বাংলাদেশ তার নীরব মোদি ও বিজয় মাল্য-দের নিয়ে কী করছে?

বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থকে সাদা করার বিরল সুযোগ করে দিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল, এমনটাও অনেকের মত। ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন অবধি এই সুবর্ণসুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন বাংলাদেশি কালো টাকা...

ভারতের নীরব মোদি, বিজয় মাল্য-দের মতো শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরা অসংখ‍্য ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে সেই অর্থ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছেন। ভারত এখনও আইন-আদালতে চক্কর কেটেও তাদের দেশে ফেরত আনতে হিমশিম খাচ্ছে।

ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে একই ধরনের অপরাধী প্রচুর আছেন এবং তাদের নিয়ে বাংলাদেশ সরকারেরও মাথা ব্যথার কমতি নেই। অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, রাজনীতিবিদ এক শ্রেণির শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা দেশের কর ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছেন। এই নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও প্রচুর হয়েছে, কিন্তু কোনও সুরাহা মেলেনি। এরকম বহু অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের কালো টাকা পাচারকারী শ্রেণির লোকজন লন্ডনে বা নিউ ইয়র্কে অনেক বাড়ি কিনেছেন এবং প্রচুর সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। শোনা যাচ্ছে, কানাডায় সম্পূর্ণ একটি কলোনি তৈরি হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি কালো টাকা পাচারকারী শ্রেণির নাগরিকদের স্ত্রী-রা বাড়ি কিনে থাকছেন এবং বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাঠাচ্ছেন তাদের স্বামীরা। ফলে টরেন্টোর ওই এলাকার নামই হয়ে গেছে বেগমপাড়া।

এদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পলাতক বাংলাদেশি পি. কে. হালদারের মতো অনেকেই অবৈধভাবে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন দেশের কালো টাকা বিদেশে পাচার করে। এই ধরনের সমস্যা প্রতিকারের চেষ্টায় বাংলাদেশ সরকার ২০২২-'২৩ অৰ্থ বছরের বাজেট সম্মেলনে ৯ জুন একটা নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিল। সেগুলো কেমন, এক নজরে দেখা যাক:

আরও পড়ুন: দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত, বিদেশে চিকিৎসায় নিষেধাজ্ঞা, কতটা অসুস্থ খালেদা জিয়া?

১. বিদেশে অবস্থিত যে কোনও সম্পত্তির ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষ কিংবা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না।

২. বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনা হলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে।

৩. বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা হলে তার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে।

৪. আবার কেউ যদি বিদেশ থেকে নগদ পাচার করা অর্থ আনেন তাহলে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিতে হবে।

৫. কর জালের হিসেব রাখার জন্য করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরের ফেরত জমা রশিদ বাধ্যতামূলক করা হবে।

৬. করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য স্থান নির্ণয় মূল্যায়নে জোর দেয়া হবে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি-র তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে অন্তত সোয়া চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক ওয়াচডগ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১০০০ থেকে ১৫০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়।

কিন্তু এই দায়মুক্তি প্রস্তাব নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামালকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা পাচার করা বাংলাদেশে একটি অপরাধ এবং এর শাস্তির বিধান রয়েছে। ফলে কর দেওয়ার মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সরকারের এই পদক্ষেপ আইন-বিরোধী ও অসাংবিধানিক। টিআইবি-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান-ও মনে করছেন, সরকারের এই পদক্ষেপ কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাঁর কথায়, "অর্থপাচার একটি ঘোরতর অপরাধ বাংলাদেশের এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। এবং এই ধরনের ঘোরতর অপরাধকে এরকম ঢালাওভাবে সুযোগ করে দেয়া মাত্র ৭-১৫ শতাংশ কর দিয়ে, তা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।" ড: ইফতেখারুজ্জামান আরও বলছেন, দেশে বা বিদেশে যারা বৈধভাবে আয় করে, তাদের ২০ শতাংশ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তের ফলে যারা ঘোরতর অপরাধ করেছে, তাদের মাত্র সাত শতাংশ কর দেয়ার সুযোগ দেওয়াটা অত্যন্ত 'বৈষম্যমূলক'।

অর্থনীতিবিদদের অনুমান, যাঁরা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন ও সেখানে সম্পদের মালিক হয়েছেন, উপভোগ করছেন, সেগুলো ছেড়ে দিয়ে সেই অর্থ তাঁরা দেশে নিয়ে আসবেন, সেটা ভাবা খুবই কঠিন।বাংলাদেশের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যে শত শত কোটি ডলার প্রতি বছর পাচার হয়, অর্থমন্ত্রী সেই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতেই এই সুযোগ দিতে চান এটা তাঁরা বুঝতে পারছেন, কিন্তু এভাবে আদৌ কোনও অর্থ ফিরবে কি না, তা নিয়ে তাঁদের ঘোরতর সন্দেহ আছে। পাশাপাশি তাঁরা এটাও বলছেন, সরকারের এই ধরনের প্রস্তাব অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই 'অনৈতিক'।

ঢাকার শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিষ্কার জানিয়েছে, এই পদক্ষেপে তাদের কোনও সমর্থন থাকার প্রশ্নই নেই। বাজেটের বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করতে ১০ জুন, শুক্রবার সকালে ডাকা একটি সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর ওই প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনাও করেছে সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, "এই ধরনের উদ্যোগ আসলে কর-ন্যায্যতার বিপক্ষে এবং নৈতিকতার পরিপন্থী।" তাঁর মতে, এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একদিকে যেমন সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহ করা হচ্ছে, অন্যদিকে, যাঁরা এই অর্থ সম্পদ বাইরে নিয়ে যান, তাঁদের প্রকারান্তরে উৎসাহিতই করা হচ্ছে।তিনি বলেন, "তারা অন্যায়ভাবে, ব্যাঙ্ক ঋণ থেকে বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ নিয়ে গেছে। তাদের আবার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছি। এইটা চরমভাবে একটা অনৈতিক কাজ।" সবচেয়ে বড় কথা, সিপিডির মতে এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশে কোনও অর্থ ফেরত আসবে না।

জাতীয় বাজেটের পরদিন অর্থমন্ত্রী প্রথাগত যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতে তাঁকে এই বিষয়েই সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, মূলত পাচার হওয়া টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতেই তাঁর এই উদ্যোগ। অর্থমন্ত্রী বলেন, "কখনও কখনও মিসম্যাচ হয়ে যায়। কখনও কখনও বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। টাকা পাচার হয়নি, একথা আমি কখনও বলিনি। এটা আমরা ধারণা করছি যে, পাচার হয়ে গেছে।" এই ধরনের চেষ্টা এর আগে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করে সফল হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, "যদি পাচার হয়ে থাকে, তাহলে সেটা এই দেশের মানুষের হকের টাকা। আমরা এগুলো ফেরত আনার চেষ্টা করতেছি। এখানে বাধা দেবেন না। বাধা দিলে আসবে না। তাহলে আপনাদের লাভ কী? আপনারা যে বলছেন আসবে না, কেন আসবে না, আসবে। এটাও চেষ্টা করতে হবে," বলেন তিনি।

তবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কী প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ফিরতে পারে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এই ব্যাপারে শীঘ্রই একটি আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে। দেশের ভেতরের কালো টাকাকে সাদা করার জন্য আগেও বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পি চিদাম্বরম দেশের কালো টাকাকে সাদা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ত্রিশ শতাংশ জরিমানা মঞ্জুর করার মাধ্যমে।

কিন্তু বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থকে সাদা করার বিরল সুযোগ করে দিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল, এমনটাও অনেকের মত। ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন অবধি এই সুবর্ণসুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন বাংলাদেশি কালো টাকা বিদেশে পাচাকারীরা।

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের পর দেশটির অর্থনীতিবিদ সুশীল সমাজ ও নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসলেও বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, বাংলাদেশি প্রবাসীরা এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে সাড়া দেবেন এবং বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া দেশের টাকার একটা অংশ দেশে ফিরে আসবে। এখন দেখা যাক, বাংলাদেশি প্রবাসীরা এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে কতটা সাড়া দেন!

More Articles