পদ্মা সেতু আবেগে কাঁপছে বাংলাদেশ! কেন নাশকতার ভয় হাসিনার মনে?

পদ্মাসেতু উদ্বোধন নিয়ে সাজো সাজো রব বাংলাদেশে। কয়েক কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কালে কেন উদ্বেগ হাসিনার গলায়!

আগামী ২৫জুন বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, তার প্রাক্কালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে হঠাৎই শোনা গেল উদ্বেগের সুর।  এই সেতু উদ্বোধনের সময়ে  নাশকতা হতে পারে বলে প্রকাশ্যেই তিনি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে সতর্ক করে দিলেন। “অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করেছি। যারা এর বিরোধিতা করে এসেছে তাদের একটা টার্গেট আছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কিছু তথ্য রয়েছে। তারা কোন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাবে যাতে আমরা ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করতে না পারি”. গত ১৫ই জুন স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে (এস এস এফ) নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক করে কঠোর নজরদারি করার এমনটাই নির্দেশনা দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেদিন তিনি আরও বলেন, “ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস ও তার বন্ধু হিলারি ক্লিনটনের প্ররোচনায় যখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এই সেতুটি তৈরির জন্য আমাদের তহবিল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তখন আমি এবং আমার সরকার সিদ্ধান্ত নেই পদ্মা সেতু আমরা নিজস্ব তহবিলে তৈরি করব। ওই সময় বহু লোক ভেবেছিল আমরা এই সেতুটি নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করতে পারব না কিন্তু আমরা তা করে দেখিয়েছি।”

কিন্তু কেন এই উদ্বেগ হাসিনার? বস্তুত গত কদিন ধরেই অনেকটা নাটকীয়ভাবেই রাজধানী ঢাকা সহ বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের বাস ট্রেন লঞ্চ ফেরিঘাট ও নানান জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে । সম্প্রতি (৪ জুন) বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রধান বন্দর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বিএম কন্টেইনার টার্মিনালে রাসায়নিক পদার্থ থেকে স্মরণকালের সব থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গিয়েছে যেখানে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন এবং অন্তত কয়েকশো আহত হয়েছেন। এই ঘটনাই তাড়া করছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে।

বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এস এস এফ-এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর ‌উদ্বোধনকে সামনে রেখে নাশকতার ইঙ্গিতে সীতাকুণ্ড অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বলেন, “আমি বিএম কন্টেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ডে ফাউল প্লে হওয়ার সন্দেহ পোষণ করছি। কীভাবে আগুন এক জায়গায় নয় বরং বিভিন্ন জায়গায় ঘটতে পারে এটা অবাক করার মতো । কিছুদিন ধরে ট্রেন লঞ্চ ও ফেরিঘাটে অগ্নিকাণ্ডের অহরহ ঘটনা দেখতে পাচ্ছি যা ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।” আসলে পদ্মা সেতু ষোলো কোটি বাংলাদেশির বহু প্রতীক্ষিত এক স্বপ্নের সেতু । এই সেতু নিয়ে আশা-প্রত্যাশা ও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।

কতটা পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে এই সেতু তৈরি করতে?

আজ থেকে ২১ বছর আগে বিশাল এক জনসভায় ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। তার আগে ১৯৯৮ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পদ্মা সেতুর প্রাক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। পরে ২০০৭ সালের ২৮শে আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (ই সি এন ই সি) দ্বারা প্রকল্পটির অনুমদন দেয়া হয় ।

১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার বহু আলোচিত পদ্মা সেতুর প্রকল্পটি পাশ করা হয় সে সময় । তবে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটির কাজে কোনও অগ্রগতি হয়নি । ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) এই প্রকল্পের প্রাক যোগ্যতা দরপত্র ঘোষণা করে। প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১১ সালের শুরু থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সেতু নির্মাণের প্রধান কাজগুলো শেষ হওয়ার কথা থাকলেও হয়ে ওঠেনি ।

২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতুতে রেল সংযুক্ত করার পর সে বছর ১১ই জানুয়ারী প্রথম দফায় সেতুটির ব্যয় সংশোধন করে বাজেট নির্ধারণ করে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। একই বছরে পদ্মা সেতু তৈরির জন্য বিদেশী অর্থসংস্থা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আরও পড়ুন-বিশ্বের প্রথম পাঁচশোর তালিকায় কেন নেই বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়?

২০১২ সালের ২৯শে জুন বিদেশি ঋণদাতা সংস্থাগুলো চুক্তি বাতিল করে দিলে ঐ বছরের ৯ জুলাই তৎকালীন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন।

অবশেষে ২০১৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের সেতুর মূল নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ১২ ডিসেম্বর ২০১৫-তে। শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান বসানো হয় এবং তিন বছর টানা কাজ চলার পর ২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর শেষ স্প্যান এবং ৪১তম পিলার বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

২০২১ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২৯ এপ্রিল নাগাদ (পাঁচ মাস ১৯ দিন) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের মূল সেতুর পিচ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে যানবাহন চলাচল উপযোগী করে তোলা হয়। পরবর্তী এক মাসেরও কম সময়ে সেতুটির দুই পাড়ের সড়ক সংযোগের পিচ ঢালাই ও ভায়াডাকটের অংশের পিচ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করা হয় ২৩মে. ২০২২।

কতটা মজবুত পদ্মা সেতু?

পিচ ঢালাইয়ের পর রোড মারকিং, রোড সাইন ও ল্যাম্পপোস্ট লাগানোর কাজও দ্রুতই শেষ করে ফেলেন সেতুটির কারিগররা। সেতুতে চলাকালীন জানবাহনের নিরাপত্তার জন্য সেতুতে প্যারাপেট ওয়াল বসানো হয়েছে এবং গরমে প্রসারণ ও শীতে সংকোচনের ফলে সেতুটির উপর যেন কোনও প্রভাব না পরে সেজন্য পদ্মা সেতুতে ৮টি এক্সপানশন জয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। পুরো সেতু জুড়ে বসেছে সর্বমোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট। ইতিমধ্যেই (১৪ই জুন) সবগুলো ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে ঝলমলে রূপ দেয়া হয়েছে পদ্মা সেতুকে। বলা হচ্ছে, ২০০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হলেও না কি চীনের তৈরি এই ল্যাম্পপোস্টগুলোর কোনও ক্ষতি হবে না।

সেতুবাবদ মোট খরচ

পদ্মার মূল সেতুটি (নদীর অংশ) ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮.১০ মিটার প্রস্থ এবং ব্রিজের দুই পাশের সড়ক মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু । মূল সেতু নির্মাণের কাজ করেছে চিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী (এম বি ই সি ) এবং নদী শাসনের কাজ করেছে চীন-এর আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপরেশন। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে পুরো সেতুটির কাঠামো । নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি পদ্মা সেতুর নির্মাণে মোট খরচ পড়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে পদ্মাসেতু

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ার কারণে কৃষিপণ্য কাঁচামাল ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তরিত করতে সুবিধা হবে । এতে শিল্প ও ব্যবসার বিস্তার ঘটবে। পদ্মা সেতু দ্বারা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা ঘুরে যাবে। প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল এলাকার জীবনযাত্রার মান বাড়বে। ফেরি ও লঞ্চের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকার ঘটনাতেও ইতি টানবে পদ্মা সেতু।

ব্রিজের একদিকে ঢাকার খুব কাছে মুন্সীগঞ্জ এবং ব্রিজের ওপারে খুলনা ও যশোর জেলার ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা কৃষি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিবহনের মতো জরুরি খাতে ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ শুরু করে দিয়েছেন। যার কারনে রাজধানী ঢাকার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে এই ধরনের শিল্প ও ব্যবসা খাতে ইতিবাচক সাড়া আনবে পদ্মা সেতু।

যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ করবে পদ্মা সেতু। যার ফলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যর পাশাপাশি বৈদেশিক বাণিজ্যেও ইতিবাচক সাড়া ফেলবে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর এক প্রান্তে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া এবং অপর প্রান্ত শরিয়তপুরের জাজিরা হবে বহু ব্যবসার হাব।

শরিয়তপুরের জাজিরার বাস মালিক সমিতির একজন কোষাধক্ষ আব্দুল খালেক পালোয়ান জানিয়েছেন, “এই প্রথম ঢাকার সাথে শরিয়তপুরের সরাসরি যোগাযোগ হতে যাচ্ছে । এখানকার সবাই খুব খুশি যেহেতু এখন থেকে যেকোনো প্রয়োজনে ঢাকা আশা যাওয়া করা যাবে। শরিয়তপুরের মাছ কখনো ঢাকার বাজারে যেতে পারেনি অথচ এখানে হাজার হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়। চিকিৎসা থেকে শুরু করে সব কিছুতে সুবিধা হবে এখন”।

সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৫ জুন ২০২২ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় থাকা পদ্মা সেতু। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে বাংলাদেশের সরকার ২৫ জুন সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ২৫ জুন একযোগে সারা বাংলাদেশ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান লাইভ উপভোগ করবে।

২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধন হলেও ২৬ জুন থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে শাসক দল আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বাংলাদেশে আগামী বছরের (২০২৩) শেষ দিকে যে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে অবধারিতভাবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সবচেয়ে বড় নির্বাচনী হাতিয়ার হতে যাচ্ছে এই পদ্মা সেতু। ফলে সেতু উদ্বোধনের প্রোমোশনও চলছে জোরালো গতিতে। দেশ বিদেশের বহু নেতা-মন্ত্রী ও সাংবাদিকরা-সহ অনেকেই আছেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অতিথির তালিকায়।

এদিকে ২৫ জুনের উদ্বোধনী আয়োজন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই যেন বাড়ছে সেতুর নির্মাণ ব্যয়ে দুর্নীতির আলোচনা থেকে শুরু করে উদ্বোধনে বিরোধী দলী নেতানেত্রীদেন আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে জল্পনা – সব মিলিয়ে যেন শেষই হতে চাইছে না পদ্মা সেতুকে ঘিরে আলোচনা সমালোচনার পর্ব। এরকম একটা বড় ক্যানভাসের উদ্বোধনী ইভেন্টে কেউ অন্তর্ঘাত করতে পারে এবং সেতুকে নাশকতার নিশানা বানাতে পারে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক – ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশঙ্কা কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক নয় মোটেই।

More Articles