বেছে বেছে টার্গেট মহিলাদের 'নিলাম'-এ তোলার অ্যাপ! কী এই 'বুল্লিবাই'! কারা চালাত!

নতুন বছর শুরু হতে না হতেই শুরু হয়ে গিয়েছে বিতর্ক। আর এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি বিশেষ অ্যাপ। অ্যাপটির নাম বুল্লি বাই।  এই বুলি বাই সারা ভারতে সাড়া ফেলে দিয়েছে মুহুর্তের মধ্যেই। তড়িঘড়ি বিশ্বের জনপ্রিয় হোস্টিং প্ল্যাটফর্ম গিটহাবের তরফে এই বিশেষ অ্যাপটিকে ব্লক করা হয়, এবং এই অ্যাপটি যে সংস্থা তৈরি করেছে তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যান করা হয় সেই হোস্টিং প্ল্যাটফর্ম থেকে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।  খবরের শিরোনামে উঠে আসে এই 'বুল্লি বাই'। অভিযোগ এই অ্যাপের মাধ্যমে নাকি বেছে বেছে ভারতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মহিলাদের ফটোশপ করা বিকৃত ছবি এবং মনগড়া কুৎসিত বিবরণ পোস্ট করে তাদেরকে 'ভার্চুয়াল নিলামে' তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল।

ওই দিনই অর্থাৎ ১ জানুয়ারি একটি বিতর্কিত ওয়েবসাইটও লঞ্চ করা হয়েছিল এই অ্যাপের পরিপ্রেক্ষিতে। সেই ওয়েবসাইটে মুসলিম ধর্মাবলম্বী সমাজকর্মী, সাংবাদিক, ছাত্রী থেকে শুরু করে জনপ্রিয় কিছু ব্যক্তিত্বের ছবি অত্যন্ত কুরুচিকর ভঙ্গিতে পোস্ট করা হয়েছিল। এই বিষয়টি নিয়ে শোরগোল পড়তেই, একজন মহিলা সাংবাদিক এই অ্যাপটির মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে সাইবার পুলিশের কাছে একটি লিখিত এইআইআর দায়ের করেন। কিন্তু কী এই 'বুল্লি বাই' অ্যাপ এবং কী ভাবে মুসলিম মহিলাদের 'নিলাম' করার এই কদর্য নকশা সাজানো হয়েছিল ওয়েবসাইটে? এই প্রশ্নগুলো হয়ত এখন আপনার মাথাতেও ঘোরাফেরা করছে। 

কী আসলে এই 'বুল্লি বাই' অ্যাপ?

'বুল্লি বাই' এই লব্জটি আদতে ব্যবহার করা হয় মুসলিম মহিলাদের অসম্মান করার জন্য। হিন্দি ভাষায় ব্যবহৃত একটি অবমাননাকর শব্দ 'বুল্লি'। আর এই শব্দবন্ধটির মতই ওই বিশেষ ওয়েবসাইট এবং অ্যাপটিকেও ডিজাইন করা হয়েছিল মুসলিম মহিলাদের অবমাননা করার জন্যই। যারা নিয়মিত সাইবার জগতের অপরাধ নিয়ে চর্চা করেন তাদের হয়তো মনে থাকবে ২০২১ এর জুলাই মাসে 'সুল্লি ডিলস' নামের একটি ওয়েবসাইট ও অ্যাপ হঠাৎ করেই হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়। সেই সময়ই প্রথমবার ভারতে মুসলিম মহিলাদের নিলাম করার মত ঘটনা সামনে আসে। ওই অ্যাপে প্রায় ৮০ জনেরও বেশি মুসলিম নারীর প্রোফাইল তৈরি করে তাদের 'নিলাম' করার মত ঘটনা ঘটানো হতো। 

সুল্লি ডিলস-র মতই এই বুল্লি বাই অ্যাপটিও মুসলিম মহিলাদের 'নিলাম' এর জন্য তৈরি হয়েছিল। একটি জনপ্রিয় ওপেনসোর্স সার্ভিস গিটহাবের মাধ্যমে এই ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ অপারেট করা হতো। এই বুল্লি বাই অ্যাপে প্রায় ১০০ জনেরও বেশি মহিলাকে নিশানা করে তাদের প্রোফাইল বানানো হয়েছিল। যখন এই অ্যাপ কার্যকরী ছিল, তখন সেই অ্যাপ খুললেই মহিলাদের মুখমন্ডলের একাধিক ছবি দেখা যেত, যেগুলি প্রধানত নেওয়া হয়েছিল ট্যুইটার থেকে। 

শুধু ছবিতেই ক্ষান্ত নয়, ছবির সঙ্গেই সেই ছবিতে যে মহিলার মুখমন্ডল রয়েছে তার ব্যাপারে নানান ধরনের অবমাননাকর বিবরণও দেওয়া থাকত। ট্যুইটারে যে সমস্ত মুসলিম মহিলাদের ফলোয়ার সংখ্যা ভালো, যাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা উল্লেখযোগ্য পরিচিতি রয়েছে, তাদেরকেই মূলত নিশানা করা হয়েছিল এই অ্যাপের মাধ্যমে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে অভিনেত্রী, এমন বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মহিলাদের নিশানা করে তাদেরকে এই অ্যাপে 'নিলামে' তোলা হয়েছিল। বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মহিলা ট্যুইট করে জানিয়েছেন, তারা এই বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত আতঙ্কিত। 

গত বছর যখন 'সুল্লি ডিলস' অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ভাইরাল হয়েছিল, সেই সময় দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কাছে দুটি লিখিত এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত 'সুল্লি ডিলস' কাণ্ডে কাউকে ধরা না গেলেও 'বুল্লি বাই' অ্যাপের পিছনে যার মাথা রয়েছে, তিনি ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন।

কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, অশ্লীলবার্তাবহ অ্যাপে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্তদেরই কেনো নিশানা করা হচ্ছে?  ধর্মীয় বিভেদের উদ্দেশ্যেই এরকম কাজ করা হতে পারে, মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তবে এই ধরনের অ্যাপের নেপথ্যে লুকিয়ে রয়েছে আরও বেশ কিছু রহস্য। ইতিমধ্যেই, 'বুল্লি বাই' কাণ্ডে 'কে এসএফ খালসা শিখ ফোর্স' নামের একটি ট্যুইটার হ্যান্ডেলের যোগসুত্র মিলেছে। এই ট্যুইটার হ্যান্ডেল তৈরি করেছিলেন উত্তরাখণ্ডের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী শ্বেতা সিং। ইতিমধ্যেই তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শ্বেতার সূত্র ধরে উত্তরাখণ্ডের আরও একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। 

মনে রাখতে হবে 'বুল্লি বাই' কিংবা 'সুল্লি ডিলস' কোনও ভাবেই সত্যিকারের অর্থে কেনা বেচা করার কোন ওয়েবসাইট ছিল না। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমান মহিলাদের ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করে তাদেরকে অপমান করা। শিবসেনা নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী এই ঘটনা নিয়ে ট্যুইট করে বলেছেন, "প্ল্যাটফর্ম ব্লক করার পাশাপাশি এই ধরনের সাইট তৈরি করা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।" ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বলছেন, "পুলিশ সাইবার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় স্থাপন করে নিশ্চিত করবে যেন পরবর্তীতে এ রকম কোনও ঘটনা আর না ঘটে।"

উল্লেখ্য অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি সমীক্ষায় ২০১৮ সালে উঠে এসেছিল, ভারতে যে নারী যত বেশি সোচ্চার হবেন, তার 'টার্গেট' হওয়ার আশঙ্কা ততবেশি। এবং তিনি যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অনগ্রসর বর্ণের মহিলা হন তাহলে তার প্রতি অবমাননার পরিমাণ আরও বাড়বে। সমালোচকরা বলেন, সাম্প্রতিক সময়কালে ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশ যেভাবে সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় মেরুকরণ  বাড়ছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে  সংখ্যালঘুদের ট্রোল, ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের হেয় করার ঘটনা আরো বাড়বে। এই ঘটনা যে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে গভীরভাবে আঘাত করবে অদূর ভবিষ্যতে তা বলাই বাহুল্য। 

More Articles