সিরিয়াল কিলার যখন চিকিৎসক- অন্তিম পর্ব

আগের পর্বে আমরা কয়েকজন অদ্ভুত সিরিয়াল কিলারদের কথা পড়েছি। এরা কেউই স্রেফ খুনী নন, এরা সবাই চিকিৎসা-ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ এঁদের ওপরেই ভরসা করেছিল, আর এই বিকৃত-মস্তিষ্ক মানুষরা সেই সুযোগেই একের পর এক খুন করে গিয়েছিলেন অবলীলায়। এই পর্বে এরকমই আরও কিছু সিরিয়াল কিলারদের কথা।

লেইঞ্জ-এর একদল মৃত্যুর পরী:

পীড়িত, রুগ্ন, শয্যাশায়ী মানুষের দেখাশোনা সত্যিই বড়ো কঠিন। চোখের সামনে অগণিত মৃত্যু, ক্ষত বিক্ষত দেহের যন্ত্রণা- এসব সহ্য করে রোগীদের সেবা করা বড্ড কঠিন। তাই ১৯৮০ সালে অস্ট্রিয়ার একদল সেবিকা এই দুর্গম পথকে সহজ করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন রোগীদের মৃত্যুদণ্ড। এই সেবিকার দলের সদস্যা ছিলেন মারিয়া গ্রুবার, আইরিন লিডল্ফ, স্টেফানিয়া মেয়ার এবং ওয়ালট্রড ওয়াগনার।  তাঁরা স্বীকার করেন ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে তাঁদের করা খুনের সংখ্যা প্রায় ৪৯। ওয়াগনারকেই চিহ্নিত করা হয় এই দুষ্কর্মের নেত্রী হিসেবে। তিনি স্বীকার করেন তাঁর হাতে করা খুনের সংখ্যা দশের কাছাকাছি এবং প্রত্যেকটিই "মার্সি কিলিং"।

তবে প্রথমদিকে খুনের ছুতো হিসেবে তথাকথিত 'মার্সি'-র কথা বললেও পরবর্তীকালে এই নারকীয় হত্যা চলতো সামান্য কারণেও। শয্যাশায়ী রোগীদের অসংযমী মূত্রত্যাগ বা নাকডাকাও হয়ে উঠেছিল তাদের মৃত্যুর কারণ। এই হত্যাকাণ্ডে হাতিয়ার ছিল অতিরিক্ত মাত্রার ইনসুলিন বা ওয়াটার কিওর। নৃশংস ওয়াটার কিওর পদ্ধতিতে খুন করার সময় তাঁরা চেপে ধরতেন রোগীদের নাক এবং জিভকে টেনে ধরতেন বাইরে দিকে। এই অবস্থায় মুখ দিয়ে ঢালা হতো একের পর এক গ্লাস ভর্তি জল, যা সরাসরি গিয়ে পৌঁছাতো ফুসফুসে এবং দেহে মাত্রাতিরিক্ত জলের পরিণাম হতো মৃত্যু। এই 'মৃত্যুর পরী'-দেরই একজন সদস্যের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় যে, তাঁদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারত প্রায় দুশোজন, যদিও তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শেষপর্যন্ত  এই চার সেবিকার স্থান হয় কারাগারে, যদিও ভালো ব্যবহারের দরুণ ২০০৮ সালে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

ডোনাল্ড হার্ভে:

কোনও সার্কাসে রিংমাস্টার যেমন পরিচালনা করেন সমস্ত ইভেন্ট, ঠিক সেভাবেই হার্ভের হাসপাতালে রোগীদের জীবন-মরণ নির্ধারণ করতেন হার্ভে নিজে। নয় নয় করে প্রায় ৩৪ জন রোগীর মৃত্যু ঘটে হার্ভের অধীনে। তবে, এই সমস্ত মৃত্যুগুলিকে হার্ভে বলেন 'মার্সি কিলিং'। অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চান যে, তিনি রোগীদের হত্যা করেন তাদের মুক্তির জন্য, মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি রোগীদের মুক্তি দেন তাদের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে। ওহিও এবং কেন্টাকির বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ থাকাকালীন তিনি তাঁর রোগীদের খুন করা শুরু করেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে যে সমস্ত রোগী তাঁর সান্নিধ্যেএসেছিল,  তাদের নৃশংস মৃত্যু ঘটে হার্ভের হাতে। কখনও মুখে প্লাস্টিক বেঁধে, কখনও বালিশ চাপা দিয়ে, কখনও বা খাদ্য ও পানীয়তে সায়ানাইড এবং আর্সেনিকের মত বিষাক্ত পদার্থ মিশিয়ে তিনি হত্যা করতেন তাঁর রোগীদের, তাঁর চোখে যা ছিল সমস্ত সাংসারিক যন্ত্রণার থেকে মুক্তির পথ। রোগীদের মৃত্যু বা বেঁচে থাকা নির্ণয় করাতে অমোঘ আনন্দ উপভোগ করতেন হার্ভে। জীবন ও মৃত্যুকে ট্র্যাপিজ প্লেয়ারের মত নিয়ন্ত্রণ করতে পারার স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতেন তিনি।

তবে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুখেলার জোকারদের ভূমিকা রোগীদের গণ্ডি পার করে ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। হার্ভের এই নৃশংস খেলার চূড়ান্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর প্রেমিকার এক বন্ধুর মৃত্যু। হাসপাতাল থেকে চুরি করা জীবননাশক হেপাটাইটিসের সিরাম তিনি ঢুকিয়ে দেন তাঁর প্রেমিকার সেই বন্ধুটির দেহে এবং এই ঘটনার কিছুদিন পরই আরও উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৮৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। খাতায় কলমে ৩৭'টি খুনের জন্য দায়ী হলেও বিকৃত মস্তিকের হার্ভে তাঁর উকিলের কাছে স্বীকার করেন তিনি রোগী ও সাধারণ মানুষসহ মোট ৭০ জন মানুষের হত্যা করেছেন। এ সমস্ত কিছুর স্বীকারোক্তি ও বিচার বিবেচনার পর তাঁর ঠাঁই হয় ওহিও-র এক জেলখানায়। সেইখানে থাকাকালীন অন্য এক বন্দীর হাতে ২০১৭ সালে ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয় হার্ভের। তাঁর মৃত্যু-সার্কাসের পর্দা নেমে যায় চিরতরে।

মাইকেল সোয়াঙ্গো:

'সিরিয়াল কিলার' শব্দটা শুনলেই যেন হিমেল বাতাস বয়ে যায় শিরদাঁড়া দিয়ে। আর, সে-ই কিলার যদি হন একজন চিকিৎসক?  হ্যাঁ, এমনই একজন সাদা কোট পরা মানুষের খোঁজ পাওয়া গেছিল ওহিও হাসপাতালের চিকিৎসক মহলে, যিনি ছিলেন মৃত্যুর উপাসক। যাঁর স্টেথোস্কোপ শুধু শুনতে পছন্দ করতো শুধু মৃত মানুষের বুকের ক্রমশ থেমে যাওয়া ধুকপুক। অদ্ভুত মানসিক রোগে আক্রান্ত এই চিকিৎসকের নেশা ছিল জীবন নিয়ে খেলা। ছাত্রজীবনের প্রথমদিকেই এই মৃত্যুর খেলা তাঁকে গ্রাস করে। হাসপাতালের নার্স ও অন্যান্য কর্মীদের মুখে শোনা যায় যে পোস্টমর্টেমের প্র্যাকটিসের জন্য মাইকেলের কোনওদিনই মৃতদেহের অভাব হয়নি। জেমস বন্ড-এর মতোই, 'ডাবল ও সোয়াঙ্গো' নামে সহকর্মী মহলে পরিচিত ছিলেন তিনি। কারণ তাঁর কাছে ছিল 'লাইসেন্স টু কিল'। তাঁর প্র্যাকটিসের ঘরে দাবার ঘুঁটির মত পরপর সাজানো থাকতো মৃতদেহ। এভাবে, একটু একটু করে তাঁর মধ্যে বাড়তে থাকে খুন করার পিপাসা, যা তাঁকে মানুষ থেকে নরখাদকে পরিণত করে। দাবার সুদক্ষ চালের মতো তাঁর খুনের হাতিয়ারও ছিল ইউনিক। খাবার ও বিভিন্ন পানীয় যেমন চা, কফি বা কোল্ডড্রিংকসের সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিতেন বিষাক্ত আর্সেনিক, যা ভিক্টিমদের রক্তে মিশে নিশ্চিত করতো তাদের মৃত্যু। এভাবে তিনি পরপর তাঁর ছয়জন সহকর্মীকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আড়াই বছর কারাবাসের পর নিজের অতীত গোপন করে আমেরিকার আরও কিছু মেডিক্যাল ফেসিলিটিতে যুক্ত হয়েছিলেন সোয়াঙ্গো।

পরবর্তীকালে জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তাঁকে বিভিন্ন প্রোগ্রাম থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। তবে এতে আরও বেঁকে বসেন মাইকেল। দেশ ছেড়ে জিম্বাবোয়েতে চলে যান তিনি। সেই দেশে প্র্যাকটিসের পাশাপাশি, তাঁর বিরুদ্ধ জমা হওয়া সমস্ত প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টাও করতে থাকেন তিনি। কিন্তু, তিনি তাঁর মানুষ খুনের নেশাকেও ছাড়তে পারেননি। হারারের বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি খুনের আসর বসিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে ভেটারনাস হাসপাতালে তিনটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে জোরকদমে তল্লাশি শুরু করে এফ.বি. আই। তল্লাশিতে পাওয়া সমস্ত প্রমাণ ইশারা করে মাইকেলের দিকে। কিন্তু মাইকেল সেই সময় নিরুদ্দেশ। তবে শেষ পর্যন্ত জয়ের হাসি হাসে পুলিশই। শিকাগোর বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় মাইকেলকে। যদিও, তিনি কিছুতেই তাঁর অপরাধের কথা স্বীকার করেননি। বিচারের পর একজন চিকিৎসক হওয়ার সুবাদে শেষে তাঁকে কলোরাডোর এক জেলখানায় সেবা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাঁর করা খুনের আনুমানিক সংখ্যা ৩৫ হলেও কিছু মানুষের মতে তা ৬০-এর বেশি।

তথ্যসূত্রঃ

১) www.mentalfloss.com

২) Serial Killers: The Method and Madness of Monsters- Peter Vronsky

৩) Wikipedia

More Articles