নৃশংস খুনের আসল কারণ কী, জানতে নার্কো টেস্ট আফতাবের! ঠিক কীভাবে হয় এই পরীক্ষা

Narco Test: লুকিয়ে থাকা তথ্য, যা কোনও অপরাধমূলক ঘটনার তদন্তের জন্য অনিবার্য, তা খুঁজে বের করার জন্যই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

শ্রদ্ধা ওয়ালকার খুনের মামলায় অভিযুক্ত আফতাব আমিন পুনাওয়ালার নার্কো অ্যানালিসিস টেস্ট করতে চাইছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই সাকেত আদালতের তরফ থেকে এই টেস্ট করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দিল্লি পুলিশের তরফ থেকে একথা জানিয়ে বলা হয়েছে, শীঘ্রই ধৃতদের নার্কো পরীক্ষা করা হবে। দিল্লি পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সাধারণত বড় ধরনের অপরাধে সন্দেহভাজনকে নার্কো পরীক্ষা করানো হয়। এর আগে মুম্বই হামলাকাণ্ডে ধৃত পাকিস্তানি নাগরিক আজমল কাসবের এই পরীক্ষা হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় ধৃতদের জবানবন্দি আদালতগ্রাহ্য না হলেও তদন্তের ক্ষেত্রে অনেকটা সুবিধা হয়েছিল।

কী এই নার্কো পরীক্ষা?
এই পরীক্ষা আসলে এক ধরনের শঠতা নির্ণায়ক পরীক্ষা বা Deception Detection test বা সংক্ষেপে DDT। তবে শুধুমাত্র এই নার্কো পরীক্ষা কিন্তু একমাত্র DDT না। পলিগ্রাফ এবং ব্রেন ম্যাপিংয়ের মতো পরীক্ষাগুলো এর আওতায় আসে।

কী কারণে ব্যবহার হয় এই ডিডিটি?

আসলে লুকিয়ে থাকা তথ্য, যা কোনও অপরাধমূলক ঘটনার তদন্তের জন্য অনিবার্য, তা খুঁজে বের করার জন্যই এই ডিডিটি ব্যবহার করা হয়। তথ্য বলতে, এমন কোনও বিশেষ তথ্য যা কোনও ব্যক্তি নিজে জানলেও অন্য কাউকে জানায়নি, অথচ যে কোনও তদন্তের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক প্রমাণিত হতে পারে সেই তথ্য।

আরও পড়ুন: কাটা মুণ্ডুকে মেকআপ, একই ঘরে যৌনতা! আফতাবের মানসিক বিকৃতির আড়ালে লুকিয়ে যে সত্য

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা এই ডিডিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলি খুব ভালো করেই জানে, এই উদঘাটিত তথ্যসমূহ কখনওই যথোপযুক্ত প্রমাণ হিসেবে ট্রায়াল স্টেজে ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ, আদালত এই টেস্টের থেকে পাওয়া তথ্য গ্রহণ করেনা। কিছু তদন্তকারীর মতে, থার্ড ডিগ্রির তুলনায় এই ডিডিটি অনেক বেশি নিরাপদ এবং অনেক বেশি বিজ্ঞানভিত্তিক। এই টেস্ট করানোর মাধ্যমে যে সমস্ত তথ্য সামনে আসে, তার ভিত্তিতে পরবর্তী তদন্ত সুবিধাজনক হয়। অনেকে আবার বলেন, সম্প্রতি ডিডিটি-র বিভিন্ন পদ্ধতির ক্রমাগত উন্নতিসাধনের ফলে আগের তুলনায় অনেকটা নির্ভুল এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে এই নার্কো পরীক্ষা।

এই পদ্ধতিটি কিন্তু খুব একটা নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়কাল থেকে মানুষের 'পেট থেকে কথা' বের করে আনার জন্য বিভিন্ন রকমের খুঁটিনাটি পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হচ্ছিল। সেই সমস্ত পরীক্ষানিরীক্ষার ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত হয় এই পদ্ধতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবন্দিদের ওপর ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল এই পদ্ধতি, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক লুকিয়ে থাকা তথ্য পরবর্তীতে সামনে আসে।

কীভাবে করা হয় এই পরীক্ষা?
এই পরীক্ষায় সাধারণত এক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় মানুষের শরীরের ওপর, যেগুলিকে বলা হয় ট্রুথ সেরাম বা ট্রুথ ড্রাগ। এই সমস্ত ড্রাগের মধ্যে অন্যতম হলো সোডিয়াম পেন্টাথায়োল, স্কোপোলামাইন কিংবা সোডিয়াম অ্যামিটাল। শিরা-উপশিরার মধ্যে এই ড্রাগ ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। এই সমস্ত ড্রাগ বেশি ডোজে ব্যবহার করা হয় অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে। সাধারণত অনুভূতিহীনতার বা অ্যানেস্থেশিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে এই ধরনের ড্রাগ ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট সময় ও অবস্থায় সেই ব্যক্তি যুক্তিবুদ্ধির মাধ্যমে বিচার করার সমস্ত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এই অবস্থায় ওই ব্যক্তি অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলে, যা সচেতন অবস্থায় তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কেননা, এই ড্রাগের প্রভাবে, মানুষের অগ্রমস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যায়। শুধুমাত্র জাগ্রত থাকে মানুষের অবচেতন মন এবং লঘুমস্তিষ্ক। বিশেষজ্ঞদের মতে, লঘুমস্তিষ্ক এবং অবচেতন মন হলো নিষ্পাপ এবং এর মাধ্যমে মানুষ কখনওই মিথ্যে কথা বলতে পারে না।

এই পরীক্ষা সাধারণত দু'টি পদ্ধতিতে করা হয়, পলিগ্রাফিক পদ্ধতি এবং ব্রেন ম্যাপিং পদ্ধতি।

পলিগ্রাফিক পদ্ধতি
আজকাল ডিটেকটিভ গল্পে এই পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। এই পরীক্ষাটিকে সকলেই লাই ডিটেক্টর টেস্ট হিসেবে জানে। এই পরীক্ষাটির পোশাকি নাম পলিগ্রাফিক টেস্ট। এই পরীক্ষাতে প্রথমে ব্যক্তিটিকে কিছু সাধারণ প্রশ্ন করে তারপর তার সাধারণ অবস্থার হৃৎস্পন্দনের হার, রক্তচাপ, কতটা ঘাম হচ্ছে, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হার এবং চোখের মণির আকৃতি মাপা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলি করা হয়। যদি দেখা যায়, পূর্বের ফলাফল এবং বর্তমান ফলাফলের পার্থক্য রয়েছে, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, ব্যক্তিটি মিথ্যে কথা বলছে। অবশ্য সঠিক ধ্যানের পদ্ধতিতে এই পরীক্ষাকে ভুল প্রমাণিত করা যেতে পারে। যাঁরা নিয়মিত ধ্যান করেন এবং যাঁরা নিজেদের অবচেতন মনকে প্রতিদিন ব্যবহার করেন তাঁদের পক্ষে এই পরীক্ষাকে ধোঁকা দেওয়া খুব একটা কঠিন কাজ নয়।

 
ব্রেন ম্যাপিং পদ্ধতি
এই পদ্ধতিটি অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। অবশ্য, সিবিআই তাদের বিশেষ কিছু কেসে এই ব্রেন ম্যাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। এই পরীক্ষায় প্রধানত ব্যক্তিটিকে বহু তার লাগানো সায়েন্স ফিকশন ছবির মতো একটি হেলমেট পড়ানো হয় এবং তারপর তাকে কিছু সাধারণ প্রশ্ন করে তার মস্তিষ্কের হাবভাব বোঝার চেষ্টা করা হয়। এরপর যদি বোঝা যায়, ব্যক্তিটি সুস্থ রয়েছেন, তাহলে ব্যক্তিটিকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দিষ্ট প্রশ্নগুলি করা হয়। তাতে যদি ব্যক্তিটির ব্রেনের সিগনালে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তাহলে ব্যক্তিটি সম্ভবত মিথ্যে কথা বলছে। এই পরীক্ষাটির ক্ষেত্রে আরও সঠিক উত্তর পাওয়ার জন্য ব্যক্তিটিকে প্রচুর ছবি, ভিডিও এবং অডিও দেখানো এবং শোনানো হয়।

তবে, এমনটা নয় যে, অবচেতন অবস্থায় মানুষ সব সত্যি কথা গড়গড় করে বলে দেয়। অবচেতন মন ফাঁস করে দেয় ব্যক্তিগত ইচ্ছের কথা, তার নিজস্ব মতামতের কথা এবং তার ঠিক বা ভুল সমস্ত বিষয়, তার কল্পনা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেয় তার অবচেতন মন। তার মনে চলতে থাকে একটি অন্তর্দ্বন্দ্ব। এককথায় এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ব্যক্তিকে নিয়ে যায় তার স্বপ্নের জগতে, যে জগতে যুক্তি-বুদ্ধি কিংবা তর্ক কাজ করে না।

এই পদ্ধতিতে কতটা সত্যতা বা প্রয়োজনীয়তা উঠে আসবে, তা অভিযুক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কের ওপর নির্ভর করে। ব্রেন ম্যাপিং পদ্ধতিকে বোকা বানানো খুব একটা সহজ নয়। কিন্তু একেবারে অসম্ভবও নয়। আর সম্মোহিত অবস্থায় বলা কথাগুলো যে সত্যি, তেমন নিশ্চয়তা কিন্তু কেউ দিতে পারবে না। এসব ব্যক্তির মনের ভেতর প্রতিনিয়ত চলতে থাকা তোলপাড়ের বহিঃপ্রকাশ। আর সম্মোহিত অবস্থায় প্রকাশিত কোনও বক্তব্য ব্যক্তির স্ব-ইচ্ছাধীন নয়। ঠিক এই কারণেই এই পরীক্ষার কোনও বক্তব্য আদালতে সঠিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না।

ভারতে কি এই পরীক্ষা আইনসম্মত?
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতে এই দু'টি পরীক্ষাই আইনসম্মত। কিন্তু যদি এই পরীক্ষা করতে হয়, তাহলে গোয়েন্দাদের অবশ্যই কিছু প্রোটোকল মেনে চলতে হয়। এই পরীক্ষা করার জন্য সেই অভিযুক্তর সুস্থতা সবার আগে প্রয়োজন। যার এই ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাকে আগে থেকে এই বিষয়টি নিয়ে জানানো হয়ে থাকে। আর সেই ব্যক্তির বক্তব্য আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পেশ করতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এই ধরনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে অভিযুক্তের সম্মতি সবার আগে প্রয়োজন।

ভারতে নার্কো পরীক্ষার ইতিহাস
২০০২ সালে গুজরাতের গোধরা কাণ্ডে সর্বপ্রথম এই নার্কো পরীক্ষা ব্যবহার করা হয়। ২০০৩ সালে তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত আবদুল করিম তেলগির ওপরে এই পরীক্ষা করা হয়েছিল। তেলগির নার্কো পরীক্ষা থেকে বহু তথ্য উঠে এসেছিল, যা পরবর্তীতে তদন্তে সাহায্য করেছিল। আদালত এই জবানবন্দি গ্রহণ না করলেও তদন্তের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছিল। এছাড়াও, ভারতের কুখ্যাত নিঠারি সিরিয়াল কিলিং মামলায় মূল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গুজরাতের গান্ধীনগরে এই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল।

২০০৭ সালে হায়দরাবাদের জোড়া বোমা বিস্ফোরণ কাণ্ডে আবদুল কালিম এবং ইমরান খানের ওপর এই পরীক্ষা করা হয়। তবে, সেই সময় নার্কো টেস্ট সফলভাবে করা সম্ভব হয়নি। তাদের লাই ডিটেকশন এবং ব্রেন ম্যাপিং পরীক্ষা করার পরেও কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতে আসেনি গোয়েন্দা সংস্থার। পুলিশ মনে করেছিল, ২০০৫ সালের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে যে জঙ্গিহামলা হয়েছিল, তার সঙ্গে এই দু'জনের যোগাযোগ ছিল। তবে নার্কো পরীক্ষায় কোনও কিছুই প্রমাণিত হয়নি।

২০০৮ সালে মুম্বই জঙ্গিহামলায় অভিযুক্ত আজমল কাসবের ওপর এই নার্কো পরীক্ষা করা হয়। ২০১০ সালে নয় বছরের একটি কন্যাসন্তানকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মোহাম্মদ আজমেরি শেখের ওপরে এই পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ২০১২ সালে দিল্লির হাইপ্রোফাইল ব্যবসায়ী অরুণ টিক্কু হত্যাকাণ্ডের সময় প্রধান অভিযুক্ত বিজয় পালনদের ওপরেও এই পরীক্ষা করা হয়েছিল।

More Articles