অর্জুন সিংকো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায়? 'ঘর ওয়াপসি' না অন্য কারণ?

 

দু'টি বহুচর্চিত কথা, প্রথমটি, 'রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প'৷ আর দ্বিতীয়টি, 'রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই'৷ বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের সাম্প্রতিক আচরণ এই দু'টি আপ্তবাক্যকেই প্রতিষ্ঠিত করছে৷

দ্বিতীয় বাক্যটি রাজনীতিকদের এধার থেকে ওধার যাওয়ার পথ অনেকটাই সুগম করে৷ যেন যখন খুশি দল বদল করার লাইসেন্স দিয়েছে এই লাইনটি৷ নীতি-টিতি এখানে গৌণ৷

আর রাজনীতি যখন 'সম্ভাবনার শিল্প', তখন অন্য পাঁচটা শিল্পকর্মের মতো 'রাজনৈতিক সম্ভাবনা' নামক 'শিল্পকর্ম'-টিকেও গড়ে তুলতে হয় আস্তে আস্তে৷ এটা খুব সহজ কাজ নয়। অর্জুনবাবু এখন সেই কাজটাই করছেন৷ বিজেপির এই সাংসদ নিজে গুটি গুটি পায়ে 'লক্ষ্যের' দিকে এগোলেও, ঝড়ের বেগে বার্তা ছুটেছে, অর্জুন সিং ফের তৃণমূলমুখী৷ যে কোনওদিনই এই ঘটনাটি ঘটে যেতে পারে৷

আরও পড়ুন: দূরত্ব বাড়াচ্ছে দল, পিছু ছাড়ছে না সিবিআই || কী হতে চলেছে অনুব্রতর ভবিষ্যৎ?

কেন এমন ধারণা হচ্ছে রাজনৈতিক মহলের? এই প্রশ্নের উত্তর আছে৷ সেই উত্তর আনুমানিক নয়৷ একবার দেখা যাক, গত কয়েকদিন ধরে ঠিক কী কী বলেছেন আপাতত বিজেপি-র এই 'বাহুবলী' সাংসদ।

১) "আন্দোলন চলবে। যতক্ষণ না পাই, ততক্ষণ আন্দোলন চলবে। ওই সব ললিপপ নিয়ে আমি রাজনীতি করি না। বহু ললিপপ আমি দেখেছি। শেষে গিয়ে সব ধরাশায়ী হয়ে যায়। কেন্দ্র সুরাহা না করলে, ব্যাপক আন্দোলন হবে। দলের বিরুদ্ধে, না কি দলের পক্ষে সেসব পরের কথা। রাস্তায় নামব, এটা নিশ্চিত।"

২) "মুখ্যমন্ত্রী ডাকলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করব।"

৩) "পীযূষ গোয়েল আকাশ-পুত্র, আমি ধরিত্রী-পুত্র। আল্টিমেটাম দিয়েছি। দাবি না মানলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই আন্দোলনে নামব। মানুষ আমাকে সাংসদ বানিয়েছে।"

৪) "আগামী ৯ মে পাটশিল্পের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনায় ত্রিপাক্ষিক বৈঠক আছে। সমস্যা মিটলে খুশি হব৷ না মিটলে আন্দোলনে নামব। কেন্দ্রীয় নীতির বিরুদ্ধে আমার লড়াই। শেষ দেখে ছাড়ব। শ্রমিকদের জন‌্য সব কিছু করতে রাজি।"

৫) "আমি সিএমকে চিঠি লিখছি৷ আমার এখানে অনেক ভোটার আছে যারা জুটমিলের সঙ্গে যুক্ত, তারা বঞ্চিত হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতেই হবে বিষয়টি।"

৬) "কেউ যদি ভাবে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি এটা করছি, তাহলে তারা তা ভাবতেই পারে। আমার কিছু যায় আসে না। রাজনীতিতে কিছুই অপরাধ নয়। কোনও রাজনৈতিক কর্মীর যদি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকে তাহলে তিনি রাজনৈতিক কর্মীই নন।"


এই মন্তব্যগুলি বিজেপি-বিরোধী কোনও নেতা বা সাংসদের হলে, সেভাবে হয়তো খবরই হত না৷ কিন্তু বক্তা যেহেতু গেরুয়া শিবিরের দাপুটে সাংসদ অর্জুন সিং, তাই এসব কথা শোরগোল তুলবেই৷ এবং একই সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা তৈরি হতে শুরু করেছে৷ বারাকপুরের সাংসদের 'বোলবদল'-এর সঙ্গেই তাঁর ‘ভোলবদল'-এর জোরদার চর্চা খুবই স্বাভাবিক ৷

প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রক এবং জুট কর্পোরেশন কাঁচা পাটের দামের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে। যার ফলে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে কৃষকদের। এই অভিযোগই করেছেন বিজেপি সাংসদ। অর্জুন সিং বলেছেন, কাঁচা পাটের দামের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদল করা না হলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই পথে নামবেন। রাজ্য বিজেপিতে এমনিতেই ডামাডোল৷ তার মাঝেই বেসুরো বারাকপুরের বিজেপি সাংসদ।


ওদিকে তৃণমূলের তরফেও এখনও পর্যন্ত এমন কিছু বলা হয়নি, যাতে রাজনৈতিক মহলের ধারণা হয়, অর্জুন সিং-কে দলে ফেরানো হবে না৷ দিনকয়েক আগে অর্জুন যখন পাট-ইস্যুতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন তখন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এ-প্রসঙ্গে বিজেপি সাংসদের নাম না করে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, "হঠাৎ যারা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে চলে গিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আজ বুঝতে পারছেন, পাট শিল্প বলুন বা অন্য কিছু, বাংলার স্বার্থে, বাংলার দাবিতে, বাংলার সমস্যার সমাধানে, দিল্লির বিজেপি বন্ধু নয়!" এখানেই শেষ নয়৷ চটকলের সমস্যা নিয়ে জুট কমিশনারের অফিসে আন্দোলনের যে কর্মসূচি তৃণমূল নিয়েছে, তাকেও সমর্থন করেছেন বিজেপি'র এই সাংসদ। এ-বিষয়ে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, "উনি কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন, তা নিয়ে কিছু বলব না। শুধু বলব, উনি আজ বুঝতে পারছেন, বাংলার উন্নয়নে দিল্লির বিজেপি বন্ধু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই লাগে।"

ওদিকে আচমকাই অর্জুন সিংয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্রকেও। অর্জুনের বিরুদ্ধে এতদিন তোপ দাগলেও, হঠাৎ কামারহাটির তৃণমূল বিধায়কের মুখে তাঁর সুখ্যাতি শোনা গিয়েছে৷ মদন মিত্র বলেন, "ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'বেটার লেট দ্যান নেভার'। এখন অর্জুন যদি সত্যি কথা বলে থাকে এবং ওর যদি মনে হয় যে, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করছে, কী কারণে বলেছে বলতে পারব না। ওদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও দেখলাম শুভেন্দু ছেড়ে দিয়েছে। হয়তো বিজেপিকে বাদ দিয়ে অন্য কোথাও তিনি এখন হোয়াটসঅ্যাপ করছেন। সেটা তো আমি জানি না। তবে আমি খুশি। আমরা যেটা দীর্ঘদিন ধরে বলছিলাম, বিজেপির একজন এমপি আজ তাই মনে করেছেন।" এরপরেই রসিকতার সুরে বারাকপুরের সাংসদ সম্পর্কে মদন বলেন, "এতদিন বাদে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, অর্জুনকে বেশ সুন্দর দেখতে। আগে বুঝিনি। অর্জুনকে দেখতে বেশ ভাল, ফরসা। আমি ভাবছি কাল থেকে অর্জুনের মতো সাদা শার্ট পড়ব। বেশ ভালো লাগছে।" বারাকপুর, কামারহাটি, ভাটপাড়া'র বিগত কয়েকটি নির্বাচনে এই অর্জুন সিংয়ের বিরুদ্ধে কম হুঁশিয়ারি দেননি মদন মিত্র। টিভি চ্যানেলের প্যানেলে তুঙ্গে উঠেছিল দু'জনের বাকবিতণ্ডা, যা প্রায় দু'তরফেই খুনের হুমকিতে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন তাঁরই গলায় অর্জুনের প্রশংসা শুনে স্বাভাবিকভাবেই জল্পনা বাড়ছে রাজনৈতিক মহলে৷

অনেকেরই মনে আছে কিছুদিন আগে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "তৃণমূল যদি গেট খুলে দেয়, তাহলে এত লোকজন তৃণমূলে আসবেন যে বাংলায় বিজেপি দলটাই উঠে যাবে।" এখন, এই পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন, হয়তো এবার সেই গেট খুলতে চলেছে, আর অর্জুন সিং-ই এই দফায় প্রথম ব্যক্তি যিনি গেট অতিক্রম করে তৃণমূলের নতুন দফতরে ঢুকে পড়বেন৷

অর্জুন সিং দল বদল করুন বা না করুন, একথা অবশ্যই মানতে হবে, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে, পদ্মপ্রতীকে প্রার্থী হয়ে এবং হেরে যারা তৃণমূলে ফিরে এসেছেন, তাঁদের থেকে যোগ্যতা, সাংগঠনিক শক্তি এবং গ্ল্যামারে অনেক এগিয়ে বারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং৷ (এই তালিকায় অবশ্য মুকুল রায় ও বাবুল সুপ্রিয় নেই৷ কারণ,মুকুল রায় কোন দলে তা এখনও বিচারাধীন এবং বাবুল সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন৷) তৃণমূলের দুর্গে বিজেপির প্রার্থী হয়ে অবলীলায় হারিয়ে দিয়েছেন জোড়া ফুলের সিটিং সাংসদকে৷ এটা কম কথা নয়৷

অর্জুন কী করবেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন৷ তবে অর্জুন বাণে গত কয়েক দিন ধরেই বিদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। তাঁকে নিয়ে অস্বস্তিও বেড়ে চলেছে গেরুয়া-অন্দরে৷

বুধবারও অর্জুন সিং দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বঙ্গ সফরের আগের দিনও ধর্মতলায় দলীয় মঞ্চে একদমই ‘বেসুরো’ অর্জুন সিংয়ের কাছে ফের ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। অর্জুন বিজেপিতেই আছেন, বিজেপির সংসার সুখেই দিন কাটাচ্ছে, এই বার্তা দিতে বুধবার সুকান্ত মজুমদার থেকে দিলীপ ঘোষ ও শুভেন্দু অধিকারীদের উপস্থিতিতেই ভাষণ দেওয়ার জন্য অর্জুন সিংয়ের নাম ঘোষণা করা হয়। অর্জুন মঞ্চের পিছনদিকে ছিলেন৷ মাইকের দিকে এগিয়ে আসার পরিবর্তে অর্জুন সেখান থেকেই হাত নেড়ে সঞ্চালককে জানিয়ে দেন, তিনি আদৌ ভাষণ দেবেন না৷ রাজনৈতিক মহল বলছে, দলের কর্মসূচিতে অর্জুন সিংয়ের এই আচরণ স্বাভাবিক নয়৷ এই আচরণ ফের তৃণমূলমুখী হওয়ার জল্পনাই উসকে উঠেছে।

অর্জুন সিংয়ের মুখ থেকে গত কয়েকদিন ধরে অনেক কথাই শোনা গিয়েছে৷ শুধু এখনও তিনি বলেননি, "দলে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না৷ দম বন্ধ হয়ে আসছিল৷"

বাংলার মানুষ কান পেতে রয়েছেন এই বাণী শোনার জন্য৷

More Articles