দেশভাগের দগদগে ঘা! কেন ১৮ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় বাংলার এই জেলাগুলোতে?

১৮ অগাস্ট। বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয় দিনটি। কেন?

১৫ অগাস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবস।

ভোর ভোর মাইকে দেশাত্মবোধক গানে ঘুম ভাঙে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাড়ার ক্লাব, পতাকা উত্তোলন হয়। মোড়ে মোড়ে বিক্রি হয় ছোট ছোট জাতীয় পতাকা। স্কুল ইউনিফর্ম পরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গুটি গুটি স্কুলের লাইনে দাঁড়ায়। টিভিতে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন দেখেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই ছবি আমাদের চিরপরিচিত। কিন্তু জানেন কি, এই বৃহৎ উদযাপনের মাঝে মাঝে রয়েছে টুকরো টুকরো আঞ্চলিক স্বাধীনতা উদযাপন, যা পনেরো তারিখ নয়, বরং হয় দিনতিনেক পরে। ১৮ অগাস্ট। বাংলার বেশ কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয় দিনটি। কেন? বলি তবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর টালমাটাল পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যের ওপর দখলদারি দুর্বল হচ্ছিল ব্রিটিশদের। বিশাল সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। যতদিন চার্চিল ছিলেন, দাঁতে দাঁত চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন শাসন। কিন্তু নির্বাচনে চার্চিল হেরে যাওয়ার পর থেকেই মোটামুটি স্পষ্ট হতে থাকল, সাম্রাজ্য আর রাখা সম্ভব হবে না। অর্থনৈতিক কারণ ছিল, রাজনৈতিক কারণ তো ছিলই। অথচ অধিকার পুরোপুরি ছাড়তে রাজি ছিল না কোনও ঔপনিবেশিক শাসকই। তাই তারা ফন্দি বার করল। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, উপনিবেশগুলিকে এমনভাবে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে গোড়াতেই পঙ্গু করে দেওয়া যায় তাদের স্বনির্ভরতা। শাসনকার্যে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে তাদের মুখও বাঁচে, পকেটও বাঁচে, এমনকী, যদিও অদৃশ্য, তবু বেঁচে থাকে ছড়িটিও। ভারতের মোক্ষম দু'টি বিন্দু বাংলা এবং পাঞ্জাব। রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড শক্ত দুই ঘাঁটি। এই দু'টিকে ছত্রভঙ্গ করার প্রয়োজন ইংরেজ অনুভব করেছিল বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকেই। আন্দোলনের চোটে তখন সাহস করেনি। কিন্তু চার্চিলের ছুড়ে দেওয়া দুর্ভিক্ষের আঘাতে চারের দশকের বাংলা পক্ষাঘাতে ভুগছে। ১৯৪৫-এর পর থেকেই হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক আরও অনেকখানি পোক্ত হয়েছে। যার ফলে পরিকল্পিতভাবে ছেচল্লিশের দাঙ্গা। বাবুরা গদিতে বসে রইলেন, খুন হয়ে গেল হাজারে হাজারে খেটে খাওয়া নিম্নবর্গ। লাভ হলো বইকি। যে মেরুকরণের প্রয়োজন ছিল তা বেশ পোক্ত হল। এক সিংহাসনের বাঁটোয়ারায় দু'টি সিংহাসনের দাবি তখন আর অমূলক রইল না। দেশভাগের একটা পাকা কথা হয়ে রইল।

আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে বাধ্য করেছিল সেই বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতার বিষ পালটে দিল ইতিহাস

এবার এই দেশভাগের আঁকাআঁকি সেরে ফেলতে হয়। ডাকা হলো লন্ডনের ব্যারিস্টার সিরিল র‍্যাডক্লিফকে। র‍্যাডক্লিফের দৌড় ছিল প্যারিস অবধি। ভারতের ছায়াও মাড়াননি কখনও। হঠাৎ নির্দেশ এল, ভারত নামে একটি দেশ কেটে ভারত ও পাকিস্তান, এই দু'টি দেশ তাঁকে করে দিতে হবে। প্রচুর কাজ, ব্যস্ততা নিয়েই সাহেব এলেন এদেশে। এসে শুনলেন, আরও চমৎকার একটি খবর, সময় রয়েছে পাঁচ হপ্তা। যা কিছু করার, এর মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে। বর্ডার কমিশনের চেয়ারপার্সন তিনি। কোনগুলি মুসলিম-প্রধান এলাকা, আর কোনগুলি হিন্দু প্রধান— এর একটা খসড়া হিসেব তাঁকে দেওয়া হলো। সেই বরাবর দু'টি লাইন তাঁকে টানতে হবে। নির্বিঘ্নে লাইন টানা হল। কিন্তু জরিপ করতে গিয়ে দেখা গেল, ভাগের ব্যাপারটা মানচিত্রে যত মোলায়েমভাবে হয়ে গিয়েছিল, বাস্তবের জমিতে ততোধিক দুরূহ। বিশেষত বাংলা ভাগের দায় আজ, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও টেনে চলেছে মানুষ। চাউলহাটি, বেরুবাড়ি, তিনবিঘা, ছিটমহল সমস্যা এখনও সম্পূর্ণ মেটেনি। ভাগের ঠিক পরপরই এইসব সমস্যার জন্ম। যার ফলে বেশ কিছু এলাকায় স্বাধীনতা দিবস দিনতিনেক পিছিয়ে গিয়েছিল।

দেশভাগের ঘটনা পৃথিবীর বৃহত্তম উদ্বাস্তু সমস্যাগুলির মধ্যে একটির জন্ম দিয়েছিল। যারা অবস্থাপন্ন, সীমার ওপারে যাদের যোগাযোগ ছিল, তারা বাড়ি, জায়গা জমি অদলবদল করে নিল। যাদের কপালে কিছুই জুটল না, তারা ভিটেমাটি খুইয়ে আশ্রয় নিল উদ্বাস্তু বসতিগুলিতে। শিকড়ছিন্ন হয়ে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হল তাদের। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গার পর এক অদ্ভুত স্বাধীনতার সাক্ষী রইল সেইসব পরিবার। র‍্যাডক্লিফ লাইন তাদের জীবন নরককুণ্ড করে তুলেছিল।

১৯৪৭। ১৫ অগাস্টের ঠিক কয়েকদিন আগে অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে ঘোষণা হলো, বাংলার মালদা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগণা পূর্ব পাকিস্তান, মানে অধুনা বাংলাদেশের মধ্যে পড়ছে। মুশকিল হলো, এই জেলাগুলিতে মুসলিম-প্রধান অংশ বেশি থাকলেও হিন্দু-প্রধান বেশ কিছু অঞ্চল, শহর, গ্রামাদি ছিল। ফলে এই ঘোষণার ফল খুব একটা ভালো হলো না। হিন্দু-প্রধান অঞ্চলগুলিতে স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রবল প্রতিরোধ শুরু হলো। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে। জায়গায় জায়গায় বনধ, অরন্ধন পালিত হলো ঘরে ঘরে। এর জবাবে মুসলিম লিগ পাল্টা পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করল। মিছিল বেরোল। স্লোগান উঠল। উত্তপ্ত হয়ে পড়ল পরিস্থিতি। স্বাধীনতার আগে দাঙ্গা ছিল সরকারের প্রয়োজন। স্বাধীনতার পরপরই দাঙ্গার সম্ভাবনা দু'টি দেশের সরকারের কাছেই কাম্য ছিল না। স্বাধীনতার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে গদি টলার আশঙ্কা ছিল।

অপরদিকে নদিয়ার রাজবাড়ি থেকেও চাপ আসছিল ক্রমাগত। নদিয়ার একটা বড় অংশ তো গিয়েছিলই, রাজধানী কৃষ্ণনগরও ঢুকে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে। রাজবাড়ির কাছেই কৃষ্ণনগর জেলা লাইব্রেরিতে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করল মুসলিম লিগ। প্রমাদ গুনল রাজপরিবার। নবগঠিত কংগ্রেস সরকারের মধ্যে ল্যান্ডেড জেন্ট্রি, অর্থাৎ এই জমিদার-জোতদার শ্রেণির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ফলে রাজবাড়ির দাবি একেবারে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা তৎকালীন সরকারের ছিল না। বাংলার সামনের সারির নেতারা লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে গিয়ে ধরলেন। মাউন্টব্যাটেনই এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা দেখছিলেন। তিনি র‍্যাডক্লিফ সাহেবকে এই সমস্যার সমাধান করতে বললেন। অবশেষে ১৭ অগাস্টের রাতে ফের সংশোধন করা হলো সীমারেখা। হিন্দু-প্রধান অঞ্চলগুলি ফিরে এল ভারতে। ১৮ তারিখ সেই সব নব্য-অন্তর্ভুক্ত এলাকা গুলিতে স্বাধীনতা দিবস তথা অন্তর্ভুক্তি দিবস পালিত হল। আজও এইসব অঞ্চলে ১৫ অগাস্ট জাতীয় স্বাধীনতা দিবস তো পালন হয়ই, তার সঙ্গে ১৮ অগাস্ট পালিত হয় তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক স্বাধীনতা দিবস।

More Articles