জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ‍্য নয়! কেন এই দাবি উঠেছিল 'জনগণমন' নিয়ে

National Anthem: কবিগুরু নিজের যে সৃষ্টি মানুষকে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা শুধু তাঁকে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসাই এনে দেয়নি, একই সঙ্গে এনেছে লাঞ্ছনা, অপমান।

১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। হেমন্ত কালে শীতের আমেজ বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে তখন। এমন এক বিকেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোড়ার গাড়িতে শান্তিনিকেতন সফরে বেরিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল চৌপাহাড়ির জঙ্গলে শাল এবং দেবদারু গাছ দেখতে যাবেন। শোনা যায় যে, তাঁর যাত্রাপথে একটা পোস্ট অফিস ছিল। তিনি পোস্ট অফিস পেরিয়ে যাওয়ার সময় পোস্ট অফিসের কর্মী তাঁকে ডেকে গাড়ির কাছে আসেন। তারপর সেই কর্মী কবিগুরুকে একটা টেলিগ্রাম এগিয়ে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেই টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে পরে পড়বেন বলে নিজের জোব্বার পকেটে রেখে দিয়েছিলেন। তাই দেখে কর্মী বললেন যে, সেই টেলিগ্রাম বিদেশ থেকে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে আগ্রহ প্রকাশ না করলেও উপস্থিত সকলের আগ্রহ দেখে পকেট থেকে টেলিগ্রামটা বের করেছিলেন। লন্ডনের একটি ঠিকানা থেকে কবিগুরুর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে টেলিগ্রামটা পাঠানো হয়েছিল। সেই টেলিগ্রামে লেখা ছিল যে, সুইডিশ অ্যাকাডেমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাহিত্য বিভাগে সেই বছরের নোবেল পুরস্কার দিতে চাইছে। কবি যেন পুরস্কার স্বীকার করে তার জবাব পাঠান। 'গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে'- এই খবর খুব দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ার গতির সঙ্গে মানুষের আনন্দের পরিমাণ যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছিল। যদিও সবাই কবিগুরুর সাফল্যে খুশি হতে পারেনি।

১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র প্রথম ভারতীয় হিসেবে নয়, এশিয়ার প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাই পুরস্কারপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে কবিগুরুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে যে সাহিত্যিকরা নোবেল পেয়েছিলেন, তাঁরা মূলত সাদা চামড়ার ইউরোপীয় ছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তি সম্পর্কে বহু ইউরোপীয় নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। তাঁদের মনে হয়েছিল যে, বহু যোগ্য সাহিত্যিককে ব্রাত্য করে রবীন্দ্রনাথকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এমনকী, এক ইংরেজি দৈনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাওয়া এই পুরস্কারের পিছনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক ভূমিকা দেখানোর চেষ্টা করেছিল। এছাড়া লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে গর্ডন রে ইয়ং লিখেছিলেন যে, এমন এক অযোগ্য সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, যাঁর প্রথম নাম ঠিক করে উচ্চারণ করা যায় না। তাঁর লেখা ইউরোপ এবং আমেরিকার খুব কম মানুষই পড়েছে এবং তাঁর থেকেও কম মানুষ তাঁর নাম জানে।

আরও পড়ুন: ক্রিকেটার কবিগুরু! যে রবীন্দ্রনাথকে আজও চেনেই না বাঙালি

সমস্ত আনন্দ, আবেগ, সমালোচনার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অবিচল। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকে পাঠানো অসংখ্য চিঠির উত্তর দেওয়ার পরে তিনি তার বন্ধুকে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে নিজের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন, কারণ তাঁর বন্ধু রথেনস্টাইন প্রথম তাঁর সাহিত্যের নমুনা সুইডিশ অ্যাকাডেমির কাছে পাঠিয়েছিলেন। কবিগুরু তাঁর পুরস্কারের সম্পূর্ণ অর্থ তাঁর প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য ব্যয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর নোবেল পদক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ২০০৪ সাল অবধি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনের একটি ঘরে রাখা ছিল। ২৬ মার্চ, ২০০৪ সালে রবীন্দ্র ভবনের সেই ঘরের তালা খুলতে দেখা যায় যে, অন্যান্য বহু মূল্যবান জিনিসের সঙ্গে চুরি গিয়েছে সেই বিখ্যাত নোবেল পদক। নোবেলপ্রাপ্তি থেকে নোবেল চুরি যাওয়া, দু'টি আলাদা শতাব্দীতে হলেও দুটো ঘটনার মধ্যে একশো বছরের ব্যবধান ছিল না। চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তার গাফিলতির কথাও জানা যায়। স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় সংস্থা এই চুরির তদন্ত করেছিল। যদিও কিছু মানুষ প্রাথমিকভাবে গ্রেফতার হলেও কয়েকজনের নাম ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। বাঙালির সেই গর্বের নোবেল যেন কোনও গভীর অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে।

কবিগুরু নিজের যে সৃষ্টি মানুষকে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা শুধু তাঁকে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসাই এনে দেয়নি, একই সঙ্গে এনেছে লাঞ্ছনা, অপমান। জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তাঁকে বহু মানুষের বহু ব্যঙ্গ এবং সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিগত বছরেও তাঁর রচিত ভারতের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। একাংশের ভারতীয়, তার মধ্যে কিছু বাঙালিও ছিলেন, তাঁরা বলতে শুরু করেন যে, 'জনগণমন' ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে থাকা উচিৎ নয়; কারণ এই রচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে লিখেছিলেন। এই ধরনের দাবি থেকেই বোঝা যায় যে, কিছু মানুষ বাস্তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কতটা অজ্ঞানতার অন্ধকারে। জনগণমন-র মূল কবিতা 'ভারত ভাগ্যবিধাতা'-র একটি পংক্তিতে 'স্নেহময়ী তুমি মাতা' সম্বোধন রয়েছে। এই সম্বোধন পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে হতে পারে কখনও?

রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর লেখা অথবা রচনা সম্পর্কে উদাসীন থাকার কারণেই এই ধরনের বক্তব্য পেশ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় এই বিতর্ক যখন দানা বাঁধে, তখন নিজের লেখা একটি চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, কখনওই পঞ্চম জর্জ অথবা কোনও রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে তাঁর এই রচনা নয়। সেই চিঠি অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল রচনা পড়লে কোনও মানুষ এই আজগুবি যুক্তি মানতে পারে না। এই উদাসীন মনোভাবের কারণেই হয়তো নোবেল পদক চুরি গেলেও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিষ্ণু দে-র ভাষায় বলতে গেলে, বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানে শুধু পঁচিশে বৈশাখ এবং বাইশে শ্রাবণ। বাঙালির এই উদাসীন মনোভাব এবং নিজের ইতিহাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই ধ্বনিত হয়েছে বিদ্রুপ, "সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী /রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।"

তথ্য ঋণ: ইন্ডিয়া টিভি, ইন্ডিয়া ইন পিক্সেল

More Articles