শুভেন্দু থেকে রাজীব, ব্যর্থ সকলেই || স্রেফ দেবের চেষ্টায় কাটবে ঘাটালের দুর্দশা?

বর্ষা এলেই শিরোনামে, বর্ষা গেলেই সব ভুলে যাওয়া। এভাবেই এখনও টিকে আছে৷ এর মাঝে কখন যে ১০০ বছর কেটে গেল, কারও খেয়ালই নেই৷ ঘাটাল আছে সেই ঘাটালেই৷

তবে এবার কিঞ্চিৎ আশার আলো। মনে হচ্ছে, বাস্তবায়িত হলেও হতে পারে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান৷ এই প্রকল্পে কোন পক্ষ কত টাকা দেবে, তা নিয়ে অবশেষে সহমত হয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বেশ কয়েক দশক ধরে আটকে থাকা এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে মোট খরচের ৬০% দেবে কেন্দ্রীয় সরকার৷ বাকি ৪০ শতাংশ টাকা দেবে রাজ্য সরকার। কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে মাস্টার প্ল্যানের কাজ শেষ হলে আশা করা যায়, প্রতি বছরের বর্ষায় বানভাসি হওয়ার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে পারে ঘাটালের মানুষ৷

বর্ষাকালে 'চেনা ছন্দে' ফেরে ঘাটাল৷ অতি বৃষ্টি হলেই প্লাবন৷ জনপদ বদলে যায় খাল, বিল, নদীতে৷ প্রায় প্রতি বর্ষায় নিয়ম করে খবরের কাগজের পাতায় ঘাটালের পথে নৌকো চলার ছবি৷ গ্রামের পর গ্রাম জল থইথই৷ মানুষজনের ঠিকানা হয় কোনও না কোনও ত্রাণ শিবির। আর তখনই চায়ের পেয়ালায় তুফান তোলে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান৷ এটাই রুটিন৷ এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কিন্তু পুরোদস্তুর বৃদ্ধ৷ এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। শিলান্যাস হয় ১৯৮২ সালে। কিন্তু তা ২০২২ সালেও এসেও বাস্তবয়িত হয়নি। মধ্যবর্তী কয়েক দশকজুড়ে শুধুই চলেছে কথা, আলোচনা, দফায় দফায় ডিপিআর জমা, অজস্র ফাইল লেনদেন ইত্যাদি৷ একেবারে শুরুতে ঠিক হয়েছিল, এই প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৭৫ শতাংশ টাকা দেবে এবং বাকি ২৫ শতাংশ দেবে রাজ্য৷ পরে তা বদলে যায়৷ ঠিক হয় কেন্দ্র ও রাজ্য দু'তরফই ৫০ শতাংশ করে টাকা দেবে। এসবই কাগজে-কলমে৷ অথচ প্রতি নির্বাচনেই অন্যতম ইস্যু হয়ে ওঠে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। গত ১১ বছর যাবৎ কেন্দ্রকেই যেমন নিশানা করেছে রাজ্য সরকার, তেমনই রাজ্যের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্নও তোলে বিজেপি। ২০২২-এ অবশেষে সমাধানের পথে এই সমস্যা। ঘাটালের মানুষ ফের আশায় বুক বাঁধছেন, এবার হয়তো এই প্রকল্পের কাজ দেখা যাবে৷

আরও পড়ুন: দলে থেকেই ফোঁস! সিবিআইয়ের তলব ঘিরে দেবের প্রতিক্রিয়া কেন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে?

প্রায় সকলেরই কৌতূহল, ঠিক কী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? কেন এতদিনেও এই মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করা যাচ্ছে না?
অত্যন্ত জটিল এই প্রকল্প৷ বিশাল কর্মযজ্ঞ৷ আর পাঁচটা প্রকল্পের মতো ধর তক্তা, মার পেরেক টাইপের প্রকল্প এটি নয়৷ এই প্রকল্পের ডিপিআর-এ বলা হয়েছে, মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করতে মোট ৬ পর্যায়ে কাজ করতে হবে৷ প্রতিটি পর্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি পর্যায়ের কাজই যথেষ্ট সমস্যাপূর্ণ৷ কী কী কাজ হবে, তাও বলা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, ১) প্রথমেই কংসাবতী ও শিলাবতী-র নদীপথ সংস্কার করা হবে, ২) স্থানীয় খালগুলিতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, খাল সংস্কার হবে, ৩) ঘাটাল-সংলগ্ন নদী ও খালগুলিতে লক গেট বসানো হবে, ৪) নিকাশি ব্যবস্থা উন্নত করতে চন্দ্রকোণা, ঘাটাল, দাসপুর-সহ সংলগ্ন এলাকায় যথেষ্ট সংখ্যক পাম্প হাউস তৈরি করা হবে, ৫) ঘাটাল মহকুমাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত নদী বাঁধ মেরামত করা হবে, ৬) ঘাটাল ও সংলগ্ন এলাকায় উচ্চমানের রাস্তা নির্মাণ করা হবে৷ মোটামুটি এটাই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান৷

কাজের বহর দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প৷ আজই কাজ শুরু হলে প্রকল্প শেষ হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে৷

এই রোগের বয়স ১০০ বছরেরও পুরনো৷ রোগ সারতেও তাই সময় লাগবে৷


১০০ বছর আগে, ১৯২২ সালের ১৭ আগস্ট, 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-র প্রথম বর্ষের ১৩৩ নম্বর সংখ্যায় ঘাটাল-প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল, "ঘাটালে ভীষণ জলপ্লাবন৷ মেদিনীপুর ঘাটাল মহকুমার বর্গফল ৩৬৭ বর্গমাইল৷ ইহার মধ্যে প্রায় ২৪৫ বর্গমাইল পরিমিত স্থানই জলে ডুবিয়া গিয়াছে৷ যতদূর দৃষ্টি চলে, কেবল জল ভিন্ন আর কিছুই দেখা যায় না৷" ২০২২ সালেও ঘাটালের পরিস্থিতি পাল্টায়নি এতটুকুও। দফায় দফায় শাসকের রং বদলালেও ১০০ বছরে ঘাটাল আছে ঘাটালেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের এই মহকুমার প্লাবন-ভাগ্যে কোনও হেরফের হয়নি৷ বিশেষজ্ঞদের কথায়, ফি বছর এভাবে ঘাটাল প্লাবিত হওয়ার কারণ ভৌগোলিক৷ ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে ধেয়ে আসা শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর-সহ একাধিক নদীর ঢাল ঘাটালের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে পলি জমতে জমতে নদীগর্ভ ভরাট হয়েছে৷ ফলে জলধারণ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই কমে গিয়েছে। ফলে একটু বর্ষাতেই ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। ওই প্লাবনে একরের পর একর জমি, ফসল, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, পশুপাখি সবই চলে যায় জলের তলায়। প্রতিবার সেই বিপর্যয়ের সময়ই উঠে আসে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের প্রসঙ্গটি।

ঘাটালের বাসিন্দাদের জল-দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে আজ থেকে পাঁচ দশক আগে 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' নামে বিশেষ এক পরিকল্পনা গৃহীত হয়৷ স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে ১৯৫৯ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে। কিন্তু এই প্রকল্পের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেতেই লেগে যায় দু’দশক। অবশেষে ১৯৮২ সালে, বামফ্রন্ট আমলে শিলাবতী নদীর ধারের এক স্থানে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের অফিসিয়াল যাত্রা শুরু হয়। রুপোর কোদাল চালিয়ে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই টাকার অভাবে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৬ সালে ফের বিষয়টি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হওয়ার পর ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়৷ কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা না থাকায়, সেবারও প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়৷ এর পর ২০০৯ সালে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের নির্দেশে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে নতুনভাবে রিপোর্ট তৈরির কাজে হাত দেয়। ২০১৫ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন এই রিপোর্টে ছাড়পত্র দেয়। রিপোর্ট অনুসারে প্রকল্পটির খরচবাবদ ১,২১৪ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। নতুন এই প্রকল্পে ১৪৭ কিলোমিটার নদী ও নদীর বাঁধ সংস্কার, নারায়ণী ও কাঁকি খালে দু’টি স্লুইস গেট, পাম্প হাউস, ঘাটাল শহর সংলগ্ন শিলাবতী নদীর বাঁ দিকে দুই কিলোমিটার গার্ডওয়াল-সহ বিভিন্ন কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সবটাই তো খাতায়-কলমে। প্রথম ধাপের প্রকল্পটি সরকারি সিলমোহর পেলেও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনও টাকাই বরাদ্দ হয়নি। এর ফলে অর্থনীতির নিয়মে যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে প্রকল্পের খরচ।

২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। তৎকালীন তৃণমূল এবং কংগ্রেস জোট সরকারের সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া নিজে দফায় দফায় দিল্লি গিয়ে দরবার করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে মানস ভুঁইয়া সরাসরি অভিযোগ করেন, কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্পে রাজ্য নিজে ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও সাহায্য করেনি। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে তো মুখই খুলছে না কেন্দ্র৷ এর পর মানস মন্ত্রীপদে ইস্তফা দেন, কংগ্রেস সরে যায় মন্ত্রিসভা থেকে৷ মানসের পর সেচ দফতরের দায়িত্ব পান অধুনা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনিও মাঝে মধ্যেই ঘাটাল নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ আনেন৷ এর পর সেচমন্ত্রী পদে আসেন তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে, ভোটে পরাজিত হয়ে ফের তৃণমূলে ফিরে আসা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মন্ত্রী রাজীব তখন বলেছিলেন, কেন্দ্র টাকা না দিলে প্রয়োজনে ভিক্ষে করে অর্থ সংগ্রহ করে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের রূপায়ণ করেই ছাড়ব৷ সেই রাজীবও সরে গেলেন৷ দুই প্রাক্তন সেচমন্ত্রী শুভেন্দু আর রাজীব মন্ত্রী থাকাকালীন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান না হওয়ার জন্য কেন্দ্রকে দায়ী করলেও, যখন একসঙ্গে বিজেপির হয়ে ভোটপ্রচার করেছেন, তখন এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত না হওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দায়ী করেছেন৷ এখন অবস্থান বদলেছে৷ আজও হয়তো শুভেন্দু দায়ী করবেন মমতাকেই, কিন্তু রাজীব এবার দুষবেন কেন্দ্রকেই৷

এদিকে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত করতে বারবার কেন্দ্রকে চিঠি লিখেও লাভ হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ঘাটালের তৃণমূল সাংসদ তথা অভিনেতা দেব। কিছুদিন আগে দেব বলেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী না হওয়া পর্যন্ত, এই দুর্দশা থেকে ঘাটালবাসী মুক্তি নেই৷ তবে এটা ঠিক, এই মাস্টার প্ল্যান নিয়ে টানা লেগে আছেন দেব৷

এটা বাস্তব, গত ১০ বছরে বারবার এই রাজ্যে সেচমন্ত্রী বদলালেও, ঘাটালে বন্যা প্রতিরোধের কাজ এখনও বাস্তবায়িত হয়নি৷ মাস্টার প্ল্যান এখন স্রেফ শাসক-বিরোধীদের রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার৷ এদিকে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে রাজ্য বিজেপির বক্তব্য, ঘাটালের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত না হলেও চন্দ্রেশ্বর খাল গোপীগঞ্জ থেকে বৈকুণ্ঠপুর পর্যন্ত এসেছে। আর মাত্র ৪ কিমি বাড়িয়ে শীলাবতীতে মিশিয়ে দেওয়া গেলে ঘাটাল-সহ পাশ্ববর্তী এলাকা এই জলমগ্ন অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু সেই উদ্যোগ রাজ্যের তৃণমূল সরকার নেয়নি। রাজ্য সরকার এই ইস্যুতে বিজেপির সাহায্য চাইলে তাহলে অবশ্যই পাবে। আমাদের সাংসদরা তৈরি রয়েছেন কেন্দ্রের ফান্ড থেকে টাকা এনে রাজ্যকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু রাজ্য এমন অনুরোধ করছে কোথায়?

এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঘাটাল নিয়ে কেন্দ্রের সর্বশেষ প্রস্তাব৷ কেন্দ্রীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ৬০ শতাংশ খরচ দিল্লি দেবে। বাকি ৪০ শতাংশ খরচ দিতে হবে রাজ্যকে। কেন্দ্রীয় প্রস্তাব নিয়ে রাজ্যের অর্থ দফতরের সঙ্গে আলোচনার পর রাজিও হয়েছে সেচ দফতর। সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও বলেছেন, “প্রকল্পটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে খুব আন্তরিক এবং উদ্যোগী। সরকার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে কেন্দ্রের সঙ্গে। কেন্দ্রের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে রাজ্য যে রাজি, তা জানানো হয়েছে। নতুন করে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান জমাও দেওয়া হয়েছে।"

এখন দেখার, এইবার অন্তত ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হয় কি না!

More Articles