পুরাণেও অনিচ্ছুক স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সঙ্গম অনুচিত, আইন কেন রক্ষাকবচ দেয় বৈবাহিক ধর্ষণকে?

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বহু দেশেই বৈবাহিক বলাৎকার নিষিদ্ধ। সেই ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধের তকমা দিয়েছিল।

যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে বলেন যে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলা যাবে না, তাঁদের বৌদ্ধিক, যৌক্তিক ও মানবিক বৃত্তি নিয়ে তীব্র সন্দেহ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বহু দেশেই বৈবাহিক বলাৎকার নিষিদ্ধ। সেই ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধের তকমা দিয়েছিল। অথচ এখনও বৈবাহিক ধর্ষণ কি অপরাধ, এই প্রশ্ন নিয়ে উত্তাল দেশ।

 

 

এই সংক্রান্ত একটি মামলায় রায় নিয়ে একমত হল না দিল্লি হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চরায় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হলেন বিচারপতিরা। ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি রাজীব শাকধের বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে অভিহিত করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এটাও জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী একজন যৌনকর্মীর যৌন সম্পর্কে না বলার অধিকার রয়েছে, কিন্তু একজন বিবাহিত মহিলার এই অধিকার থাকবে না কেন?

 

 

বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্ককে কি আদৌ ধর্ষণ বলা যায়? অনেকের মতে, বৈবাহিক ধর্ষণের সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নেই। বরং এই ধারণাটি পশ্চিমি সংস্কৃতি থেকে আমদানি করা হয়েছে। এমনকী, আইনের চোখেও বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ নয়। কেন নয়? বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে দিল্লি হাই কোর্টে। মামলাকারীদের দাবি, বিয়ের পরেও যদি স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেক্ষেত্রে তা অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে। ধর্ষণের মতো অপরাধে কেন ছাড় দেওয়া হবে স্বামীকে? ধর্ষণ আইনের ব্যতিক্রমী ধারাটি যখন 'অসাংবিধানিক' বলে রায় দিলেন দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি রাজীব শাকধের, তখন ভিন্ন মত ডিভিশন বেঞ্চের অপর বিচারপতি হরি শঙ্করের। তাঁর মতে, ধর্ষণ আইনের ব্যতিক্রমী ধারাটি সংবিধানের পরিপন্থী নয়। কারণ, স্বামী-স্ত্রীর মতপার্থক্যের কারণেই একমাত্র এই ধরনের অভিযোগ ওঠে। যা কখনওই সে অর্থে অপরাধ বলে গণ‍্য করা সমীচীন নয়। এর আগে, বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলায় বৈবাহিক ধর্ষণকে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে রায় দিয়েছিল কেরল হাই কোর্ট। ডিভিশন বেঞ্চে ২ বিচারপতি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, "ভারতে বৈবাহিক ধর্ষণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত নয়। যদিও এই বিষয়টিকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের পর্যায়ে ফেলা হয়।"

 

আরও পড়ুন: সন্তানের জন্মের পিছনে বাবা-মা ছাড়াও থাকবেন তৃতীয় মহিলা! যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথে এই দেশ

 

ঘটনা কী?

আদালত ৩৭৫ ধারার ব্যতিক্রমের সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে চারটি পিটিশনের একটি ক্লচের শুনানি করছিল। অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন (এআইডিডব্লিউএ) অন্তর্ভুক্ত মামলাকারীদের ছাড়াও, আদালত পুরুষদের অধিকার সংস্থা-সহ বেশ কয়েকজন হস্তক্ষেপকারীর কথা শুনেছিল। এছাড়াও সিনিয়র অ্যাডভোকেট রাজশেখর রাও এবং রেবেকা জনের মামলারও শুনানি ছিল।

 

সরকারের অবস্থান?

১২৪-এ আইপিসি (রাষ্ট্রদ্রোহ) ধারার সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে চলা মামলার মতো, কেন্দ্র প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের ব্যতিক্রমের পক্ষে ছিল। কিন্তু পরে তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং আদালতকে জানায় যে, আইনটি তারা পর্যালোচনা করছে এবং বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন এই বিষয়টিতে।

 

সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দেশের ফৌজদারি আইন পর্যালোচনা করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা গঠিত ২০১৯ সালের কমিটিকে আদালতের নজরে এনেছেন।

 

দিল্লি সরকার বৈবাহিক ধর্ষণের ব্যতিক্রম বজায় রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। সরকারের যুক্তি ছিল, স্ত্রীদের দ্বারা আইনের সম্ভাব্য অপব্যবহার থেকে পুরুষদের রক্ষা করা থেকে শুরু করে বিবাহের প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা।

 

বিভক্ত রায় প্রদানের ফল কী?

একটি বিভক্ত রায়ের ক্ষেত্রে, মামলাটি একটি বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি হয়। এই কারণেই বিচারপতিরা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ মামলার জন্য বিজোড় সংখ্যার (তিন, পাঁচ, সাত, ইত্যাদি) বেঞ্চে বসেন, যদিও দুই বিচারকের বেঞ্চ বা ডিভিশন বেঞ্চ অস্বাভাবিক নয়।

 

একটি বিভক্ত রায় যখন বৃহত্তর বেঞ্চে যায়, তখন সেটি নিয়ে হাই কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ বা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যেতে পারে। দিল্লি হাই কোর্ট ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার জন্য আপিলের একটি শংসাপত্র মঞ্জুর করেছে কারণ এই মামলায় আইনের উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন রয়েছে৷ মামলাটি যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে।

 

 

ভারতীয় সংস্কৃতি ছাড়পত্র দেয়?

উপনিষদ যেহেতু শ্রুতি, তাই মনুসংহিতানামক স্মৃতিশাস্ত্রের তুলনায় তার মান্যতা অনেক বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উপনিষদ তথা বেদের শ্লোকগুলির অর্থ গূঢ় ও বহুরৈখিক, সব সময় তাকে আক্ষরিক অর্থে বুঝলে চলবে না। এখানে স্বামী বলতে প্রযতি এবং স্ত্রী বলতে প্রকৃতিকে বোঝানো হয়েছে। জমির কর্ষণ ও ফসল উৎপাদন হল এর উপপাদ্য। যদি আমরা পুরাণের দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব, বিষ্ণুপুরাণে অনিচ্ছুক স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর যৌন সংসর্গকে অনুচিত বলা হয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় সেখানে উক্ত হয়েছেস্বামী অস্নাতা, অসুস্থ, ঋতুমতী, অনিচ্ছুক (নানিষ্টাং), রাগান্বিত, গর্ভবতী, অকামী স্ত্রীকে রমণের প্রস্তাবই দেবেন না। রমণ বা সঙ্গম অনেক পরের ব্যাপার। কামসূত্রএই দেশের একটি প্রাচীন গ্রন্থ। মহর্ষি বাৎস্যায়ন তার লেখক। তিনি ওই গ্রন্থে বলছেন, যৌনতার একটি উদ্দেশ্য কখনও সন্তান উৎপাদন হতে পারে, কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়। স্ত্রীলোক পশুদের থেকে আলাদা কারণ সে সন্তানধারণের উপযুক্ত সময় ছাড়াও রমণে প্রবৃত্ত হয়। পুরুষের মতো নারীও আনন্দের জন্যই যৌনতা চায়। যদি কোনও স্ত্রীলোক বোঝেন যে, তাঁর স্বামী সন্তোষজনক যৌন সঙ্গী নন, তিনি সেই যৌন সঙ্গীকে ত্যাগ করতে পারেন।

 

 

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলাম ধর্মে কোরানের দ্বিতীয় সুরা বাকারার ২২৩ আয়াতের কথা বলে অনেকে দাম্পত্য বলাৎকারকে বৈধ বলতে চান। সেখানে বলা হয়েছে, “তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের শস্যক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাঁদের ব্যবহার করো…” কিন্তু এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিভিন্ন উলেমার বিভিন্ন মত রয়েছে। এখানে যেভাবে ইচ্ছাবলতে সঙ্গমের ভঙ্গি ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। দারুল ইফতাও ফতোয়া জারি করে জানিয়েছে যে বৈবাহিক ধর্ষণ ইসলামে অননুমোদিত। মুসলমান-প্রধান দেশ তুরস্ক, মালয়েশিয়ায় বৈবাহিক বলাৎকার অপরাধ।

 

মোদ্দাকথা হল, দেশদেশান্তর, ধর্ম-ধর্মান্তর, মত-মতান্তর- যাইই থাকুক, স্ত্রী স্বামীর হাতের পুতুল নয় যে আইনের রক্ষাকবচ নিয়ে বা সামাজিক বৈধতার অজুহাতে তাঁকে ধর্ষণ করা যাবে। এর চেয়ে পাশবিক আচরণ আর কী হতে পারে?

 

 

More Articles