ফতোয়া, হুমকি, আক্রমণ! কী ছিল সলমন রুশদির সেই বিস্ফোরক বইতে? সত্যিটা জানলে চমকে উঠতে হবে

অনেকেই বলেন, রুশদি যে জন্য বিতর্কিত, যে কারণে তাঁর একটি উপন্যাস নিয়ে বারবার বলা হয়, প্রাণঘাতী হামলার হুমকি, 'ফতোয়া' জারি করা হয়- সেই নির্দিষ্ট কারণই নাকি নেই ওই উপন্যাসে।

We need all of us, whatever our background, to constantly examine the stories inside which and with which we live.

-Salman Rushdie

নিউ ইয়র্কের শতকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান মঞ্চ। সামনে তখন প্রায় আড়াইহাজার লোক। স্থানীয় সময় অনুযায়ী, সকাল গড়িয়ে সবেমাত্র দুপুর হচ্ছে। মঞ্চে তিনি। প্রায় সকলেই তাঁকে শোনার অপেক্ষায়। হঠাৎ ছন্দপতন! কালো জামা, কালো মাস্ক পরে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল এক যুবক। নিমেষেই একের পর এক কোপ। কাঁধে, গলায়! রক্তাক্ত! লুটিয়ে পড়লেন আক্রান্ত। এয়ারলিফট। এই লেখার সময় পর্যন্ত হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি! অবশেষে আক্রান্ত হতে হয়েছে তাঁকেও।

ভারতীয় (জন্মসূত্রে) লেখক আহমেদ সলমন রুশদির কথা (Salman Rushdie) বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ অথবা মধ্যপ্রাচ্যের সাংবাদিক জামাল খাসোগি, ভারতের গৌরী লঙ্কেশের মতো সাংবাদিক খুন হন বারবার। মুক্তির কথা বললেই, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেলেই হামলা, জেলযাপন হয় অম্বিকেশ, শিলাদিত্য অথবা ওপার বাংলার রোজিদের। কিন্তু কেন? রুশদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার কারণ কি শুধুই একটি বই! যা আটের দশক থেকে আজও, এই মুহূর্ত পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে এক লেখককে। কী করেছিলেন তিনি? কী অপরাধ ছিল তাঁর?

১৯৮৮ নাগাদ প্রকাশিত 'দ‍্য স্যাটানিক ভার্সেস' (The Satanic Verse) তুফান তোলে বিতর্কের। শোরগোল পড়ে বিশ্বজুড়ে। বলা হয়, মুসলিম ধর্মকে অপমান করেছেন লেখক সলমন। মুহাম্মদের অসম্মান হয়েছে এই বইয়ে। শুরু হয় হুমকি। ইরানের তৎকালীন শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনি মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন, তবুও ওই নেতার মৃত্যুর বহু বছর কেটে গেলেও যে পরোয়ানা কখনও কখনও বহমান। এমনকী, রুশদির মাথার দাম ধার্য করা হয় প্রায় ৩০ লক্ষ ডলার! এখানেই শেষ নয়, তাঁর মায়ের দেশ পাকিস্তানের মতো একাধিক দেশে অঘোষিত নিষিদ্ধ হতে হয় তাঁকে। শুধুই লেখার অপরাধে একটা বড় সময়জুড়ে গা ঢাকা দিতেও হয়েছে লেখককে। এমনকী, তাঁর ওই বিতর্কিত বইয়ের জাপানি অনুবাদক হিতসি টোকিওয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হন। অনেক চেষ্টাতেও বহু লেখক সাহস পাননি ওই বইয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুবাদের।

এই ঘটনা শুধু প্রথম নয়, নয়ের দশকে ইতালির মিলানে প্রাণঘাতী হামলার পরে কোনওক্রমে বেঁচেছিলেন সলমন রুশদি।

কিন্তু এতকিছুর পরেও একের পর এক ভালো না থাকার খবরেও ব্রিটিশ মিডিয়াকে ব্যবহার করে ইতিবাচক বার্তা দিয়ে গিয়েছেন তিনি। চুটিয়ে সংসার করেছেন। প্রেম করেছেন। ২০১৬ সালে পাকাপাকিভাবে ব্রিটেনের নাগরিকত্ব, ২০০৭ নাগাদ চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে বয়সে খানিকটা কম পদ্মলক্ষ্মীকে বিয়ে করেছেন। বই-বিতর্ক ছড়িয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও।

এত কিছু কেটে গেলেও এর মধ্যেও সলমন রুশদি রয়ে গিয়েছেন অনন্য, মৌলিক এক সত্তা হিসেবেই। যখন তিনি লেখার অপরাধে 'নিষিদ্ধ' হচ্ছেন, একপ্রকার হাল আমলের তসলিমা নাসরিনের মতো 'ফতোয়া' জারির বোঝা নিয়ে ঘুরছেন। ঠিক সেই সময় আট-নয়ের দশকে রুশদির কলমেই ছড়িয়ে পড়ছে একের পর এক মণিমুক্তা। বিতর্কিত বইয়ের পরপরই লিখে ফেললেন 'হারাউন অ্যান্ড দ‍্য সি অফ্ স্টোরিজ', 'ইস্ট-ওয়েস্ট', 'দ্য মুর'স লাস্ট নাইট', 'ফিউর', 'দ্য গোল্ডেন হাউস'-এর মতো অনবদ্য সব সৃষ্টি। এদিকে বিতর্কের আগেই তিনি প্রকাশ করে ফেলেছেন 'মিডনাইটস্ চিলড্রেন', 'শেম'-এর মতো লেখা।

অবিভক্ত ভারতের দক্ষিণ মুম্বইয়ের এক এঁদো গলিতে বড় হয়ে ওঠা সলমনের। সেখান থেকেই ফোর্ট স্কুল, রাগবি খেলতে রাগবি কলেজ। লেখার হাতেখড়িও শুরু এই সরু গলি থেকেই। জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রথম পর্বেই ১৯৮১ সাল নাগাদ, মেধার জোরে 'রয়্যাল সোসাইটি অফ্ লিটারেচার'-এর 'ফেলো' হলেন। ওই বছরই 'মিডনাইটস্ চিলড্রেন'-র জন্য মিলল 'বুকার পুরস্কার'। ১৯৯৯ -এ ফ্রান্সের তরফে উপাধিলাভ। ২০০৭-এ সাহিত্যে অবদানের জন্য 'নাইটেড' পুরস্কার। ক্রমেই সমস্তকিছু উপেক্ষা। এমরি, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে থাকেন তিনি। মুহূর্তেই হয়ে ওঠেন অতি প্রিয় শিক্ষকও। এসবের মধ্যেই নিভৃতবাস, তার সঙ্গেই আচমকা প্রকাশ করেন 'জোসেফ অ্যান্টন: এ মেমোয়ার'। আলোড়ন ফেলে আবার। ঘনিষ্ঠ সহকারীর তরফে গোপন ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের চেষ্টা বানচাল করে নিজের মতো করে লড়তে থাকেন সলমন। রুশদি- ইতিহাস, আঞ্চলিকতা, দারিদ্র্য, পরিযায়ী মানুষের কথা তুলে এনেছেন তাঁর প্রায় একাধিক লেখায়। বলতে চেয়েছেন বহু মানুষের কথা। তাঁর তৃণমূল স্তরের মানুষের কথায় উদ্বুদ্ধ, প্রভাবিত হয়েছেন বহু পাঠক।

সলমন রুশদি ভারত ছেড়েছিলেন। জন্মমাটি তিনি স্বেচ্ছায় না অন্য কারণে ছাড়েন, তা নিয়ে আজও বিতর্ক বহমান। তাঁর ব্যক্তি জীবন, একাধিক বিবাহও প্রশ্ন তুলেছে বারবার। কিন্তু কোনও কিছুই টলিয়ে দিতে পারেনি তাঁকে। চেষ্টা করেছেন। জীবনের পথে চলতে চলতে আরও ‌‌‌‌‌‌‌‌‌ক্ষুরধার করেছেন কলম। যে 'ফতোয়া' তাঁকে অন্তর্ধানে যেতে বাধ্য করেছে সেই 'ফতোয়া'কে সঙ্গী করেই বারবার আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মুখ খুলেছেন সাহসী সলমন। ব্রিটিশ সরকারের নিরাপত্তা পেয়েছেন তিনি। তবে থেকে গিয়েছে আশঙ্কা, ভয়, আতঙ্ক। আর এই আতঙ্ককেই কাজে লাগিয়েছেন সলমন। সক্রিয় রাজনৈতিক সমর্থক হয়ে উঠেছেন। বিশের দশকে প্রকাশ্যে সমর্থন লেবার পার্টি-কে। নির্বাচনে জনপ্রিয় রুশদির সমর্থন কাজে লাগিয়েছে ওই দল। অর্থাৎ যে হুমকির মুখে মানুষ পিছিয়ে আসতে ভালবাসে, সেই হুমকিকে পাথেয় করেই রুশদি এগিয়ে গিয়েছেন বারবার। থেকেছেন প্রকাশ্য।

তাঁকে নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে ভারতও। ২০১২ -র জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে, হুমকির দোহাই দিয়ে তাঁর আগমনের পথ রুদ্ধ করার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। এমনকি ভিডিয়ো প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাধা আসে। তবুও কয়েকজন সাহসী লেখক, অমিতাভ গুপ্তদের মতো কয়েকজন প্রকাশ্যে রুশদির বিতর্কিত উপন্যাস পাঠ করে বিপদে পড়েন বলে দাবি করা হয়। প্রাণ বাঁচাতে তড়িঘড়ি ছাড়তে হয় জয়পুর। ওই বছরেই মার্চ মাসে ভারতে আসেন রুশদি। দিল্লির একটি সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। কিন্তু তাঁর ভারত সফর এবং হামলার হুমকি বারবার চিন্তায় রেখেছে প্রশাসনকে। বিব্রত হয়েছেন তিনি নিজেও।

অনেকেই বলেন, রুশদি যে জন্য বিতর্কিত, যে কারণে তাঁর একটি উপন্যাস নিয়ে বারবার বলা হয়, প্রাণঘাতী হামলার হুমকি, 'ফতোয়া' জারি করা হয়- সেই নির্দিষ্ট কারণই নাকি নেই ওই উপন্যাসে। সামান্য একটি অংশের বিকৃত প্রকাশ হয়েছিল শুধু। এমনকী, লেখক নিজেও দাবি করেন, এই লেখা নিয়ে অযথা বিতর্ক হচ্ছে, তিনি এমন কিছুই লেখেননি। বইটি পড়ে দেখারও অনুরোধ করা হয়। এদিকে ফি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি লেখকের কাছে 'কালো হুমকি'-র চিঠি পৌঁছনো নিয়ে একটা সময় মজার ছলেই মন্তব্য করেছিলেন রুশদি। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, খানিকটা অজ্ঞতা আর অন্ধকার তাঁর লেখাকে বিকৃত করেছে শুধু, হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর লেখার আসল মর্মার্থ যেদিন পাঠক বুঝবেন, সেদিনই মুক্ত হবে সব।

সব হয়তো ঠিক হয়ে যাওয়ার আশাতেই শতকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে মুক্তির কথা বলবেন ভেবেছিলেন। মুক্তমনা অভিজিৎ, বিশ্বজুড়ে স্বাধীন মতবাদের ধারক-বাহকরা যেমনটা বারবার ভাবেন। যেমন করে বাঁচতে চান, বাঁচাতে চান বারবার। শাসকের, অন্ধভক্ত, ধর্ম নিয়ে অশান্তির ধারক, বাহকদের ভাল হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন যাঁরা, তাঁদেরই আক্রান্ত হতে হয় প্রতি মুহূর্তে? কেউ চিরতরে চোখ বন্ধ করেন, কলম রাখেন স্তব্ধ করে, কেউ বা লড়ে চলেন মৃত্যুশয্যার অতলে! সলমন রুশদিও যেন সেই প্রতীক। যাঁর বিপ্লব, বিতর্ক, টানাপোড়েন সমস্তটা নিমজ্জিত হয়ে আজ প্রশ্ন তুলছে সমস্বরে, যেন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত লেখক প্রশ্ন করছেন, আর কত? শুধুই কিছু ভুলের বশবর্তী হয়ে আর কতদিন চলবে এই লড়াই! যেন মঞ্চের সামনের আড়াইহাজার পৃথিবীর প্রতিনিধিকে বলে উঠছেন, পারবে তো নিজের কথা বলতে, নিজের মতো লিখতে, পারবে তো কলমকে সত্যিকারের অস্ত্র করে তুলতে!

কী হবে, কী হবে না, কে পারবেন, কে পারবেন না, কে বলবেন, কে বলবেন না, আমরা জানি না। কিন্তু এইটুকু জানি, আক্রান্ত রুশদিরা রক্তাক্ত হন, আক্রান্ত হন, কেউ কেউ হয়তো চিরবিদায় নেন নিমেষেই। কিন্তু রয়ে যান, থেকে যান নিরন্তর। ভালো থাকায়, ভালো রাখায়, সত্যি বলার চরকিতে পিষে দেন রাষ্ট্রের, প্রতিষ্ঠানের, মিথ্যার পাথরকে।

অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে!

More Articles