কাশ্মীর থেকে করোনা, ভারতের প্রকৃত ছবি লেন্সে ধরার মাশুল গুনতে হচ্ছে সানা ইরশাদ মাট্টুকে?

Sana Irshad Mattoo: সানা ইরশাদ মাট্টু-র চিত্রসাংবাদিক হিসেবে পুলিৎজার সম্মান নিতে যাওয়ার পথে আটকে দেওয়া হলো তাঁর উড়ান।

সমাজের অভিধানে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন বলতে যা বোঝায়, তার লেশমাত্র নেই। নিপীড়িত মানুষগুলির প্রতি বরং অবজ্ঞা, অবহেলাই স্পষ্ট। তারপরেও উপত্যকার নামের পাশে 'ভূস্বর্গ' উপমাটি সপাট থাপ্পড় বলেই বোধ হয়েছিল তাঁর। তাই কঠোর বাস্তবের ছবি তুলে ধরাকেই পেশা ও নেশা করে তুলেছিলেন। নিজের দেশে কদর না হলেও, বাইরের দুনিয়া জহুরিকে চিনে নিয়েছিল। কিন্তু বয়স ৩০ না পেরনো সানা ইরশাদ মাট্টু-র এই প্রাপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল তাঁর নিজের দেশই। চিত্রসাংবাদিক হিসেবে পুলিৎজার সম্মান নিতে যাওয়ার পথে আটকে দেওয়া হলো তাঁর উড়ান।

শিক্ষিত, নাগরিক সমাজে এখনও মেয়েরা ‘কুড়িতে বুড়ি’, এমন ধারণা চালু রয়েছে। সেই সমাজেই বেড়ে উঠেছেন কাশ্মীরের সানা। ২৮ বছর বয়সেই খবরের দুনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন চিত্রসাংবাদিক হিসেবে। লেখালিখিতেও নাম করেছেন। করোনা-কালে দেশের অন্দরে দুর্দশার যে ছবি তুলেছিলেন, তার জন্য পুলিৎজার পুরস্কারে নির্বাচিত হন। স্থিরচিত্র বিভাগে সানার সঙ্গে পুরস্কারের দাবিদার আদনান আবিদি, অমিত দাভে এবং আফগানিস্তানে নিহত দানিশ সিদ্দিকিও। সেই পুরস্কার নিতে আমেরিকা যাওয়ার পথে দিল্লিতেই আটকে দেওয়া হয়েছে সানাকে।

ঠিক কী কারণে সানাকে আটকানো হলো, তার সদুত্তর যদিও মেলেনি। বিমানবন্দর থেকে তাঁকে ফেরত পাঠানো অভিবাসন দফতরও কারণ ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন অনুভব করেনি বলে দাবি সানার। শুধু জানিয়েছেন, জীবনে একবারই এমন সুযোগ আসে। তাই আমেরিকার বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে তৈরি ছিলেন তিনি। তারপরেও বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই বলে ফেরত বিমানবন্দর থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস আগে, প্যারিসে একটি বইয়ের উদ্বোধন এবং চিত্র-প্রদর্শনীতে যাওয়ার পথেও একইভাবে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সানাকে। সেবারও দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই বলে ফেরানো হয় তাঁকে।

আরও পড়ুন: অনাহারে মৃত‍্যুই ভারতের গরিবের নিয়তি! মুনাফার প্রদীপের নিচে অসহ্য অন্ধকার

সানার মতোই সাম্প্রতিককালে বিদেশযাত্রায় বাধার মুখে পড়েছেন একাধিক সাংবাদিক। সরকার-বিরোধী খবর করা এবং দেখানোয় অভিযুক্ত তাঁরা। সেই তালিকায় নাম রয়েছে রানা আইয়ুব থেকে আকাশ হাসান, গওহর গিলানিদের। করোনা-কালে বিদেশি অনুদানে ত্রাণের ব্যবস্থা করা রানার বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অভিযোগ আনা হয়। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর, নিজের যোগাযোগ, আইনি পন্থাকে কাজে লাগিয়ে শেষমেশ রানা সেই বাধা অতিক্রম করতে পারলেও, কাশ্মীরের সাংবাদিক আকাশ এবং গওহরের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর সংবাদকর্মী আকাশ এ-বছর, ২৬ জুলাই শ্রীলঙ্কা যাচ্ছিলেন। কিন্তু দিল্লি বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয় তাঁকে। ২০১৯ সালে জার্মানিতে সাংবাদিকদের নিয়ে আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার পথে বাধা পান গওহর। বিমানবন্দরে আটকে রেখে পরিবার, পেশা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২০১৯-এর অগাস্ট মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর থেকে উপত্যকার কাশ্মীরি সাংবাদিকদের প্রায়শই এই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ‘দ্য ওয়্যার’ জানিয়েছে, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সমাজকর্মীদের পাশাপাশি ভারত সরকারের ‘নো ফ্লাই লিস্ট’-এ নাম রয়েছে কাশ্মীরের ২২ জন সাংবাদিকের।

শুধু সাংবাদিকদের বিদেশযাত্রায় বাধা দেওয়াই নয়, তাঁদের আটকে রাখা, বাড়িতে তল্লাশি চালানো, পরিবারকে হেনস্থা করার অভিযোগও সামনে এসেছে। এমনকী, আচমকা আকাশ থেকে খসে পড়ার মতোই নামের সঙ্গে সন্ত্রাস এবং অপরাধ মামলাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। কিন্তু রানার মতো সাংবাদিক যেখানে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি রাস্তা ধরতে পারেন, কাশ্মীরি সাংবাদিকদের সেই সুযোগ নেই। তা করতে গেলে জন নিরাপত্তা আইনে, শুনানি ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁদের বন্দি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা কাশ্মীরি সাংবাদিকদের। সাজাদ গুল, ফাহাদ শাহ এবং আসিফ সুলতানের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনাও শোনা গিয়েছে। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ক্রমশ নিচে নামছে ভারত। বিভিন্ন দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নজরদারি চালানো আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার্স’-এর রিপোর্টে ২০২২ সালে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম স্থানে রয়েছে ভারত। তার আগে, ২০২১ সালে ১৪২তম স্থানে ছিল। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় এই মুহূর্তে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল এবং মায়ানমারের থেকেও পিছিয়ে রয়েছে ভারত। সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে ভারত।

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকাকেই কাঠগড়ায় তুলেছে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ সংগঠন। তাদের দাবি, বিজেপি-র সমর্থক এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি সাংবাদিকদের কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠছে। সরকারের সমালোচনা করলেও দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে 'দেশদ্রোহী' বলে। নরেন্দ্র মোদির নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশের সংবাদমাধ্যমকে মুঠোবন্দি করে রেখেছেন তিনি। সরকারের সুরে গলা মেলাতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের ওপর। অন্যথায় ঘৃণা এবং রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের, যা কোনও গণতান্ত্রিক দেশেই কাম্য নয়।

২০১৪-র পর থেকে ভারত আদৌ গণতান্ত্রিক রয়েছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন, এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ। গণতন্ত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি যে একেবারেই না-পসন্দ তাদের, তা বছর দুয়েক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল সরকার। তাই নীতি আয়োগকে দিয়ে বলানো হয়ে ছিল, ‘‘ভারতে গণতন্ত্র একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়েই রয়েছে।’’ অর্থাৎ, এই ‘বাড়াবাড়ি’-তে কাটছাঁটই যে তাদের উদ্দেশ্য, বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রকারান্তরে। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে উড়ানে উদ্যত সানাদের ডানা ছেঁটে ফেলার সবরকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ‍্য করা হচ্ছে করোনা-কালে দেশের দুর্দশার ছবি তুলে ধরাকে। জীবনের ছবি তুলে ধরতে গিয়ে আফগানিস্তানে মৃত্যু হলেও, সরকাররে কাছ থেকে শুধু নীরবতাই পেয়েছেন দানিশ।

অথচ গণতন্ত্রে এমনটা হওয়ার কথা নয়। সাধারণের মধ্যে থেকেই উঠে আসেন অসাধ্য-সাধনকারী। সরকার থেকে আমজনতা, পাশে থাকেন তাঁর। এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণকারী অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে আত্মশ্লাঘাতে ডুবে থাকে সরকারবাহাদুর। নিখাদ, নির্ভেজাল সত্য নয়, ‘অমৃতকাল’-এর কল্পকাহিনিতে মজিয়ে রাখে সকলকে। রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে তার ফারাক বোঝাতে গিয়েই তাই বারবার বঞ্চনার শিকার হন সানা, দানিশরা।

More Articles