প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার বাঁচাতেই নুপুর-ইস্যুতে নীরব মোদি? জানুন আসল কারণ

ভারতের আকাশে সামগ্রিক শঙ্কার কালো মেঘ ভাসিয়ে দিয়েছে বিশ্বের নৃশংসতম জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়দা।

কোথায় থামতে হয়, সেটাও শেখার বিষয়৷ নুপুর শর্মাদের সেই শিক্ষা না দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়াতে বাজারে ছেড়েছে বিজেপি। আর অপরিণত, অর্ধ-শিক্ষিত ভক্তদের হাততালি পেতে পেতে ওই নুপুর শর্মারাও নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে কুকথার স্রোতই হবে তাঁদের রাজনৈতিক উত্তরণের পথ। মুসলিম-বিদ্বেষকেই একমাত্র হাতিয়ার করে বিজেপির উত্থান, এবার ওই হাতিয়ারই ব্যুমেরাং হওয়ায় ঘরে-বাইরে ফেঁসেছে বিজেপি এবং মোদিও।

পয়গম্বর হজরত মহম্মদকে নিয়ে বিজেপি নেতা-নেত্রীর কুকথার কারণে দল হিসেবে শুধুমাত্র বিজেপি ফাঁসলে দেশ বা সমাজের কোনও ক্ষতিই হয়তো হতো না। কিন্তু ভারতের আকাশে সামগ্রিক শঙ্কার কালো মেঘ ভাসিয়ে দিয়েছে বিশ্বের নৃশংসতম জঙ্গি গোষ্ঠী আল-কায়দা। আতঙ্কের চাদরে তলায় গোটা দেশ। এক হুমকি চিঠিতে আল-কায়দা জানিয়েছে দিল্লি, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ এবং মুম্বইয়ে যে কোনও মুহূর্তে আত্মঘাতী হামলা চালানো হবে। গেরুয়া শিবিরের তৈরি করা পরিস্থিতি এই মুহূর্তে এমনই, কেন্দ্রের শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের পাপের মাশুল এখন হয়তো দিতে হবে দেশের অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। বিজেপি নেতা-নেত্রীর অশালীন মন্তব্যে এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়ার মুখে দেশ। আর এবার জঙ্গি-গোষ্ঠীর হুমকি গোটা দেশের কপালে ভাঁজ ফেলল।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, আল-কায়দা ওই চিঠিতে ভারতে আত্মঘাতী হামলা চালানোর সিদ্ধান্তকে ‘পয়গম্বরের সম্মান রক্ষার লড়াই’ বলে উল্লেখ করেছে‌। বলেছে, "যারা আমাদের নবীকে অপমান করেছে, আমরা তাদের শেষ করে দেব। আমাদের বা আমাদের সন্তানদের দেহের সঙ্গে বিস্ফোরক বেঁধে তাদের উড়িয়ে দেব। দিল্লি, মুম্বই, গুজরাত এবং উত্তরপ্রদেশে গেরুয়া সন্ত্রাসবাদীরা তাদের শেষের জন্য অপেক্ষা করুক।’ আদৌ এমন কোনও হামলা হবে কি না তা আন্দাজ করা অসম্ভব হলেও আল-কায়দার এই হুমকি চিঠিকে লঘু নজরে দেখা একদমই ঠিক নয়।

আরও পড়ুন: মুসলিম বিশ্বের চাপে বেকায়দায় ভারত, সামাল দিতে কী অস্ত্র মোদি-শাহর?

নুপুর শর্মাদের কু-মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই সুর চড়া করেছে মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ। ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে কুয়েত ভারতকে পূর্ণ বয়কটের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। যতদিন যাচ্ছে, অস্বস্তি বাড়ছে ভারতের। এখনও স্পষ্ট হয়নি, ঠিক কোন পথে গোটা পরিস্থিতি সামলাবেন মোদি-শাহ। আসলে পুরোটাই নির্ভর করছে একাধিক আরব-রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপর।


ওদিকে প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপির তৈরি এই অস্থির পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভারত সরকার এ-পর্যন্ত ঠিক কী কী করেছে? কোন পথে হেঁটে কেন্দ্রীয় সরকার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছে সমস্যা সমাধানের? চরম বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের জন্য বিজেপির দুই নেতা-নেত্রী, নূপুর শর্মা এবং নবীনকুমার জিন্দালকে দল তথাকথিত ‘শাস্তি’ দিয়েছে৷ কী শাস্তি? দলের প্রাথমিক সদস্যপদ তাঁদের খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি কোন ভাবনায় আশা করছে যে, এতেই গোটা বিতর্ক থেমে যাবে?

বিষয়টি এখন শুধুই বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ ইস্যু আর নেই। দেশের পররাষ্ট্র, বহির্বাণিজ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে সরাসরি জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ওই মন্তব্য করে। সেই পরিস্থিতিতে দল হিসেবে বিজেপি কী সিদ্ধান্ত নিল, তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সরকার হিসেবে কেন্দ্র এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি এখনও পর্যন্ত নীরব। ন্যূনতম পদক্ষেপও ভারত সরকার করেনি। হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কুকথার জেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা বিদেশি রাষ্ট্রগুলি কি নির্বোধ যে, তারা এদিকে নজর রাখছে না? এমন ছেলেমানুষি ভাবনা কেন গ্রাস করল প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে? কেন গোটা বিষয়টি এখনও দলীয় দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে? মুসলিম বিশ্বকে দল হিসেবে বিজেপি বার্তা দিয়েছে কুমন্তব্যের জন্য নুপুর-নবীনকে দল থেকে সাসপেন্ড করে৷ কিন্তু বড়ই বিস্ময়ের, প্রশাসনিক পদক্ষেপ করতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত মোদি-শাহ৷ কেন? গোটা দেশ এবং দেশবাসীকে যারা বিপাকে ফেলেছেন, তাঁরা আজও কেন রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করছেন? কাদের হাত এখনও শক্ত করতে চাইছেন মোদি- শাহ? এ কোন বার্তা দিচ্ছে বিজেপি সরকার? হতেই পারে, এই ইস্যুতে দলের অন্দরে এবং বাইরে প্রবল চাপে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি, কিন্তু সেই চাপ 'বিজেপি নেতা' মোদির ওপর হয়তো থাকতে পারে, দেশের 'প্রধানমন্ত্রী'-র ওপর তো আদৌ এই চাপ নেই, থাকতে পারেও না৷ প্রধানমন্ত্রীর তো দেশের সংবিধান ও আইন অনুসারে পদক্ষেপ করার কথা? সে কাজ তিনি করছেন কোথায়? কেন এখনও কট্টরবাদীদের তুষ্ট করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ভারত সরকার?

কেন এখনও এই দু'জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩এ এবং ২৯৫এ ধারা প্রয়োগ করে ভারত সরকার মামলা রুজু করেনি? কেন এখনও ওই নুপুর-নবীনকে গ্রেফতার করা হয়নি? অতীতে দেশের মানুষ দেখেছেন, এর থেকেও অনেক লঘু অপরাধে অনেকেই ভোগ করছেন দীর্ঘ কারাবাস। দেশদ্রোহী তকমা লাগানো হয়েছে এদের গায়ে। তাহলে কেন এই বৈষম্য? সেক্ষেত্রে কেন্দ্র বলুক, নুপুর শর্মা তেমন কোনও অপরাধ করেননি। সবটাই রটনা। তখন অবশ্য প্রশ্ন উঠবে, কোনও অপরাধই যদি না করে থাকেন, তাহলে তাঁদের মুখপাত্রের পদ থেকে সরানো হলো কেন? প্রাথমিক সদস্যপদই বা কেড়ে নেওয়া হলো কেন?

আইনি ব্যবস্থা বা গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, কেন্দ্র এর ঠিক বিপরীত কাজটি দ্রুততার সঙ্গে সেরে ফেলেছে। শুধুই ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের পক্ষে বিপজ্জনক মন্তব্য করা সত্ত্বেও নূপুর শর্মা ও তাঁর পরিবারকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ পুলিশি নিরাপত্তা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে অভিযুক্তের বাড়ি। নুপুর শর্মার কোনও ক্ষতি হোক, কেউই চায় না। কিন্তু যাঁর থাকার কথা পুলিশি হাজতে, তিনি কোন যুক্তিতে পুলিসি পাহারায় তোফা দিন কাটাচ্ছেন? দিল্লি পুলিশ বলেছে, নূপুর শর্মা নাকি পুলিসকে জানিয়েছেন, প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছেন তিনি। হতেই পারে, এত বড় কাণ্ড ঘটানোর পর, এমন উড়ো ফোন বা চিঠি আসতেই পারে। কিন্তু এর সঙ্গে নুপুরের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করার সম্পর্ক কোথায়?

আসলে বিচ্ছিরিভাবে ফেঁসেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ এতদিন কর্মী-সমর্থকদের কানে যে বিষ ঢেলেছেন, সেই বিষই যে একদিন তাঁর গদিকে নড়বড়ে করে দেবে, তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি৷ বিজেপি বা সংঘ পরিবারের মুসলিম-বিদ্বেষ যে কতখানি, তা বাবরি ধ্বংসের সময়ই গোটা বিশ্ব দেখেছে৷ আদালত যে রায়ই দিক, বাস্তব চিত্র আজও দেশবাসীর মনে গাঁথা রয়েছে। ইদানীং সেই একই দ্বেষ পরিলক্ষিত হয়েছে একের পর এক সৌধের তলায় শিবলিঙ্গের খোঁজ বৃদ্ধি পাওয়ায়। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন উতরে যাওয়া যে খুব একটা সহজ হবে না, তাও টের পাচ্ছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত ৮ বছরে যেসব কাজ মোদি করেছেন, তার ভিত্তিতে দিল্লিতে ফিরে আসা যে অসম্ভব, তাও বুঝে ফেলেছেন মোদি। ফলে গেরুয়া-শিবিরকে ফিরতে হয়েছে সেই হিন্দুত্বের স্লোগানে। ফিরতে হয়েছে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে। সেই কাজে বিজেপিই মদত দিয়েছে নুপুর শর্মাদের। আজ পৈতে পুড়িয়ে কীভাবে ব্রহ্মচারী হবে তারা? নুপুর শর্মাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করলেই দলের অন্দরে বিদ্রোহ হবে। এমনিতেই নুপুরদের পক্ষে গেরুয়া বার্তায় ভরে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন এই দু'জনকে। দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছেন মোদি। তাই ৫৬ ইঞ্চির বুক থাকা সত্ত্বেও সাহস পাচ্ছেন না নুপুর শর্মাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ করতে। মোদির কাছে বার্তা পৌঁছে গিয়েছে, নুপুর শর্মাকে বিজেপি সাসপেন্ড করায় দলের অন্দরে এবং গেরুয়া ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরেছে। বিরূপ প্রতিক্রিয়াও তৈরি হয়েছে দলের কট্টরবাদী মহলে। দলের অনেকেই কার্যত মোদির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলছেন, এ কেমন 'লৌহমানব', যিনি মুসলিম দেশগুলির চাপে চুরমার হয়ে নুপুরদের সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেন? মোদি টের পাচ্ছেন, দলে তাঁর বিরুদ্ধেই অসন্তোষ বাড়ছে। তাই চুপ করে আছেন। আর তলায় তলায় দলের অভ্যন্তরের কট্টরবাদীদের তুষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু এই ভন্ডামিও প্রকাশ্যে চলে আসছে ক্রমশই।

মোদি, বিজেপি এবং কেন্দ্র যখন এই ইস্যুতে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ করতেই দ্বিধাগ্রস্ত, ঠিক তখনই দেখা যাচ্ছে, ভারতের বিরুদ্ধে থাকা দেশের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে। উপসাগরীয় ৭টি দেশ তো প্রথম থেকেই ওই কুমন্তব্যের প্রতিবাদে সরব। ধীরে ধীরে এই সাত দেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া থেকে মালদ্বীপও শামিল হয়েছে, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তুরস্ক, জর্ডন। ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার নিন্দা করে আপাতত ১৫টি দেশ বিবৃতি দিয়েছে। ধরে নেওয়াই যায়, এর ফলে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রবল হচ্ছে।

তবুও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে ভয় পাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ভোট বড় বালাই। বিজেপি মুসলিম ভোট পায় না। বিজেপির কোনও মুসলিম সাংসদ, রাজ্যসভা বা লোকসভায় নেই। ভরসা শুধুই হিন্দুত্বের আওয়াজ। নুপুর শর্মাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে দলের কট্টরপন্থীরা প্রকাশ্যেই 'মোদি হঠাও' স্লোগান তুলে পথে নেমে পড়বে, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না 'টিম মোদি-শাহ'। তাই দলীয় স্তরে লোক-দেখানো ভন্ডামিতেই দায় সারতে চাইছে বিজেপি। নুপুরদের মুখপাত্রের পদ থেকে সরানো, সদস্যপদ খারিজ করার 'বৈপ্লবিক' শাস্তি ঘোষণার পর বিজেপি চাইছে দলের মুখপাত্রদের রাশ টেনে ধরতে। অন্তত প্রকাশ্যে এমনই বলা হয়েছে। পদ্ম-শিবিরের তরফে বলা হয়েছে, এবার থেকে ধর্ম নিয়ে যা ইচ্ছে বলা যাবে না। পড়াশোনা করে ডিবেটে অংশ নিতে হবে। কিন্তু দলের মুখপাত্র হিসেবে যে চাল চেলে ফেলেছেন নুপুর শর্মা, তা যে আর ফেরত নেওয়া যাবে না, তা বেশ বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর। মোদি জানেন, এই ইস্যুতে বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর আসনের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেবে না দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টরপন্থীরা। তাই মাথা উঁচু করে এই ইস্যুতে কোনও পদক্ষেপ করতে পারছেন না। কারন একটাই, বিশ্বের সামনে ভারতের মাথা হেঁট হলে হোক, প্রধানমন্ত্রীর আসনের লোভ তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারছেন না।

শাবাশ নরেন্দ্র মোদি!

More Articles