কোভিডের টিকা কেন বেশিদিন কাজ করে না? বুস্টার ডোজ কি সত্যিই জরুরি?

মহামারী শুরু হওয়ার পর আমাদের সবার মনেই আশা ছিলো, হয়তো কোভিডের ভ্যাকসিনই পারবে সুদিনকে কাছে আনতে। হয়তো শেষ হবে এই অতিমারীর তাণ্ডব আর মৃত্যু মিছিল। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোভিড ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ় নেওয়ার পরেও বুস্টার ডোজ় নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এমনকি বিভিন্ন দেশে বুস্টার ডোজ় নেওয়া শুরুও হয়ে গেছে। আবারও এও দেখা যাচ্ছে বুস্টার ডোজ় নেওয়ার পরে, কেউ কেউ আক্রান্ত হচ্ছে কোভিডে। কোভিড পরবর্তী মৃত্যুর ঘটনাও চোখে পড়ছে, দুটি ডোজ় নেওয়ার পরেও। এদিকে তো আমরা দেখি টিটেনাস, টাইফয়েড, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস কিংবা হেপাটাইটিস এ-এর বিরুদ্ধে এদের নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন চিরকালীন ভাবে কাজ করে। স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন জাগে মনে, তাহলে কোভিডের ভ্যাকসিন কাজ করে না কেন? তবে বুস্টার ডোজ় বা কোভিড ভ্যাকসিন কি ভাঁওতা পুরোই? এই প্রশ্ন তো আমাদের অনেকের মনেই জাগছে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এসে আমাদের কয়েকটা বিষয় শুরুতেই মাথায় রাখতে হবে।

প্রথম কথা, নোভেল করোনা ভাইরাস  খুব দ্রুত নিজের রূপ বদলাচ্ছে। অর্থাৎ, নিজের জিনে গঠনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন ঘটিয়ে সে তার চরিত্র ক্রমাগত বদলে চলেছে। মিউটেশন হল নোভেল করোনা ভাইরাসের দ্বারা আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেন্জ, যার ফলে কিছুতেই আমরা তাকে ভ্যাকসিন দিয়ে কাবু করতে পারছি না। আর ঠিক এখানেই ভ্যাকসিন বা বুস্টার শটের কার্যকারিতা নিয়ে আপনার, আমার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।

কেন এবং কী ভাবে এত দ্রুত রূপ বদলাচ্ছে নোভেল করোনা ভাইরাস?

নোভেল করোনা ভাইরাসের জেনেটিক বস্তু হল আরএনএ বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। আরএনএ-তে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন, ইউরাসিল নামের চারটে নাইট্রোজেন বেস বিভিন্ন ক্রমে সাজানো থাকে এবং নাইট্রোজেন বেসের এই ক্রম একটি জীব (ভাইরাসের ক্ষেত্রেও নিয়মের অদলবদল নেই) থেকে অন্য জীবে আলাদা। অর্থাৎ এই ক্রমগুলি নোভেল করোনা ভাইরাসে যে ভাবে আছে, অন্য কোনও ভাইরাসে তা একই হবে না।

 যখন নাইট্রোজেন বেসের এই ক্রমগুলির একটু অদল-বদল হয়, তখনই ঘটে মিউটেশন। দেখা যাচ্ছে আরএনএ ভাইরাস, যেমন নোভেল করোনা ভাইরাসে মিউটেশনের ঘটনা ব্যপক ভাবে ঘটে। এর একটাই কারণ, যখন ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির সময়ে একটি আরএনএ গুলির প্রতিলিপি বা কপি তৈরি হয়, সেই প্রতিলিপিকরণের সময় নাইট্রোজেন বেসেগুলিকে সঠিক ক্রমানুযায়ী বসানোর সময় ভুল হতে পারে। আর এই ভুল শুধরে দেওয়ার জন্যে আরএনএ ভাইরাসে দেহে কোনও পদ্ধতি নেই। অন্যদিকে ডিএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে, ডিএনএ-এর প্রতিলিপিকরণের সময় ভুল শুধরোনোর পদ্ধতি কোষের মধ্যেই থেকে থাকে। এদিকে আরএনএ ভাইরাস ক্রমাগত মিউটেট হতে থাকে, তার দেহে সেই ভুল শুধরে দেওয়ার কোনও পদ্ধতি নেই বলে।

আর এই মিউটেশনের জন্যেই ভাইরাসের এক-একটি স্ট্রেইন কখনও বা নিজের রোগ সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ায়, কখনও বা কোভিডের শারীরিক প্রভাবকে প্রকট করে মারণরূপ ধারণ করে।

নোভেল করোনা ভাইরাসের মিউটেশনের পিছনে কিন্তু আরও একটি কারণ আছে। আমরা কোভিডের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন নিয়ে, সাময়িক হলেও কিছুটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছিলাম। অন্তত ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে, নোভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি তার প্রমাণ। এইবার আমরা যদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলি, নোভেল করোনা ভাইরাস আর পারবে না আমাদের শরীরে ঢুকতে, আর তা হলে তার বংশবিস্তারও বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে, তাকে আরও শক্তিশালী হতেই হবে, তাকে মিউটেশনের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা অর্জন করতে হবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দেওয়ার।

অন্যান্য ভাইরাসের রূপ কি এত দ্রুত বদলায়?

তা নির্ভর করছে ভাইরাসটির জিনের উপর, তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর এবং আমরা সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কখন এবং কতটা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলছি তার উপর। ডিএনএ আছে এমন ভাইরাসে মিউটেশন চট করে হয় না, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন হয় অত্যন্ত দ্রুত। নোভেল করোনা ভাইরাসের মত, ইনফ্ল্যুয়েন্জা় ভাইরাসেও আরএনএ থাকে। মজার বিষয় হল, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নোভেল করোনাভাইরাসের থেকে চারগুণ বেশি দ্রুত মিউটেট করে।  আবার এদিকে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসে ডিএনএ থাকে। এই ভাইরাস  মানুষের সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের জন্যে দায়ী। মিসেলস, মাম্প্স, রুবেলা ইত্যাদি ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিন্তু মিউটেশন খুব বিরল একটি ঘটনা। দেখা যাচ্ছে, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন দশ বছর কার্যকরী থাকে।

তবে কেবল ভাইরাসের জিনের প্রকৃতি-ই নয়, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে কিন্তু রূপ বদলাচ্ছে বিভিন্ন ভাইরাসের। গাছপালা কাটার ঘটনা বাড়ার সাথে-সাথে আমরা বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শে আসছি অনেক বেশি। ফলে যে সমস্ত ভাইরাস কেবল সেই বন্যপ্রাণীদের শরীরেই রোগ সৃষ্টি করতে পারত, তারা এই পরিবর্তিত পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে, নিজেদের চরিত্র বদলে মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা অর্জন করছে। ব্যাট করোনা ভাইরাসই তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। গবেষকদের মতে অদূর ভবিষ্যতে প্রজাপতি, ব্যাঙ, কিংবা টিকটিকির মত প্রাণীর শরীরে বাসা বাঁধা ভাইরাসও আমাদেরকে আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করবে।

কেন কোভিড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা খুব সাময়িক?

ভ্যাকসিনের কার্যকারীতা নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের উপর। প্রথমত, সেই নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কত দ্রুত আমরা নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হারাই এবং আমাদের শরীরে কত দ্রুত ভ্যাকসিন থেকে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি নষ্ট হয়ে যায়; দ্বিতীয়ত, ভাইরাসটি কত দ্রুত মিউটেট করে, বা আদৌ মিউটেট করে কি-না; তৃতীয়ত, ভৌগোলিক ভাবে কোনও অঞ্চলে সংক্রমণ ঘটেছে।

মিউটেশনের সঙ্গে ভ্যাকসিন বা বুস্টার ডোজের কার্যকারিতার কী সম্পর্ক?

যেহেতু নোভেল করোনাভাইরাস খুব দ্রুত মিউটেট করছে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তারা ক্ষমতা অর্জন করছে ভ্যাক্সিনকে ফাঁকি দেওয়ার। প্রতিবেদনে শুরুতেই অলোচনা করা হয়েছে, কোভিডের মত আরএনএ ভাইরাস কত তাড়াতাড়ি মিউটেট করে। অন্যদিকে ডিএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। আর সেই জন্যেই, প্রতিবার এক-একটি মিউটেশন ঘটা নোভেল করোনা ভাইরাসের স্ট্রেইনকে একটি নির্দিষ্ট কম্পানির ভ্যাকসিন প্রতিরোধ করবে কি  আদৌ, তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই জন্যেই বুস্টার ডোজ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও থেকে থাকে, যদি আগে নেওয়া দুটি ডোজ নোভেল করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট স্ট্রেইনকে প্রতিহত না করতে পারে।

ঠিক এত দ্রুত মিউটেশন হওয়ার কারনেই ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনও একটি নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন নেই। ইনফ্লুয়েন্জা়র যে সময় ঘটে, সেই সময়ে কোনো স্থানে ঠিক কোন ইনফ্লুয়েন্জা় স্ট্রেইনটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করেই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।

 কত দ্রুত ভাইরাসটির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছি?

দেখা যাচ্ছে মিসলসের ভ্যাকসিন প্রায় আজীবন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, অন্যদিকে চিকেনপক্সের ভ্যাক্সিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা দশ বছর। কিন্তু তা কেন?

একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন নিলে, ভ্যাকসিনটি শরীরে গিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করে, যা কেবল ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধেই লড়তে পারে এবং তাদের বিরুদ্ধেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এটি ঠিক তালা-চাবির মত বিষয়। নির্দিষ্ট চাবি যেমন একটি নির্দিষ্ট তালাকেই খুলতে পারে, অন্য তালাকে নয়; তেমন নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধেই লড়ে।

কিন্তু সমস্যা হয় যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রক্তে তৈরি হওয়া সেই অ্যান্টিবডির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। শরীরে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অ্যান্টিবডি থাকতেই হবে, সেই নির্দিষ্ট ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে। দেখা যাচ্ছে মিসলস, চিকেনপক্স, ডিপথেরিয়া বা ভ্যাকসিনিয়া কারোরই বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির পরিমাণ খুব বেশি কমে না সময়ের সাথে সাথে। ঠিক এই সমস্ত কারণেই  হেপাটাইটিস এ-এর ক্ষেত্রে তা কমে যায় প্রায় কুড়ি বছর পরেই, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ও টিটেনাসের ভ্যাকসিন দশ বছর পরে কার্যক্ষমতা হারায়। আর অন্যদিকে খুব দ্রুত মিউটেট করে বলে কোভিড-১৯ বা ইনফ্লুয়েন্জার ভ্যাক্সিন, কারোরই কার্যক্ষমতা এক বছরও নয়।

তবে আশার বিষয় হল ইম্পিরিয়াল কলেজ, লন্ডনের গবেষকরা এখন নজর দিয়েছেন এমন ভাবে কোভিডের ভ্যাকসিন গড়ে তুলতে, যাতে কোভিড১৯ ভাইরাস যতই রূপ বদলাক, তাকে কাবু করা সম্ভব হবে। আর তার জন্যে বারবার টিকাও নিতে হবে না আমাদের।

More Articles