হাসিমুখে ভাতের থালা হাতে অফিস পাড়ার নন্দিনী, নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে কেন বেছে নিলেন এই পথ

Pice hotel Nandini Ganguly : নিশ্চিন্ত চাকরি ছেড়ে বাবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাইস হোটেল চালাচ্ছেন মমতা

চৌকো করে কাটা কলাপাতা, তাতে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। সঙ্গে আলুভাজা, বেগুন ভাজা, করলা ভাজা, ডাল, সবজি। ভরপেট থালি মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকায়। চাইলে কেউ জুড়ে নিতে পারেন মাছ, মাংস, ডিম। মোট কথা জলের দরে পেটচুক্তি আহার। হাসিমুখে পসরা সাজিয়ে রয়েছেন মমতা। বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, গঙ্গোপাধ্যায়। অফিস পাড়ার পরিচিত মুখ এখন ইনিই। পরনে জিনস্ আর কালো টপ। গলায় ঝুলছে ব্লু টুথ স্পিকার। শিক্ষিতা, আধুনিক তরুণী। ডালহৌসি চত্বরে সবাই চেনেন ‘ম্যাডাম’ নামে। দুপুরে খিদের মুখে ম্যাডাম থেকে ইনিই রোজদিন হয়ে উঠছেন ঘরের মেয়ে। ভাত বেড়ে খেতে দিচ্ছেন মা-জেঠু-কাকুদের।

ছাপোষা একটা ভাতের হোটেল। কলকাতা জিপিও-এর ঠিক উল্টো ফুটে। মাথার ওপর পাকা ছাউনি অবধি নেই। অথচ উপচে পড়ছে ভিড়। ‘একটা মাংস ভাত’ অথবা ‘ভেজ থালি একটা’ এমন অজস্র হুকুমের চটজলদি জোগান সেখানে। যদিও শুধু এটুকু পরিচয় দিলেই গল্প ফুরোয় না। মমতা গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে নন্দিনীর গল্প আরও অনেকটা।

আরও পড়ুন - তারুণ্যে হার মানবে নামজাদা রেস্তোরাঁ, কলকাতার এই পাইস হোটেল ১০৭ বছরের বিস্ময়

‘রক্তকরবী’র নয়, আমার আপনার ঘরের মেয়ে নন্দিনী। নন্দিনী নামটা আদরের ডাকনাম। খাতায় কলমে নাম মমতা। বয়স মেরেকেটে সাতাশ আটাশ। পড়াশোনা করেছে ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে। চাকরিও করত ব্যাঙ্গালোরে। অথচ সেসব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এখন এক চিলতে একটা ভাতের হোটেলেই রুজিরুটি। কিন্তু কেন হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত নিল নন্দিনী? শুনতে রূপকথা মনে হলেও এই নন্দিনীর গল্পটা ঘোর বাস্তব। হঠাৎ করেই আলোর খুব কাছাকাছি উঠে এসেছেন যিনি। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় বলতে গেলে, এখন ভাইরাল নন্দিনী ওরফে মমতা। ভাইরাল তার এক চিলতে ভাতের হোটেলটিও। ভেজ থালি ৩০, দুরকম বাড়তি ভাজা নিলে দাম বেড়ে হয় ৪০। চারা পোনা মাছ ভাত ৭০, রুই নিলে ৮০। আর চিকেন ১০০, মাটন ভাত ২০০ টাকা।

বাবা-মা-মেয়ে, তিনজনের অফিস পাড়ায় ছোট্ট গোছানো সংসার এই হেঁশেল। সকাল নটা থেকে শুরু হয়ে যায় রান্নার তোড়জোড়। নিজের হাতে রোজদিন বেলেঘাটা থেকে বাজার করেন নন্দিনীর বাবা চক্রধারী গাঙ্গুলি। মা বিনাদেবী থাকেন কোটা বাটার দায়িত্বে। এরপর মাঠে নামে মমতা। রান্নায় বাবার সঙ্গে হাত লাগায় সে। তারপর নিজে হাতে ভাত বেড়ে খেতে দেন সকলকে। করোনায় রবারের ব্যবসা ডুবে যায় নন্দিনীর বাবা। নন্দিনী তখন রাজ্যের বাইরে। সংসার চালানোর দায় হয়ে উঠছে দেখে বাধ্য হয়েই অফিস পাড়ায় এসে এক চিলতে দোকান খোলেন চক্রধারীবাবু। নন্দিনী বাদে বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। ফলে দোকানের দায়-দায়িত্ব সবই সমলাতে থাকেন স্বামী স্ত্রী মিলে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন স্ত্রী বিনা গাঙ্গুলি। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরে নন্দিনী। ব্যাস গল্পটা ঠিক এরকম হয় হয়তো আজকের এই ছবিটার সাক্ষী হতে পারতাম না আমরা কেউই। গল্পের মোড় বদলের শুরু ঠিক এর পর থেকে।

বাবা মায়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দোকান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন নন্দিনী। নিশ্চিন্ত চাকরির মায়া ত্যাগ করে কঠিন জোয়াল তুলে নেয় কাঁধে। নন্দিনীর কথায়, “আমাদের জীবনে সামনের মানুষটি একবার পিছন থেকে বলতে হয়, এগিয়ে যাও, আমি আছি সঙ্গে। এটুকুই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট। আমিও শুধু এটুকু ভরসায় দিতে চেয়েছিলাম বাবাকে। ভাইরাল হওয়ার কথা তো দিন পনেরো আগেও ভাবিনি।”

আরও পড়ুন - জলের দরে ‘পেটচুক্তি’ খাওয়া, কলকাতার এই পাইস হোটেলগুলিতে জেগে স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প

হ্যাঁ ঠিকই, জীবনের চাকা ঘোরানোর জন্য নেপথ্যে যিনি বসে আছেন তাঁর খবর আমরা কেউ রাখিনা। কিন্তু আমরা কাজ করি। ভালো কাজ,ভালকিছু ফিরিয়ে দেবে এমনটাই তো কাম্য। নন্দিনী তাই ব্যতিক্রম নন। আবার ব্যতিক্রমও। ব্যস্ত অফিস পারে যেখানে একের পর এক পুরুষ দোকানিদের ভিড় সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সে। ছক ভাঙছে এভাবেই। সে মনে করে না পুঁথিগত বিদ্যা কেবল অফিসের দরজায় শেষ হয়, বরং বিশ্বাস করে সেই শিক্ষা জীবনের। যা পথ চলতে শেখায়। লড়াই করতে শেখায়। নন্দিনী নিজে মুখেই বলে, “আমি খুব ভালো করেই জানি আজকের এই যে ফেম, তা যেমন হুট করেই এসেছে ঠিক তেমনই আবার হুট করেই চলে যাবে। থেকে যাবে কেবল রোজকার লড়াইটা। আর আমাদের এই ভাতের হোটেলটা। তাই লড়াইয়ের ময়দানে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেই হবে।”

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে নন্দিনীর মতো মেয়েরা সত্যিই উদাহরণ। যে ভেঙে পড়া সমাজের চোখে চোখ রেখে শিখিয়ে দিচ্ছে এর নাম আসল লড়াই। ছোট্ট একটা স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেই পথ চলা যায়। রাতারাতি ভাইরাল হওয়া নন্দিনী তাই দিনের শেষে অফিস পাড়ার অন্নপূর্ণা। গরম কড়াইয়ে মাছ ভাজতে দিয়েই সে খোঁজ নিচ্ছে কারোর ভাত লাগবে কিনা। ফাঁক পেলেই এসে খুন্তি নাড়ছে, পাই পয়সার হিসেব রাখছে, আবার হাসি মুখে সামলাচ্ছে ক্রেতাদের ভিড়। এই মমতা ওরফে নন্দিনীদের বড্ড প্রয়োজন বর্তমান সময়ের। প্রয়োজন প্রতিটি পরিবারের। “কুছ পরোয়া নেই, এগিয়ে যাও, সঙ্গে আছি”, এই ডাকটুকুই তো জীবন বদলের জন্য যথেষ্ট।

More Articles