, উল, চামড়া বা সিল্কের পোশাকও পরেন না। প্রাণী এবং পরিবেশ বাঁচাতেই তাঁদের এই উদ্যোগ। ভেগান ডায়েট প্রসঙ্গে পুষ্টিবিজ্ঞানের শিক্ষক সুস্মিতা ঠাকুর জানালেন, প্রচুর ভিটামিন মিনারেলস ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ ভেগান ডায়েট বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার, টাইপ টু ডায়াবিটিস, হার্টের অসুখ, ওবেসিটি, হাই ব্লাড প্রেশারের মতো অসুখ প্রতিরোধ করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিচ্ছে।

আরও পড়ুন- ‘বিগ ফ্যাট ওয়েডিং’! সাধ্য না থাকলেও কেন সাধের মায়ার ফাঁদে পড়ছেন মধ্যবিত্তরা

কয়েক দশক আগে থেকে ভিগানিজমের প্রচলন শুরু হলেও ২০১০ সালে জাতিসংঘের রিপোর্টে ভিগানিজমের কথা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিশ্বের বহু প্রান্তে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে থাকে এই জীবনশৈলী। ২০১০ থেকে ১ নভেম্বরকে ‘Vegan Day’ হিসেবে পালন করা শুরু হয়। আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা গেছে, শাক সবজি, ফলে থাকে বিভিন্ন ফাইটোকেমিক্যালস (উদ্ভিদে থাকা বিশেষ প্রাকৃতিক রাসায়নিক যা বিভিন্ন রং ও গন্ধ সৃষ্টি করে)। বিভিন্ন ফল ও সবজিতে প্রায় ৪,০০০ ফাইটোকেমিক্যালস পাওয়া যায় যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, যেমন টমেটো, তরমুজ, গাজর, আম, জাম, পালং শাক শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ভারতেও এই ডায়েট ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। খাদ্য তালিকায় মাংস না থাকাটা নতুন কিছু নয়। আজ থেকে আড়াই হাজারের বেশি সময় আগে প্রাচীন ভারতে এই চর্চা ছিল। এ ছাড়া ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতেও এমন প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। কলিন স্পেনসার তাঁর বই ‘ভেজিটেরিয়ানিজম: আ হিস্ট্রি’ গ্রন্থে ভারতে নিরামিষ আহারের শুরুর দিকের ঘটনা বলেছেন।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ড-সহ বহু দেশে নানা দেশে Vegan খাদ্যাভ্যাস খুবই জনপ্রিয়। বিশ্ব জুড়ে সেলেবদের মধ্যে বাড়ছে Vegan হওয়ার প্রবণতা। পশুপ্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি, পরিবেশগত ভারসাম্য যদি এর নেপথ্য কারণের একটি দিক হয়, অন্য দিক অবশ্যই শারীরিক। সম্পূর্ণ উদ্ভিজ্জ খাবারেই উপর নির্ভরতাই Vegan Diet।

সেলিব্রিটিদের ভেগান ডায়েট

সেলেবদের জীবন-চর্যা নিয়ে সাধারণের কৌতূহলের শেষ নেই। তাঁদের মতো চেহারা, সাজ পোশাক সব কিছু অনুসরণ করতে মানুষের জুড়ি মেলা ভার। সেলেবদের লাইফস্টাইল নিয়ে মানুষ যেমন আগ্রহী তেমনই তাঁরা কী কী খেয়ে নিজেদের চেহারা ধরে রাখেন তা জানতেও কৌতূহলের বিরাম নেই। পছন্দের সেলেবরা যা খান তাই আমাদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সারা বিশ্বের বেশিরভাগ সেলিব্রিটিই এখন ভেগান ডায়েট অনুসরণ করার পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, ভেগান ডায়েট অনুসরণ করে তাঁরা আগের থেকে আরও বেশি সুস্থ আছেন। ভারতেও এমন কিছু সেলেব রয়েছেন যাঁরা ভেগান ডায়েট মেনে চলেন।

বিরাট কোহলি ও অনুষ্কা শর্মা - ভারতীয় ক্রিকেটার কোহলি এবং অভিনেত্রী অনুষ্কা দু’জনেই এই ভেগানদের তালিকায় নিজেদের নাম জড়িয়েছেন বহুকাল আগে। তাঁদের মতে, তাঁরা দু’জনেই এখন সম্পূর্ণ ভেগান। বিরাট কোহলি আরও জানিয়েছেন, খেলোয়াড় বলেই যে তাঁকে ফিট থাকার জন্য প্রাণীজ প্রোটিন খেতে হবে সেই ভ্রান্ত ধারণা তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। ভেগান ডায়েট অনুসরণ করেও যে ‘ফিট অ্যান্ড ফাইন’ থাকা যায় তা তিনি সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

সোনাক্ষী সিনহা - বলিউডের দাবাং গার্ল সোনাক্ষী সিনহাও ভেগানদের দলে নাম দিয়েছেন। তাঁর মতে, এই ডায়েট গ্রহণ করার পর থেকে তিনি নিজেকে আরও ফিট মনে করছেন। তিনি আরও জানান, সম্পূর্ণ ভেগান খাবার খাওয়ার পর থেকে তাঁর বিপাক ক্রিয়া উন্নত হয়েছে এবং ওজন কমাতেও সাহায্য করেছে।

সোনম কাপুর – বলিউড ফ্যাশন আইকন সোনম কয়েক বছর আগেই ভেগান ডায়েট অনুসরণ করা শুরু করেছেন এবং তখন থেকেই তিনি এই ডায়েট নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি PETA-র ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ খেতাবও জেতেন। ভেগান ডায়েটের ক্ষেত্রে তাঁর মত, যেহেতু পশুর দুধ বা দুগ্ধজাত কিছু এই ডায়েটে স্থান পায় না তাই তিনি বিকল্প রাস্তা হিসেবে দুধের বদলে সোয়া বা বাদাম দুধের কথা বলেছেন।

এই তারকারা ছাড়াও বলিউডের আরও অনেকেই ভেগান ডায়েট মেনে চলেন।

অপকারিতা

জাপান ও ইতালির বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জেনেছেন, ভেগান ডায়েট সবার জন্যে উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে প্রাণীজ প্রোটিনের অভাবে শরীরে ভিটামিন বি-১২ এর অভাবজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে বাচ্চাদের। তাই তাঁদের মতে, আমিষ-নিরামিষ মিলিয়ে খাওয়াই ভাল। নিরামিষ ও ভেগান ডায়েট প্রসঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন পুষ্টিবিদ ইন্দ্রাণী ঘোষ। তাঁর কথায়, ভেগান ডায়েট করলে সয়াবিন খেতেই হবে। কেননা শরীরের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ক’টি অ্যামাইনো অ্যাসিড (প্রোটিনের মূল উপাদান উপাদান) থাকে সয়াবিনে। কিন্তু ভিটামিন বি-১২ থাকে না। ভেগান ডায়েটে যাঁরা মানিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের ৮৩% ভিটামিন বি-১২ এর অভাবজনিত সমস্যায় ভোগেন। তাই যাঁরা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খান না, তাঁরা অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন বি-১২ সাপ্লিমেন্ট খাবেন। ভিটামিন বি-১২ রক্ত তৈরি ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। তাই ভেগান ডায়েট করলে অ্যানিমিয়ার পাশাপাশি স্মৃতি শক্তির ঘাটতি হতে পারে।

ভারতে ভেগান ডায়েটের ধারণাটি একেবারেই নতুন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ভেগানদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি ১২, ভিটামিন ডি, লং-চেইন ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, আয়োডিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং জিঙ্ক থাকে না। তাই ঝোঁকের বশে ‘সবাই খাচ্ছে তাই আমিও খাব’ ভাবটা করবেন না। পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুসারে কাজ করুন।

আরও পড়ুন- বিশ্বে প্রথম সফলভাবে সোনালি চালের উৎপাদন! কতটা বদলে যাবে খাদ‍্যাভ‍্যাস

আবার অনেকেই চিরাচরিত বাঙালি ধ্যান-ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁদের মতে, বাঙালি হয়ে জন্মেছি, মাছ মাংস খাব না এটা হতে পারে! টলিউড অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী সম্প্রতি ভেগান ডায়েটে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তাঁর কথায়, “প্রথমে আমার বাড়ি থেকে কেউ রাজি ছিল না যে আমি মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ভেগান হয়ে যাই। তাঁদের কথায় বাঙালি বাড়ির মেয়ে আমি। আমি যেন সেই মাছ মাংস খেয়েই বড় হই এটাই তাঁদের দাবি।” আবার অনেক পুষ্টিবিদ পুরোপুরি ভেগান ডায়েটকেও সমর্থন করছেন না। তাঁদের মতে, ডায়েটে যদি একটা ভারসাম্য থাকে তাহলে শরীরে যথাযথ পুষ্টি ঢোকে। যদি শুধু আমিষ বা শুধু নিরামিষ অর্থাৎ উদ্ভিজ্জ আহার গ্রহণ করা হয় তাহলে শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

অনেকের মতে, আমিষাশীরা যে প্রাণীজ প্রোটিন মাছ, মাংস বা ডিম থেকে পান সেই কারণে প্রাণীদেরকে যথেচ্ছভাবে হত্যা করা হয়। তাই তাঁরা প্রাণী হত্যার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভেগান ডায়েটের দিকে ঝুঁকেছেন। ভেগান ডায়েট শুধু শারীরিক ভাবে ভালো থাকার পন্থা নয়, প্রায় এক বিপ্লবের আকার নিয়েছে। সকলেই কম বেশি সেই আন্দোলনে যোগদান করছেন।

তবে মত-বিমত থাকলেও ভেগান ডায়েট যে পরিবেশ রক্ষায় আগ্রহী তা বলতেই হয়। যেহেতু ভেগান ডায়েটে শাকসবজি-আনাজই থাকে, তাই গাছও লাগাতে হয় বেশি পরিমাণে। সবুজ বাঁচাও অভিযানের যা বড় পদক্ষেপ। এর ফলে পরোক্ষ ভাবে গ্রিন হাউস গ্যাসের কুপ্রভাব রোখা সম্ভব হয়। উপকার অপকার যাই থাক না কেন, বাঙালি হোক কী অবাঙালি মুখে কোন খাবারের স্বাদ ভালো লাগছে, কোন খাবার সুস্থ রাখছে সেটাই বেশি জরুরি। তাই ভালো খান, সুস্থ থাকুন।

More Articles