হঠাৎ ঘুম ভাঙল চাণক্য মুকুলের, খেলায় ফিরবেন না কি তলিয়েই যাবেন

তিনি মুকুল রায়। তুখড় বুদ্ধি এবং ঘড়ি ধরে কৌশল কার্যকর করার দক্ষতা দেখে অনেকেই তাঁকে 'চাণক্য' বলতে পছন্দ করেন।

দীর্ঘদিন অন্তরালে। স্ত্রী-বিয়োগ, অসুস্থতা, রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে আইনি জটিলতা ইত্যাদি নানা কারনেই ইদানীং রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে তিনি। ফলে সর্বস্তরেই একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, রাজনীতিতে ফেরার আর বোধহয় ইচ্ছেই নেই তাঁর।

 

তিনি মুকুল রায়। তুখড় বুদ্ধি এবং ঘড়ি ধরে কৌশল কার্যকর করার দক্ষতা দেখে অনেকেই তাঁকে 'চাণক্য' বলতে পছন্দ করেন। এই মুহূর্তে তিনি স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি। একুশের বিধানসভা ভোটেই প্রথমবার বিধায়ক হয়েছেন। তবে জিতেছেন বিজেপির প্রতীকে, পরে ফিরে গিয়েছেন নিজের পুরনো সংসার তৃণমূলেই। আর এই কারণেই তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করতে 'পিলার টু পোস্ট' দৌড়ে চলেছে বঙ্গ বিজেপির একাংশ। বিধানসভার স্পিকার থেকে হাই কোর্টের বিচারপতি, সবখানেই একই আর্জি পেশ করা হয়েছে। বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই দীর্ঘ শুনানির পর জানিয়ে দিয়েছেন, মুকুল রায় দলত্যাগ করেননি। বিজেপিতেই রয়েছেন। কিন্তু এতেও মুকুলের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিতর্ক কমেনি। কলকাতা হাই কোর্ট বিধানসভার অধ্যক্ষকে সেই রায় পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছে। ওদিকে এরই মধ্যে মুকুল রায়ের দু’টি ছবি ও ভিডিও ট্যুইট করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তা নিয়ে ফের নতুন করে শোরগোল পড়ে রাজ্য রাজনীতির অন্দরমহলে। অবশ্য এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

 

কিন্তু এই সবে খুব একটা তাপ-উত্তাপ নেই মুকুল রায়ের। কারণ, সংসদীয় রাজনীতিতে মুকুল রায় তেমন আগ্রহী নন। আগ্রহ থাকলে ২০১১ বা ২০১৬ সালেই তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হয়ে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনও দপ্তরের মন্ত্রী হতে পারতেন। তেমনটি হলে তাঁর নিজের এবং রাজ্য বিজেপির ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। আসলে সেই অর্থে মুকুল রায় কখনওই জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা নন, ভোট-ক্যাচার বা দুরন্ত বক্তাও নন। রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন, সেখান থেকেই দেশের রেলমন্ত্রী-সহ একাধিক দপ্তরের মন্ত্রী হন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মুকুল রায়কে প্রায় জোর করেই কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে প্রার্থী করে। মুকুলবাবু জয়ী হন ৩৫ হাজার ভোটে। এর পরে একদিন মুকুলবাবু যোগ দেন তৃণমূল কংগ্রেসে। তৃণমূল তাঁকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান পদটি সাধারণত বিরোধী দলের বিধায়করাই পেয়ে থাকেন। খাতায়-কলমে আজও মুকুল রায় বিরোধী বিজেপি-র বিধায়ক। ফলে বিধানসভার 'কনভেনশন' লঙ্ঘিত হয়নি, এমনই বলছেন তৃণমূল পরিষদীয় দল। কিন্তু আরও অনেক তথাকথিত যুক্তি সামনে এনে আদালতের দ্বারস্থ হয় বিজেপি। দাবি তোলা হয়, যেহেতু মুকুল রায় দল বদল করেছেন, তাই এই সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করে তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করতে হবে। বিজেপি নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সদা সর্বদা নজর রাখছে মুকুল রায়ের ওপর। কখন তিনি পুরনো তৃণমূল ভবনে গিয়েছিলেন, কবে, কখন তিনি নতুন তৃণমূল ভবনে পা রেখেছেন, কখন কী বলছেন, সবই আজ বিজেপির স্ক্যানারে উঠে আসছে। কিন্তু এর একটিও ওঁর বিধায়ক পদ খারিজ করার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নয়। যে কোনও কারণেই হোক এক দলের বিধায়ক অন্য দলের সদর দপ্তরে যেতেই পারেন। তবে এসব নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে, থাকবেও।

 

আরও পড়ুন: পরপর ভুল পদক্ষেপ নাকি সময়ের খেল? যে ভাবে বাংলার রাজনীতিতে ফিকে হলেন মুকুল রায়

 

সব মিলিয়ে এই কারণে এবং অবশ্যই শারীরিক কারণে এতদিন রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে ছিলেন মুকুল রায়। নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেলেও এতদিন সেভাবে হাজিরাও দেননি তিনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার হঠাৎই তিনি ভেসে উঠলেন। নিজেই একটি ট্যুইট করেছেন মুকুল রায়। সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে এই ট্যুইট নয়। একদমই রাজনৈতিক ট্যুইট৷ ট্যুইটে সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকেই। মোদিকে উদ্দেশ্য করে মুকুল রায় লিখেছেন,

 

"মাননীয় ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী মহোদয়,

 

ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব
পঙ্গু অর্থনীতি
মুদ্রাস্ফীতি

 

এইসব বিষয় নিয়ে আপনার ভাবনা-চিন্তা ঠিক কী?

 

'অমৃত কাল' নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া, আপনার অপশাসনের জেরে ভারতের জনগণ প্রতিদিন যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে আপনি কি কিছু করছেন?

 

না, কিছুই করেননি।"

 

 

একেবারে শেষে লিখেছেন, "জুমলাক্রেসির ৮ বছর।"

 

প্রসঙ্গত, গত ২০১৪ সালের ২৬ মে তারিখেই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন। বুধবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৮ বছর পূর্ণ করলেন মোদি। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের ৮ বছর পূর্তিকে সাংগঠনিক স্তরে পালন করছে বিজেপি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বুথ স্তরে দলের সংগঠন শক্তিশালী করার কাজ শুরু করেছেন বিজেপির জাতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। তিনি ঘোষণা করেছেন, বুথ স্তরে সংগঠন শক্তিশালী করার কাজ শুরু হয়েছে, দেশজুড়েই চলবে। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘বুথ সশক্তিকরণ অভিযান’‌‌।

 

এক সময়ে সর্বভারতীয় বিজেপির সহ-সভাপতি পদে থাকা মুকুল রায় এই ইস্যুতেই নিশানা করেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীকে‌।

 

আর এই ট্যুইট নজরে আসামাত্রই মুকুলের বিরুদ্ধে তাদের আনা পুরনো অভিযোগ নিয়ে বিজেপির একটি অংশ ফের ঝাঁপিয়েছে। এরা ফের বলছে, এই তো তৃণমূলের সুরে কথা বলছেন মুকুল রায়। বিজেপির বিধায়ক হয়েও ট্যুইটে কঠোর সমালোচনা করেছেন মোদিজির। এর মানে মুকুল রায় এখন আর বিজেপিতে নেই৷ এর অর্থ তিনি বিধায়ক পদে ইস্তফা না দিয়েই তৃণমূলের সুরে কথা বলছেন। তাহলে মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ কেন খারিজ হবে না?


তবে এসব কথা অর্থহীন। অর্থহীন এই কারণেই যে এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। ওদিকে তৃণমূল শিবির আহ্লাদিত, ফের 'স্বমহিমা'-য় বোধহয় ফিরছেন চাণক্য।


জানা নেই, নিজের আমলে 'অসুস্থ' চাণক্য সেইভাবে পারফর্ম করতে আদৌ সফল হয়েছিলেন কি না!

More Articles