জিরো ভ্যালি: অরুণাচল প্রদেশের লুকানো স্বর্গ

আমার বন্ধু রাহুল বরাবরই ভ্রমণ বিলাসী | তবে রাহুলের ভাল লাগার জায়গাগুলো বেশ আলাদা | ও পছন্দ করে এমন সব জায়গা যেখানে সাধারণত বেশি মানুষজন যায়না এমনকি অনেকে হয়ত ওই সমস্ত জায়গার নাম ও শোনেনি | সেই সব জায়গাতেই একা একই ঘুরতে বেরিয়ে পরে রাহুল | ওর মুখ থেকে জানতে পারি আমাদের ভারতবর্ষের এমন কিছু জায়গার কথা যা প্রতিবারই মনে দাগ কেটে যায় | কিছুদিন আগে ওর বাড়ি বেড়াতে গেছিলাম তখনই ওর মুখ থেকে শুনলাম অনুরাচল প্রদেশের 'জিরো ভ্যালির' কথা | জায়গাটার গল্প শুনে নিজেরই মনে হচ্ছিল যেন আমিও পৌঁছে গেছি 'জিরো ভ্যালিতে' | তাহলে আসুন আজ আপনাদের শোনাই সেই অরুণাচল প্রদেশের লুকানো স্বর্গ 'জিরো ভ্যালির' সম্মন্ধে | যা আপনাকেও আকর্ষণ করবে সেখানে  ঘুরে আসতে |

 হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত অন্যতম সুন্দর একটি শহর হলো ‘জিরো ভ্যালি’ | পাহাড়ে মোড়া ও গভীর সবুজ বনে ঘেরা এই শহরটি | জিরো অরুণাচল প্রদেশের নিম্ন সুবানসিরি জেলায় অবস্থিত | এটি রাজ্যের রাজধানী ইটানগর থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার দূরে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উপরে অবস্থিত | এই জিরো ভ্যালিটি হলো আপাতানি গোত্রের বাসস্থান | এই আপাতানি গোত্রের মানুষেরা তাদের বন্ধুভাবাপন্ন মানসিকতার সূত্রে তাদের পূর্বপুরুষদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কে নিবিড় ভাবে বেঁধে রেখেছে |

এই অপাতানি মহিলাদের অরুণাচল প্রদেশের উপজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী বলে গণ্য করা হয় | অন্যান্য গোত্রের পুরুষদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য অপাতানি মহিলারা মুখে ট্যাটু করার প্রথা শুরু করে এবং তাদের সুন্দর চেহারা যাতে অন্য গোত্রের পুরুষদের আকর্ষণ না করে সেই কারণে তাদের নাকে বড় প্লাগ পরিয়ে দেওয়া হয় |

জিরো ভ্যালিতে অন্যতম প্রধান গ্রাম হল হং ভিলালেজ | এই গ্রামগুলোতে সমস্ত বাড়িগুলো তৈরী করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে | এবং প্রতিটি বাড়ির মাঝখানে একটি বিশাল আকারের স্টোভ অর্থাৎ উনুন খনন করা আছে, নিজেদের শরীর গরম রাখতেই প্রতিটি বাড়িতে এই উনুনের ব্যবস্থা করা আছে | এই গ্রামগুলোতে ঘোরার জন্য অবশই একজন লোকাল গাইডের প্রয়োজন পরে |

অন্যদিকে এই জিরো ভ্যালিতে আরও একটি আকর্ষণীয় জিনিস হলো 'প্যাডি কাম ফিশ' চাষ | এই মাছের চারা জলাশয় ছাড়া হয় প্রত্যেকবছর মে মাসে এবং জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে যখন সেই মাছের চারাগুলি বড় হয়ে যায় তখন সেই মাছগুলিকে জলাশয় থেকে তুলে নেওয়া হয় | আর ধানের চারা রোপন হয় ফেব্রুয়ারী মাসে এবং ফসল তোলা হয় অক্টোবর মাসে | 

২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে, আপাতানি কালচারাল ল্যান্ডস্কেপ 'ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' -এর তালিকায় যুক্ত হয়েছে (UNESCO World Heritage Sites). জিরো তার মনোরম সৌন্দর্যে সবাইকে মুগ্ধ করে | জিরো ভ্যালি ট্রেকিং, জঙ্গল ক্যাম্পিং এবং বন্যপ্রাণী অনুসন্ধানের মতো অ্যাডভেঞ্চারের জন্যও একটি দুর্দান্ত জায়গা |

জিরো ভ্যালির পরিদর্শনের সেরা সময় হলো বর্ষা পরবর্তী মাস | এখানকার আবহাওয়া সারা বছরই হালকা থাকে | তবে বর্ষা পরবর্তী মাসগুলিতে গেলে সবুজ ধান ক্ষেত দেখার জন্য সর্বোত্তম সময় | এছাড়াও সেপ্টেম্বর মাসেও যেতে পারেন কারণ সেপ্টেম্বর হল বিখ্যাত জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যালের সময় | ভারতের বিখ্যাত বহিরঙ্গন সঙ্গীত উৎসবগুলির মধ্যে বিখ্যাত হলো এই জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল |

জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল ছাড়াও রয়েছে, 'দ্রী ফেস্টিভ্যাল' | অরুণাচল প্রদেশের যে সমস্ত অধিবাসী 'আপাতনি সংস্কৃতি' -কে লালন করেন তারা এই 'দ্রী ফেস্টিভ্যাল' পালন করেন | দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই উৎসবের সময় বিশেষ কিছু দেব-দেবীর পুজো করা হয় | প্রতিবছর জুলাই মাসে এই দ্রী ফেস্টিভ্যালের অনুষ্ঠান হয় | এই উৎসব চলাকালীন প্রত্যেক গৃহবাসী তাদের এলাকায় প্রসিদ্ধ 'আপং' নামের এক প্রকার মদ তৈরী করেন এবং তাদের ঘর বাড়ি ও বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার পরিছন্ন করেন |

ওই উপত্যকায় অসংখ্য প্রজাতির বহুবর্ণ প্রজাপ্রতি দেখতে পাওয়া যায় | এই প্রজাপতিদের রংবাহার দেখে মুগ্ধ হয়ে উপত্যকা বাসীরা প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে একটি 'প্রজাপতি উৎসব' উদযাপন করেন |

এছাড়াও রয়েছে 'মায়োকো ফেস্টিভ্যাল' | উপত্যকার উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশ্বাস করেন যে এই উৎসব আতঁৰিকতার সঙ্গে উদযাপন করলে পারিবারিক ভালবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়, ফসলের ফলন ভাল হয় এবং সুখ - সমৃদ্ধি লাভ হয় |

জিরোর আরও কিছু বিখ্যাত স্থান হল তারিন ফিশ ফার্ম, ট্যালি ভ্যালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কাইল পাখো, ডলো মান্ডো, সিদ্ধেশ্বরনাথ মন্দিরে শিব লিঙ্গ ইত্যাদি |

কীভাবে যাবেন?

নিকটতম রেল স্টেশন হল নাহারলাগুন এবং উত্তর লখিমপুর | গুয়াহাটি থেকে 'ডোনি পোলো এক্সপ্রেস' নামে একটি ট্রেন আছে যা প্রতিদিন রাত ৯:২০ তে গুয়াহাটি থেকে ছারে এবং পরের দিন ভোর ৫টা নাগাদ নাহারলাগুন পৌঁছায় | এছাড়াও কামাখ্যা স্টেশন থেকে আরেকটি ট্রেন আছে যা গুয়াহাটি থেকে প্রায় ৭ কিমি দূরে, ট্রেনটি হলো 'কামাখ্যা-মুরকংসেলক লাচিত এক্সপ্রেস' যা প্রতিদিন রাট ৮:৩০ নাগাদ কামাখ্যা স্টেশন থেকে ছাড়ে এবং সেটি পরের দিন ভোর ৪:১০ নাগাদ পৌঁছয় উত্তর লখিমপুরে | পাশাপাশি নাহারলাগুন বা উত্তর লখিমপুর থেকে আপনি জিরো ভ্যালিতে পৌঁছনোর জন্য গাড়ি বা ক্যাব পাবেন | জিরো পৌঁছাতে প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টা সময় লাগবে |

More Articles