চিনের শত্রুতা নাকি পরপর ভুল সিদ্ধান্ত, কেন দেউলিয়া শ্রীলঙ্কা

ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে সে দেশের মানুষ দু'বেলা খেতে পেলে এখন নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করছেন। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এরকম খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন শ্রীলঙ্কা কখনো হয়নি। দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রে কান পাতলেই শোনা যাবে হাহাকার। সারা দেশে শুরু হয়ে গিয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ। জ্বালানি তেল এবং খাদ্য কেনার জন্য কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। একটা সময়ে শ্রীলঙ্কায় যে চালের দাম ছিল ৫০ টাকা সেই চাল এখন প্রায় ৫০০ টাকায় বিকোচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট কার্যত বেসামাল করে তুলেছে এই দ্বীপরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে। 

পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণের ভার একেবারে মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় তারা মেটাতে পারছে না। অর্ধেকের বেশি জিনিস এখন গোটা শ্রীলঙ্কায় বাড়ন্ত। কাগজের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শ্রীলঙ্কায় একেবারেই শেষ। তাই লাটে উঠেছে সেদেশের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষাদান। এমনকি কাগজ এবং কালি দুটির অভাবে শ্রীলঙ্কায় সমস্ত পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ হতে পারছে না কাগজ এবং কালির অভাবে। তার মূল কারণ, কাগজ এবং কালি দুটি জিনিস শ্রীলঙ্কাকে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই মুহূর্তে তাদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা একেবারেই নেই, তাই এই জিনিস আমদানী করার ক্ষমতা তাদের কাছে শূন্য। ভরসা শুধুমাত্র ইন্টারনেট, কিন্তু তাও খুব একটা বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পর্যন্ত থাকছে লোডশেডিং। এমনকি রাস্তার সমস্ত আলোও বন্ধ করে রাখছে সরকার, যাতে যতটা সম্ভব জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব হয়। জেনারেটর ব্যবহার করার জন্য যে পরিমাণ তেল ব্যবহার করতে হয় সেই টুকুও নেই ওই দেশের কাছে। তাই কার্যত অন্ধকারে ডুবে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।

জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে এই দেশে। এমনিতেই রাশিয়া এবং ইউক্রেন দুটি দেশের যুদ্ধে পৃথিবীর তৈল ভান্ডারে প্রভাব পড়েছে। তার ওপর অর্থনীতি একেবারে বেসামাল। তাই জ্বালানি তেলের জন্য সবথেকে বেশি হাহাকার বর্তমানে শ্রীলঙ্কায়। এক বোতল তেল সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে একটা পেট্রোল পাম্পে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রোলপাম্পে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। জ্বালানি কেনার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে নেই। ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ ইতিমধ্যেই ২৫০ মিলিয়ন ডলার ধার হয়ে গিয়েছে শ্রীলংকার। তাই ইরান তাদেরকে তেল দিতে নারাজ। শ্রীলংকার চিকিৎসার পরিষেবা এবং হাসপাতাল পরিষেবা কার্যত ভেঙে পড়েছে। সামান্য প্যারাসিটামল ওষুধ কেনার জন্য লাইন দিতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষকে। একেবারে গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল টেস্ট ছাড়া অন্য কোন টেস্ট করা হচ্ছে না।

বেসরকারি সমস্ত হাসপাতলে আলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে কারণ শ্রীলংকার কাছে জ্বালানি নেই। সার্জারি এই মুহূর্তে বন্ধ। খুব জরুরী কোন সার্জারি কিংবা কোন মেডিকেল টেস্ট ছাড়া বাকি কোন টেস্ট করা হচ্ছে না শ্রীলঙ্কায়। রোগীদের কার্যত ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কার জেনারেল হাসপাতালগুলিও। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কা পড়ল কেন, এই নিয়েই আজকের বিশ্লেষণ।

গৃহযুদ্ধ

শ্রীলঙ্কাতে গত ২০০৯ পর্যন্ত লাগাতার গৃহযুদ্ধ চলেছে। গৃহ যুদ্ধের ফলে এখনো পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার আর্থিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো জায়গায় নেই। ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কা আবার নিজের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছিল, কিন্তু এখনো তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে, যার জেরে এখনো শ্রীলঙ্কায় এই গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি একেবারে থেমে গিয়েছে বলা যায়না। ২০০৯ সালে যে সরকার শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতায় এসেছিল, তারা এই গৃহযুদ্ধ সামাল দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল, তার ফলে কিছুটা লাভ হয়েছিল বটে। কিন্তু ২০১৯ সালের সরকার এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বেসামাল করে তোলে।

নতুন সরকারের ব্যর্থতা 

বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল আছেন গোটাবায়া রাজাপাক্ষ। ২০১৯ সালে যখন নির্বাচন হয় সেই সময়ে তিনি তৎকালীন সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন তিনি। ওই বছর নভেম্বর মাসে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দেশে ভ্যাট এবং অন্যান্য কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান মূলত এই নিয়েই ছিল। তার প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য তিনি পুরো শ্রীলঙ্কায় কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। ভ্যাটের পরিমাণ সরাসরি ১৫ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসা হলো। 

এই ভ্যাট এবং ট্যাক্স কমানোর মূল কারণ ছিল অর্থনীতিতে গতি বৃদ্ধি করা। কিন্তু, সেই উদ্যোগে জল ঢেলে দেয় ২০২০ সালের করোনাভাইরাস প্যানডেমিক। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে (বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভাই) ক্ষমতায় এসে এই একই ধরনের উদ্যোগ নেন। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে কিছুটা গতি এনেছিলেন তিনি। সেই আলোকেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট একই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইলেন। কিন্তু এবারে ফল হল বিপরীত। কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হলো বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারী। সেদেশের অর্থনীতিবিদরা ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জানিয়ে ছিলেন, আয় কর এবং ভ্যাট যদি কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। 

হল কিছুটা সে রকম। এতটা পরিমাণ ট্যাক্স একসাথে কমিয়ে দেওয়ার ফলে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হলো। এমনিতেই শ্রীলঙ্কা সরকারের মাথায় ধার ছিল। কিন্তু রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় আরো ঋণগ্রহণ করতে হলো সরকারকে। ট্যাক্স কমানোর ফলে সরকারের আয় কমায়, ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আরো বেশি করে গ্রাস করতে শুরু করলো তৎকালীন সরকারকে। ফলে সব মিলিয়ে অর্থনীতির উপর প্রচন্ড চাপ।

ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা 

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শ্রীলঙ্কার অর্থভাণ্ডার এর উপরে চাপ বাড়তে শুরু করলো। গত ১৫ বছর ধরেই যদিও এই সমস্যা শুরু হয়েছে। দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদার ঋণ নিতে শুরুকরেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। সার্বভৌম চুক্তি বা বন্ড  ব্যবহার করে ২০০৭ সালে প্রথমবার অর্থ জোগাড় করেছিল তারা। তারপরে লাগাতারভাবেই বন্ড ব্যবহার করে অর্থ আদায় শুরু করে শ্রীলঙ্কা। অর্থনীতিবিদরা জানান, যদি কোন দেশে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হয় তাহলে এই ধরনের সার্বভৌম বন্ড বিক্রি করতে হয়।

আরও পড়ুন-৩৪ শতাংশ হারে ডিএ অন্তত ১ কোটি ১৫ লক্ষকে, হাতে পাবেন ঠিক কত টাকা!

এই ধরনের বন্ড বিক্রি আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে সেই দেশটিকে আরও খারাপ জায়গায় নিয়ে যায়। শ্রীলংকা লাগাতার ভাবে এই একই জিনিস করে এসেছে। কিভাবে অর্থ পরিশোধ করা হবে সেই ব্যাপারে চিন্তা করেনি সেই দেশের সরকার। ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থভাণ্ডার কার্যত ফুরিয়ে এসেছে। তার পাশাপাশি বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়েও নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার।

ঋণ পরিশোধে বেহাল অবস্থা শ্রীলঙ্কার 

আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড মারফত শ্রীলংকা ইতিমধ্যেই সাড়ে ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন দেশ থেকে। এছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক, ভারত সহ একাধিক দেশ থেকে কম বেশি ঋণ গ্রহণ করেছে তারা। দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করেছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এই অবস্থায় চলতি বছরে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে অন্যান্য দেশকে। এরমধ্যে বৈদেশিক ঋণ ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বভাবতই এই বছরে এত পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় এই দেশটির পক্ষে। কিন্তু শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, এই সমস্ত ধারণা সঠিক নয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তরফ থেকে সাফাই গাওয়া হয়েছে, গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ড ব্যবহার করে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে সেখান থেকে আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইতিমধ্যেই পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসল রিপোর্ট বলে, সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। ফলে দেশটির আর্থিক ভান্ডারে টান পড়েছে। এই ধরনের বন্ড বিক্রি হয়ে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে জ্বালানি তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানী করা সম্ভব নয়। এই কারণেই জ্বালানি তেল এবং কাগজ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ওই দেশে। 

সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে দেশে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করলেন। ফলে আরও সমস্যায় পড়ে গেল শ্রীলঙ্কা। এই মুহূর্তে চাল এবং অন্যান্য সামগ্রী শুধুমাত্র সরকারের তরফ থেকে সাপ্লাই করা হচ্ছে নাগরিকদের। মৌলিক খাদ্যপণ্যের সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণে পৌঁছে গিয়েছে। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট ঋণ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে পৌঁছেছিলেন চীনের কাছে। সেখান থেকে কিছুটা টাকা সুবিধা পাওয়া গেলেও, এখন সেই চীনের জন্যই সমস্যার মধ্যে পড়ে গিয়েছে শ্রীলংকা।

চিনের প্রভাব

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যখন রাজাপাকসে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে চীনের কাছে দরবার করবেন সেই সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাদেরকে অর্থনৈতিক সাহায্যের আশ্বাস দেন। সেই সময়ে ঋণ নিয়ে বেশ কিছুটা খুশি ছিল শ্রীলংকা। কিন্তু, কয়েক মাস যেতে না যেতেই চীনের আসল রং বেরিয়ে পড়ে শ্রীলংকার সামনে। চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হলেও, চিনের ছিল একাধিক শর্ত। চড়া সুদে তারা দিয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। প্রথমে শ্রীলংকা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের দেশে যে সমস্ত পণ্য তৈরি হয় সেই সমস্ত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে চীনের এই ধার পরিশোধ করবে তারা। কিন্তু শ্রীলংকার এই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। 

শ্রীলঙ্কায় যে সমস্ত জিনিস তৈরি হয় তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল নারকেল এবং চা। এই দুটি জিনিস বিদেশে রপ্তানি করে বেশ ভালো মত রোজগার করতে পারে শ্রীলঙ্কা। তার পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি বেশ বড় কাপড়ের ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু চীনের হস্তক্ষেপে এই কাপড়ের ইন্ডাস্ট্রির চরম দৈন্যদশা বর্তমানে। চিন নিজেদের বাজার কখনোই অন্যের হাতে তুলে দিতে চায় না। এই কারণে শ্রীলংকার কাপড়ের মার্কেটকে কার্যত ধ্বংস করে দিয়েছে চিন। পড়ে থাকছে চা এবং নারকেলের ইন্ডাস্ট্রি। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে এই দুটি ক্ষেত্রেও বিক্রি কমেছে শ্রীলঙ্কার। অন্য দিকে ইরানের কাছে যে পরিমাণ ঋণ রয়েছে তা পরিশোধ করার জন্য প্রতিবছর ৫ মিলিয়ন ডলার পরিমাণ চা ইরানে রপ্তানি করার শর্ত গ্রহণ করেছে শ্রীলঙ্কা। তাই এই মুহূর্তে চায়ের বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানি কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত। 

অন্যদিকে চিনের তরফ থেকেও চাপ দেওয়া হচ্ছে টাকা শোধ করার জন্য। এই অবস্থায় টাকা শোধ করতে না পেরে চিনের শর্ত গ্রহণ করে তাদের সমস্ত বন্দর চিনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে কার্যত বাধ্য হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এইখান থেকেও চরম সমস্যার মধ্যে পড়েছে এই দেশটি। কারণটা হলো, সমস্ত রকম রপ্তানি কিন্তু এই মুহূর্তে চীনের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। তাই শ্রীলঙ্কার হাতে টাকার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে এই রপ্তানি এবং আমদানি ক্ষেত্র থেকেও। 

পর্যটন এবং রেমিট্যান্স খাতে বিপর্যয় 

শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রায় বড় যোগান আসে দেশটির পর্যটন ক্ষেত্র থেকে। এই দেশটিতে বহু বিদেশী পর্যটকরা ঘুরতে যান। সেখানে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচা করেন তারা। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পরে দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারওপর মহামারী শুরুর আগে চিন থেকে সবথেকে বেশি পর্যটক আসতো শ্রীলঙ্কায়। কিন্তু এই মুহূর্তে যেহেতু বন্দর শ্রীলঙ্কার হাতে নেই, তাই বন্দর থেকে আসা এবং যাওয়ার কোনো টাকা শ্রীলঙ্কা পাচ্ছে না। উপরন্তু চিনে করোনাভাইরাস সবথেকে বেশি ছড়িয়ে পড়ার কারণে চিনের উপরে কঠোর বিধিনিষেধ রয়েছে। এই কারণে চিন থেকে পর্যটক আসতে পারছেন না শ্রীলঙ্কায়। এর ফলে দেশটির পর্যটন খাতে কার্যত বিপর্যয় নেমে এসেছে। এছাড়াও সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় দুটি বোমাবাজিতে মৃত্যু হয়েছে বহু বিদেশী পর্যটক এর। তাই এই বিষয়টিও শ্রীলঙ্কার পর্যটন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে। 

এছাড়াও শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য একটি বড় জায়গা হল বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলংকার নাগরিকদের পাঠানো বিদেশি ডলার এবং ধিরাম। শ্রীলঙ্কার যে সমস্ত মানুষরা মধ্যপ্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করেন তারা শ্রীলঙ্কায় তাদের পরিবারকে টাকা পাঠান। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পরে এই টাকা পাঠানোর পরিমাণ কিছুটা হলেও কমে গিয়েছে। সেখানকার থাকার খরচ অনেকাংশেই বেড়েছে, এই কারণেই হয়তো তাদের টাকা পাঠানো অনেকাংশে কমেছে। করোনাভাইরাস মহামারী আগে পর্যটন এবং রেমিটেন্স থেকে শ্রীলঙ্কা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারত। কিন্তু এখন সেই আয় কার্যত তলানীতে।

অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প 

গত ১৫ বছরে সিঙ্গাপুরের মতো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে টক্কর দেবার জন্য এই দ্বীপরাষ্ট্রে গ্রহণ করা হয়েছিল একাধিক মেগা প্রকল্প। নানা ধরনের সমুদ্র বন্দর, বিমানবন্দর এবং রাস্তা সহ আরো নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। রাজধানী কলম্বোর কাছে সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামের একটি শহর তৈরি শুরু করেছিলো শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু এই প্রকল্প শেষ হতে হতে প্রায় ২৫ বছর সময় লাগবে এবং এর বাজেট প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হংকং দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য এই শহর তৈরি করা শুরু করেছিল শ্রীলংকা। তবে আদতে কিন্তু এই প্রকল্প শ্রীলংকার মাথায় আসেনি। শ্রীলঙ্কাকে এই প্রকল্পের লোভ দেখিয়েছে চীন। চীনের কাছে যেহেতু সমুদ্র বন্দরের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত সেই কারণে সাংহাইয়ের মত শহরের লোভ দেখিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য শ্রীলংকার উপরে চাপ দেয় চিন সরকার।

ওই দেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সমস্যা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলংকা ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। বিপুল অর্থখরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প এখনো অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। এই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প রীতিমতো কোমর ভেঙে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির। কিছু কিছু বড় বড় প্রকল্প শ্রীলঙ্কার জন্য প্রায় শ্বেতহস্তীতে পরিণত হবার জোগাড়। হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর এবং বিমানবন্দর তৈরি করার কোন প্রয়োজন ছিলনা শ্রীলংকার কাছে। এই দুটি সমুদ্র বন্দরও বিমানবন্দর খুব একটা ব্যবহার হয় না। এই কারণে এই দু'টি প্রকল্প অত্যন্ত ভাবে অলাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলংকার জন্য।

গত ১০ বছরে চিনের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে শ্রীলংকা। যদি শুধুমাত্র চিনের ঋণকে দোষারোপ করলে হবে না, চীনের থেকে ঋণ নেওয়ার সহজ, তাই তাদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিল শ্রীলঙ্কা। আসলে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বন্ড গ্রহণ করে ইসু করেছে শ্রীলঙ্কা। এই সমস্ত অর্থ অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যবহার করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। শ্রীলংকার মত একটি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র থেকে এই সমস্ত প্রকল্পে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় না। শ্রীলংকার সবথেকে বড় ঋণদাতা হল চিন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন মুদ্রাবাজার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে চিন। এছাড়াও জাপান এবং ভারতের থেকেও কিছু পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তারা। এই অবস্থায় ঋণগুলি শোধ দেবে কে? সেই থেকে কার্যত চিন্তা-ভাবনা করেনি শ্রীলঙ্কা। যার ফল তাদের এখন ভুগতে হচ্ছে।

অর্গানিক চাষে বিপর্যয় 

২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক চাষ শুরু করেন। যে দেশের মাটি অত্যন্ত লোনা, সেখানে অর্গানিক চাষ কিভাবে হবে সেই নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা পর্যন্ত গ্রহণ করেননি তিনি। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো সরকারের তরফ থেকেই। ইউক্রেন এবং রাশিয়া থেকে সার আমদানি বন্ধ করল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে ভালো প্রভাব কতদূর বরং উল্টো প্রভাব পড়ল চাষের ক্ষেত্রে। গোটা শ্রীলঙ্কা জুড়ে শুরু হলো পঙ্গপালের উৎপাত। এছাড়াও এই ধরনের মাটিতে উচ্চ ফলনশীল ফসল ফলানো সম্ভব নয়, তাই সেই দিক থেকেও বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হল শ্রীলঙ্কা। একসময় চাল উৎপাদনের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু একটা সময় এমন দাঁড়ালো, শ্রীলঙ্কাকে সম্পূর্ণরূপে অন্য দেশের কাছে মুখিয়ে থাকতে হলো চাল আমদানির জন্য। বিগত বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ মিলিয়ন চাল অন্য দেশ থেকে আমদানি করেছে শ্রীলঙ্কা। এখানে চালের দাম হুহু করে বাড়তে শুরু করে ওই দেশে।

এছাড়াও অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল দেশের চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। শ্রীলঙ্কা চা রপ্তানি করে একটা সময় ভালো পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারত। কিন্তু এই অবস্থায় অর্গানিক কৃষি চালু করার ফলে চা উৎপাদন অনেকটা ধাক্কা খায়। কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে আনার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল। কিন্তু এর ফলে দেশের খাদ্য ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করে। অর্গানিক কৃষি চালু করার আগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। এই কারণেই উল্টো ফল হয়েছে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি হয়েছে এবং খাদ্য আমদানি করার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে।

সংকট সামাল দেবার জন্য কি করছে সরকার?

বর্তমান সঙ্কট সামাল দিতে শ্রীলঙ্কার যেটা প্রয়োজন সেটা হল বৈদেশিক মুদ্রা। প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে প্রয়োজন রয়েছে শ্রীলঙ্কার। সে জন্য অনেকে দ্বারস্থ হতে শুরু করেছে এই দেশ। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এর সাথে আলোচনা করতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। আইএমএফ এর কাছে ঋণ পাওয়ার জন্য ১৫ শতাংশ মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে শ্রীলঙ্কা। মার্কিন ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার টাকার মূল্য ২৩০ টাকা। এছাড়াও, চিন এবং ভারতের কাছ থেকে ঋণের আবেদন জানিয়েছে ওই দেশটি। সম্প্রতি ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে কিছু জরুরি খাদ্য, ঔষধ এবং জ্বালানি কেনার। এছাড়াও ভারতের তরফ থেকে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের জন্য পাঠানো হচ্ছে চাল এবং পেট্রোল। 

যেভাবে শ্রীলঙ্কার উপরে চাপ বাড়তে শুরু করেছে সেখান থেকে খুব শীঘ্রই দেশটি বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা শ্রীলঙ্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হতে চলেছে। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন রপ্তানি বৃদ্ধি করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু রপ্তানি বৃদ্ধি করতে গেলে পণ্যের বৈচিত্র্য আনা সবার আগে প্রয়োজন। এই অবস্থায় বৈদেশিক বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রীলংকার জন্য। চিলংকা এমনিতে খুব ছোট রাষ্ট্র, তাই এই দেশে ব্যবসা করা সহজে সম্ভব নয়। এছাড়াও এই দেশের বাজেট এবং জিডিপি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপ্রয়োজনীয়' খাতে খরচ কমিয়ে সম্পূর্ণ রূপে ফোকাশ করতে হবে লাভজনক খাতে। এমন ভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে হয়তো খুব শীঘ্রই এই দেশটি কার্যত দেউলিয়া ঘোষিত হবে বিশ্বব্যাংকের তরফ থেকে।

More Articles