বিনায়ক লোহানী

মধ্যপ্রদেশের ভোপালে জন্ম হয় বিনায়ক লোহানীর।ভোপালেই নিজের স্কুলের গন্ডি পার করেন তিনি। তবে পূর্বে তার পরিবারের বসবাস ছিল উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুন অঞ্চলের আলমোড়া জেলায়। তাঁর বাবা ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (IAS) -এর এমপি ক্যাডারে কর্মরত ছিলেন। ভোপালে নিজের স্কুলের গন্ডি পার করে বিনায়ক লোহানী বি.টেক (B.Tech) -এর জন্য ভর্তি হন আইআইটি (IIT) খড়্গপুরে। সেখান থেকে বি.টেক পাশ করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে যোগদান করেন তিনি। সেখানে ১ বছর যুক্ত থাকার পর সেটি ছেড়ে ফের নিজের পড়াশুনা শুরু করেন বিনায়ক। ২০০১ সালে কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (IIM)-এ ভর্তি হন এমবিএ (MBA) -এর জন্য। ২০০৩ সালে এমবিএ শেষ করে প্লেসমেন্টের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি শুরু করেন তার নিজের সংস্থা 'পরিবার'।

একটি ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে মাত্র ৩ জন শিশুকে নিয়ে বিনায়ক লোহানী শুরু করেছিলেন তাঁর সংস্থা 'পরিবার'। তাঁর এই সংস্থা গড়ে তোলার পিছনে ছিল তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। দরিদ্র শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই তিনি শুরু করেছিলেন তার এই সংস্থা। ২০০৪ সালের শেষের দিকে নিজের সংস্থার জন্য জমি কেনেন বিনায়ক লোহানী। ঐ জমিতেই গড়ে তোলেন পরিবারের প্রথম ক্যাম্পাস ---- 'পরিবার আশ্রম'। এরপরেই আস্তে আস্তে শুরু হয় পরিবারের পথ চলা। ২০১১ সালে মেয়েদের জন্য এবং ছেলেদের জন্য তৈরী হয় আলাদা ক্যাম্পাস। মাত্র ৩ জনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল বিনায়ক লোহানীর 'পরিবার', সেটি ২০১৮ সালে গিয়ে পৌঁছয় ২০০০ জনে। ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ২০০০-এর ও বেশি শিশু লোহানীর পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে ; এবং 'পরিবার' পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র স্তরের শিশুদের জন্য সবচেয়ে বড় এবং উচ্চমানের আবাসিক কর্মসূচিতে পরিণত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ২০১৬-১৭ সালে মধ্যপ্রদেশেও কাজ শুরু করে পরিবার। শুরু হয় ২৪৮ দিনের বোর্ডিং ( বিনা পয়সায় খাওয়া এবং শিক্ষা) দরিদ্র উপজাতি শিশুদের জন্য ; এবং ঐ প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ হয় 'শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সেবা কুটির'। বিনায়ক লোহানী স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক ও মানবতাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ; এবং সেই কারণেই তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয় রামকৃষ্ণদেব ও স্বামীজীর নামে। দেওয়াস, সিহোর, মন্ডলা, শেওপুর, ছিন্দওয়ারা, খান্দওয়া, বিদিশা এবং দিন্দোরি জেলায় শুরু হয় লোহানীর এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। তাঁর এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শিশু বিনা পয়সায় খাবার পাচ্ছে (সকালের জলখাবার এবং রাতের খাবার), পাশাপাশি শিক্ষাও পাচ্ছে ওই সমস্ত শিশুরা।

পশ্চিমবঙ্গের সন্দলপুরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন বিনায়ক লোহানী। ঐ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০০ জন শিশু থাকতে পারবে। এই মুহূর্তে কাজও শুরু হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে বাড়ানো হবে সন্দলপুরের ঐ প্রতিষ্ঠানটি।

এই মুহূর্তে বাংলায়, 'পরিবারে'র দুটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে - ছেলেদের জন্য "পরিবার বিবেকানন্দ সেবাশ্রম" এবং মেয়েদের জন্য "পরিবার সারদা তীর্থ"। ২১০০-এর ও বেশি শিশু পরিবারের সদস্য।৫ বছর বয়স থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েদের জন্য প্রেমময় ও যত্নশীল পরিবেশে বিনায়ক লোহানীর 'পরিবার' শিক্ষা ও সার্বিক শিশু বিকাশের সকল সুযোগ প্রদান করে আসছে।

এছাড়াও মান্ডলাতে ১৫০ জন শিশুর জন্য গড়ে তোলা হয়েছে দুটি হোস্টেল।ছেলেদের হোস্টেলটির নাম 'পরিবার বিবেকানন্দ বিদ্যার্থী সদন' এবং মেয়েদের হোস্টেলটির নাম 'পরিবার ভাগিনী নিবেদিতা সদন'। পাশাপাশি দিওয়াদিয়া গ্রামে সিহোর জেলায়ও একটি হোস্টেল গড়ে তোলা হয়েছে ২০টি মেয়ের জন্য।

পরিবারকে আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দেখাশোনা এবং দুর্বল শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি মডেল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়।২০১১ সালে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শিশু কল্যাণের জাতীয় পুরস্কার (National Award for Child Welfare) লাভ করে লোহানীর পরিবার।

একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিনায়ক লোহানী জানিয়ে ছিলেন, "আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর আজ দেখুন আমার কত বড় পরিবার আছে আমার পাশে"। এর পাশাপাশি তিনি বলেন, "আইআইএম কলকাতার ইতিহাসে আমিই একমাত্র ছিলাম, যে চাকরির জন্য প্লেসমেন্ট না নিয়ে বেরিয়ে এসেছি"! এরপর হেসে লোহানী আরও বলেন, "আমি বরাবরই সামাজিক জায়গায় কিছু করতে চেয়েছিলাম।আমি কর্পোরেট ক্যারিয়ারে আগ্রহী ছিলাম না। সেই কারণেই চাকরি না করে নিজের সংস্থা গড়ে তুলেছি।"


ঐ সাক্ষাৎকারেই লোহানী আরও বলেন, "মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ভালো ছাত্র হওয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এমবিএ করাটা একটি খেলাপ। এরপর তিনি স্মরণ করেন বলেন, মূলধারার চাকরি এবং কর্পোরেট পরিবেশের চাকরিতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলাম। সেই জন্যই ঐ জায়গা থেকে সরে এসেছিলাম"।

তিনি বলেন, "বরাবরই আমি স্বামী বিবেকানন্দের কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি সবসময় সমাজের পরিবর্তনের প্রতিনিধি এবং ত্যাগ, সেবা এবং ভক্তির অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি, বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দের। রামকৃষ্ণ মিশন থেকেই আমি দীক্ষা গ্রহণ করেছি। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে অনেক সময়ও কাটিয়েছি আমি"। এরপর লোহানী বলেন, "আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকার হিসেবে মাদার টেরেসা-র প্রভাব ছিল প্রবল। আমি নিজের শহরে ফিরে যাওয়ার কোন গতি খুঁজে পাইনি।আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা কলকাতা-কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। সেই জন্যই কলকাতায় নিজের প্রতিষ্ঠান 'পরিবার'কে গড়ে তুলেছি সর্ব প্রথম"।

'পরিবার' আজ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা বিনা পয়সায় শিক্ষা পাচ্ছে, এ সমস্ত সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র বিনয়ক লোহানীর উৎসাহের কারণে পাশাপাশি বদলে গেছে ঐ সমস্ত দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের জীবনও। অনেক ছেলে-মেয়ে রয়েছে যারা শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনেকটা এগিয়ে গেছে, স্কুল-কলেজের জীবন পার করে তারা পৌঁছে গেছে ইউনিভার্সিটি-তে।

নিজের 'পরিবার' সম্বন্ধে বিনায়ক লোহানী জানান, আমার লক্ষ্য পরিবারকে দেশের সর্ববৃহৎ বিনামূল্যে আবাসিক বিদ্যালয়ে রূপান্তর করা |

 

তথ্য সূত্র : লেখক এর নিজস্ব সংগ্রহ

More Articles