এক কক্ষপথ পার, নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আজও যুদ্ধক্লান্ত গাজা
War-torn Gaza: মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতবস্থা ঘেঁটে যখন প্রবল হয়ে উঠছে দুই অক্ষশক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা, সেই সময়েও কিন্তু গাজাবাসীর মাথার উপর ঘাই মেরে চলেছে ইজরায়েলের বোমারু বিমান।
যুদ্ধ মানেই ‘শত্রু শত্রু খেলা’। আর এই শত্রু শত্রু খেলার মধ্যিখানে পড়ে থাকে অসংখ্য প্রাণহীন শরীর, মাইল কে মাইল গণকবর, ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্কুল-হাসপাতাল, ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ি আর কোনও মতে মৃত্যুর জন্য দিন গোনা সব হারানো মানুষজন। হ্যাঁ, এসবই এখন সহজ খুব গাজায়। খুব চেনা চেনা দৃশ্য সব। প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও হাসপাতাল, কোনও না কোনও স্কুল কিংবা শরণার্থী শিবিরে এসে পড়ে ইজরায়েলি বোমা। কারওর উড়ে যায় হাত, কারওর উড়েছে পা। মুহূর্তে নেই হয়ে যায় প্রিয়বন্ধু, প্রিয়জন। প্রায় এক বছর ধরে গাজার ঘোর বাস্তব এটাই। রাত শেষ হয়ে সূর্য ওঠে। কিন্তু গাজায় যুদ্ধের শেষ হয় না।
এককালে জার্মান নাৎজি বাহিনীর হাতে প্রবল নিগ্রহ, প্রবল যন্ত্রণার শিকার হয়েছে ইহুদিরা। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা আজও ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। কথায় বলে— ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’। যে ভয়াবহ যন্ত্রণার ইতিহাস ইজরায়েলের পাঁজরে গ্রন্থিত রয়েছে, সেই ভয়ঙ্কর ক্ষত প্যালেস্টাইনের ইতিহাসে এঁকে দিতে কাঁপেনি ইহুদি রাষ্ট্রনেতাদের হাত। সম্পূর্ণ আলাদা একটা ভূখণ্ড, আলাদা একটা দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্যালেস্টাইনকে দীর্ঘদিন ধরে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখেছে ইজরায়েল। এর নেপথ্যে অবশ্য প্যালেস্টাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াসের আরফতের ইজরায়েলের সঙ্গে এক শান্তিচুক্তি। যে চুক্তি ইজরায়েলকে নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখার স্বাধীনতা দেয় না। বরং সযত্নে চুক্তির আখরেই লুকিয়ে রাখে যুদ্ধের বীজ। চুক্তিতে শর্ত হয়েছিল, প্যালেস্টাইনে যে কোনও প্রকার সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হলেই তাকে ইজরায়েলের হাতে তুলে দিতে বাধ্য ফিলিস্তিনি সরকার। নতুবা প্যালেস্টাইনেই আক্রমণ করে বসবে ইজরায়েল। এমতাবস্থায় প্য়ালেস্টাইনের কাছে খোলা শুধুমাত্র আধা-সামরিক বাহিনী রাখার পথটুকু। হ্যাঁ, এমনই আশ্চর্য চুক্তিতে আবদ্ধ দু'টি দেশ।
আরও পড়ুন: ঘুমের মধ্যেই তাবুতে নিথর ৪০ প্রাণ! কেন গাজার ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ই বারবার হামলা ইজরায়েলের?
অথচ স্বাধীনতা-হীনতায় কে-ই বা বাঁচিতে চায় আজন্মকাল। তা-ই বার বার ইজরায়েলের নাগপাশ থেকে প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার আশায় জন্ম নিয়েছে হামাসের মতো সশস্ত্র সব গোষ্ঠী। যাকে ইজরায়েল দাগিয়েছে জঙ্গি বলে। যদিও প্যালেস্টাইনে রাজনৈতিক দল হিসেবেই স্বীকৃত তারা। গাজা শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদের হাতেই। ইজ-আদ-দীন-আল-কাসসাম ব্রিগেড নামে তাদের একটি সামরিক শাখা থাকলেও ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফিলিস্তিনি পার্লামেন্টে সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেয় তারা, এবং অধিকাংশ আসন জিতে ২০০৭ সালে প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডের দায়িত্ব বুঝে নেয়। প্যালেস্টাইনের ফাতাহ রাজনৈতিক শক্তিকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্যালেস্টাইন থেকে উৎখাত করেছিল ১৯৮৭ সালে তৈরি এই গোষ্ঠীটি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, কানাডা এবং ইজরায়েলের মতো দেশ হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে দেগে দিলেও ইরান, রাশিয়া, তুরষ্ক, চিন বা সিরিয়ার কাছে কিন্তু তারা প্য়ালেস্টাইনের রাজনৈতিক দল মাত্র। ঠিক যেমনটা লেবাননের ক্ষেত্রে হিজবুল্লাহ।
যুদ্ধের আগুনে ঘি
ইজরায়েলের সঙ্গে প্যালেস্টাইনের সংঘাত অনেক দিনের। সেই যুদ্ধের আগুনে ঘি পড়ল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। হঠাৎই কোনও রকম পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই ইজরায়েলে হামলা করে বসল হামাস। প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র সংগঠন হিসাবে প্রথম থেকেই কালো তালিকায় ছিল যারা। এবং পূর্ব সাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, যাদের খতম করার সব রকম অধিকার ও শক্তি ইজরায়েলের রয়েছে। ৭ অক্টোবর ছিল ইহুদিদের জন্য পবিত্র দিন। শুক্রবারের সন্ধ্যাটাকে নাচ, গান, হুল্লোড়ে কাটাতে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয়রা। হঠাৎই সমস্ত হুল্লোড়ের আবহের তাল কেটে ইজরায়েলে ঢুকে পড়ে হামাস জঙ্গিরা। জেরুজালেম জুড়ে বেজে উঠল যুদ্ধের সাইরেন। সেই শব্দ শুনে যে যেদিকে পারল ছুট লাগাল। ততক্ষণে স্থলপথ, আকাশপথ, জলপথ, যেদিক থেকে পেরেছে ইজরায়েলে ঢুকে পড়তে লেগেছে সশস্ত্র হামাস জঙ্গিরা। কেউ মোটর সাইকেলে, তো কেউ প্যারাগ্লাইডারে। সব দিক থেকে ইজরায়েলকে ঘিরে ফেলল হামাস সেনা। কিবতুজ নির ওজ ছিল সেদিন হামাস-হামলার কেন্দ্রস্থল। মুহূর্তে ছাড়খার হয়ে গিয়েছিল ইজরায়েলের সুপারনোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল। ছুটে আসতে থাকে এলোপাথাড়ি গুলি, বোমা। ফুঁড়ে দেয় অসংখ্য সাধারণ মানুষের বুক। মহিলাদের গুলি করার আগে চালানো হয় অকথ্য অত্যাচার। এর সঙ্গেই ইজরায়েলকে নিশানা করে ছোড়া হয় একসঙ্গে কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ব্যারেজ। ইজরায়েলের শক্তিশালী আয়রন ডোম সেই সমস্ত রকেট হামলাকেই প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। কিন্তু হামাসের হামলা থেকে ১৪০০টি প্রাণের বলি আটকাতে পারেনি তারা। একই সঙ্গে পণবন্দি বানিয়ে গাজায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াইশো জনকে। ক্রমাগত রকেট হামলায় ততক্ষণে কান পাতা দায় ইজরায়েলে। এই পরিস্থিতিতে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
এমন ভয়ঙ্কর দিনে আমেরিকাকে পাশে পেল ইজরায়েল। যুদ্ধে প্রতিনিয়ত মদত পেল যাদের কাছ থেকে নেতানিয়াহুর দেশ। পাশে এসে দাঁড়াল ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলিও। হামাসের হাতে বন্দি অন্তত আড়াইশো জন ইজরায়েলি, যাঁদের ছাড়ানোর জন্য তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না ইজরায়েলের। বরং ইজরায়েলি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল গাজাকে সবক শেখানো। অর্থাৎ ঘুরিয়ে হামাসকে তার জায়গা দেখিয়ে দেওয়া। ৮ অক্টোবর, গাজা স্ট্রিপের কাছে বসবাসকারী ইজরায়েলি বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল প্রশাসন। লকডাউন ঘোষণা করা হল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও। ৭ থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে পশ্চিম তীরের বিভিন্ন এলাকায় ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জন ফিলিস্তিনির। যার মধ্যে ছিল বেশিরভাগই শিশু। ৯ অক্টোবর থেকে গাজাকে সম্পূর্ণ ভাবে বিকল করে দিতে নয়া কৌশল অবলম্বন করে ইজরায়েল। প্রথমে বন্ধ করা হয় জল, তার পর একে একে খাদ্য ও জ্বালানি আটকে দেওয়া হয় গাজায়। শুরু হয় গাজায় দফায় দফায় হামলা। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। গাজা শহরের দারোজা ও তুফাহ জেলা ও তার সংক্রান্ত এলাকায় অন্তত ৭০টি লক্ষ্য়বস্তুতে আঘাত হেনেছে ইজরায়েল। ততক্ষণে ইজরায়েলে পৌঁছে গিয়েছে আরও উন্নত আরও অত্যাধুনিক মার্কিনি অস্ত্র, যা ইজরায়েল ভবিষ্যতে ব্যবহার করবে গাজার বিরুদ্ধে।
১১ অক্টোবর তারিখে আরও ভয়ঙ্কর হল গাজায় ইজরায়েলি হামলার প্রভাব। গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ও গাজার একাধিক ভবনকে নিশানা করে একের পর এক হামলা চালাতে লাগল ইজরায়েল। ততদিনে জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। হামাসের হাতে বন্দি সমস্ত ইজরায়েলি পণবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস স্বয়ং। একই সঙ্গে যেভাবে গাজাকে সবদিক দিয়ে অর্থাৎ হাতে এবং ভাতে মারার ব্যবস্থা করেছে ইজরায়েল, তারও কড়া নিন্দা করেন। গাজা-মিশর রাফাহ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবিরাম ইজরায়েলের বোমাবর্ষণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে চলেছে ইজরায়েলি সেটলার তথা বসতি স্থাপনকারীরা। সব দিক থেকে যেন নাগপাশে বেঁধে ফেলা হয়েছে গাজাকে। যুদ্ধের প্রায় ৬ দিন কেটে গেলেও আক্রমণের তীব্রতা কমল না গাজায়। বরং হামলা বাড়িয়েই যেতে লাগল ইজরায়েলি সেনা। এরই মধ্যে এলাকা ছেড়ে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। গাজার উত্তর-পূর্বে ইজরায়েল, দক্ষিণে মিশর। কোথায় যাবেন বাসিন্দারা? বুঝে উঠতে পারেন না তাঁরা। ইজরায়েলের নির্দেশ ওয়াদি গাজার দিকে সরে যাক তাঁরা। এদিকে বারবার নাগরিকদের ঘরবাড়ি নিশানা করেই হামলা চালাতে থাকে ইজরায়েলি সেনা। তাদের সন্দেহ, স্থানীয় গাজাবাসীদের ঘরে ও বাড়ির নীচেই ঘাপটি মেরে রয়েছে হামাস জঙ্গিরা। স্থানীয় গাজাবাসীকে ঢাল বানিয়েই ইজরায়েলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। একই সঙ্গে ইজরায়েলের তরফে ঘোষণা করা হয়, হামাস বন্দি ইজরায়েলিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত, জল-খাদ্য এবং জ্বালানি বা বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত থাকবে গাজাবাসী। এদিকে ততদিনে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যে দিকে দু'চোখ যায়, পালাতে শুরু করেছেন গাজার বাসিন্দারা। ভাটিক্যানের মধ্যস্থতার প্রস্তাব উড়িয়ে হামলার তীব্রতা বাড়িয়েই চলেছে ইজরায়েল। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলি বাহিনীর হাতে মানুষ মরছে মুহুর্মুহু। একই সঙ্গে এর প্রভাব পড়তে থাকে ইজরায়েলে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের উপরেও। আল আকসা মসজিদে শুক্রবার নমাজের জন্য আসা ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হল। এতদিন গাজা ভূখণ্ড থেকে প্রচুর মানুষ ইজরায়েলে আসতেন কাজ করতে। ইজরায়েলও বরাবর তাতে উৎসাহ দিয়ে এসেছে। এবার দু'দেশে যুদ্ধ লাগতেই বিপদে পড়লেন গাজা থেকে কাজ খুঁজতে ইজরায়েলে আসা ফিলিস্তিনিরা। তাঁদের অনেককেই বন্দি করা হল ইজরায়েলি জেলে। চলল তাঁদের উপর নিগ্রহ, অত্যাচার।
এই মৃত্যুর উপত্যকা যাঁদের দেশ
হামাসকে নিকেশ করতে সমগ্র গাজা স্ট্রিপ জুড়ে মোতায়েন হয়েছে ব্যাপক সেনা। ইজরায়েলের একের পর এক বিমান হামলা ততক্ষণে কেড়েছে গাজার দেড় হাজারেরও বেশি নিরপরাধ প্রাণ। এই সংখ্যাটা যে আগামী এক বছরে কার্যত ইনফিনিটি ছুঁয়ে ফেলবে, তা বোধহয় তখনও আঁচ করে উঠতে পারেনি বাকি বিশ্ব। ইজরায়েল সীমান্তে যুদ্ধের ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ির ছড়াছড়ি। সেই সব আতঙ্ককে মাথায় করেই মানুষ হাঁটেন। শেষ সহায়সম্বলটুকু যে যতটুকু পারেন, বেঁধেছেদে, পরিবার-সন্তান বুকে আগলে হাঁটতে থাকে গাজার শরণার্থী ভিড়। জাতিসংঘ জানিয়ে দেয়, গাজায় তাদের শরণার্থীশিবিরগুলি নিরাপদ নয় আর। অগত্যা মানুষের উদ্বাস্তু স্রোত এগোতে থাকে। ইজরায়েল নিরাপদ নয়, মিশর দরজা খুলবে না জেনেও তাঁরা হাঁটেন।
তবে দরজা না খুললেও সাহায্য নিয়ে মিশর সীমান্তে হাজির ছিল তাদের ট্রাক। ২১ অক্টোবর তারিখে বাইডেনের ইজরায়েল সফরের পর মিশরের সঙ্গে কথাবার্তা চালান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার পরেই গাজায় রাফাহ ক্রসিং দিয়ে ঢুকতে শুরু করে প্রাথমিক চিকিৎসার উপকরণে ভরা ট্রাক। ততদিনে একাধিক হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাজার একাধিক হাসপাতাল। চারদিকে মৃতদেহের ভিড়। চিকিৎসার অভাবে অসহায়ের মতো মরে যাচ্ছেন মানুষ। অসংখ্য নিরিহ, নিরপরাধ শিশুর দেহ লুটোয় রাস্তার আশপাশে। পর্যাপ্ত ওষুধ নেই, চিকিৎসার উপকরণ নেই। আলো জ্বালানোর জ্বালানিটুকু নেই। খাবার-ত্রাণ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসটুকু পৌঁছে দিতে অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির কথা বলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তেনিয়ো গুতারেস।
গাজা জুড়ে বন্ধ ইন্টারনেট। সেখানকার কোনও খবর যাতে বাইরের বিশ্বের কাছে না পৌঁছয়, তার জন্য উড়িয়ে দেওয়া হয় গাজার প্রধান যোগাযোগ ভবন। এরই মধ্যে নুসিরত শরণার্থী শিবির লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায় ইজরায়েলি সেনা। বাড়তে থাকে মৃত্যুমিছিল। এরই মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে জর্ডন। প্রস্তাবপত্রে ভোট দেয় ১২০টি সদস্য-দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় ১৪টি রাষ্ট্র। ভারত-সহ ৪৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ততক্ষণে সাড়ে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে গাজায়। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কানেও তোলে না ইজরায়েল। এই ভাবে কেটে যায় গোটা একটি মাস। অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বরে এসে প্রথম বার আহত ফিলিস্তিনি ও আটকে পড়া বিদেশি নাগরিকেরা যাতে গাজা থেকে বেরোতে পারেন, তার জন্য খুলে দেওয়া হয় রাফাহ ক্রসিং।
২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর। যুদ্ধের ৪৮ দিনের মাথায় ইজরায়েল ও হামাস, দু'পক্ষই সম্মত হল এক মাসের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে। হামাসের কবল থেকে মুক্ত করা হল ১০০ জন পণবন্দিকে। অন্যদিকে ইজরায়েল তাদের জেল থেকে মুক্তি দিল ২৪০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে। তবে যুদ্ধবিরতির আড়ালেই আগ্রাসন জারি রাখল ইজরায়েল। খান ইউনিস শহরে হামাসের কম্যান্ড সেন্টারকে নিশানা করে চলতে লাগল হামলা। যাঁরা গাজা ছেড়ে খান ইউনিসে কোনও মতে গিয়ে মাথা গুঁজেছিলেন, তাঁদের আবার পালানোর পালা। রাফাহ ভরে উঠতে লাগল শরণার্থী স্রোতে। ডিসেম্বরের প্যালেস্টাইন, মুড়ে রইল রক্ত, মৃত্যু আর বারুদের গন্ধে। যে সব দেশ গাজায় যুদ্ধশান্তির বিরুদ্ধে ছিল, সেসব দেশেও প্রতিবাদের ঝড় উঠল প্যালেস্টাইনে শান্তির পক্ষে। এরই মধ্যে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে বোমা ফেলে ইজরায়েল। গাজায় স্থল অভিযানে এগোতে থাকে তারা। এরই মাঝে পাল্টা হামলা ফেরত দিতে থাকে ইজরায়েলে হামাসও। তবে তাতে গাজার বিপদই বাড়তে থাকে ক্রমশ।
এরই মধ্যে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আরও একটি যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা নিয়ে মিশরের সঙ্গে আলোচনার জন্য কায়রো পৌঁছন হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়েহ। তবে আশাজনক কিছু হয় না। গাজায় বাড়তে থাকে মৃত্যু মিছিল। সেই থেকে যুদ্ধটা চলছেই। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৃথিবী পার করে ফেলেছে প্রায় আস্ত একটা বছর। প্রায় ৩৬৫টা দিন পেরোতে যায়, গাজায় শান্তি ফেরেনি। বিশ্বের মানুষের স্মৃতিতে যুদ্ধের দাগের উপর পলি, গাজার খবরের জন্য বরাদ্দ জায়গা কমেছে ক্রমশ। নতুন বছরের শুরুটাও শান্তিপূর্ণ হয়নি গাজাবাসীর জন্য। বছরের প্রথম দিনই ইজারায়েলি হামলায় ফের নতুন করে মৃত্যু হয় অসংখ্য ফিলিস্তিনির। মৃত্যুমিছিল ছুঁয়ে ফেলে বাইশ হাজার। ততদিনে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের অনিবার্য পরিণাম হিসেবে দেখা দিল প্রবল দুর্ভিক্ষ। খাবার নেই, জল নেই, ওষুধ নেই। মহিলাদের ঋতুস্রাব রোখার প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই। তবু মানুষ বাঁচে, কাল সকালে মরে যাবে বলে। তার মধ্যেই চলতে থাকে ইজরায়েলের প্রাণঘাতী হামলা। কোনও হামলা কাড়ে দু'শো মানুষের প্রাণ, কোনও হামলা আরও বেশি। যার মধ্যে বড় অংশ জুড়ে থাকে মহিলা ও শিশু।
উদ্বাস্তু-উদ্বেগ-মৃত্যুস্রোত
২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি। এবার ইজরায়েলের রাফাহ। সেখান থেকেও তড়িঘড়ি সাধারণ মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইজরায়েলি সেনা। হামাস নির্মুল করতে সেখানেও সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকার। বাইডেনের বারণও অবশ্য সেই সামরিক অভিযান থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি ইজরায়েলকে। ১২ ফেব্রুয়ারি রাফাহতে আইডিএফের হামলায় অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়। দেখতে দেখতে গাজায় মৃতের সংখ্যা ছাড়ায় ৩০ হাজার। রমজানে যুদ্ধবিরতির আশাটুকুও মুখ থুবড়ে পড়ে। ইদের আগে গাজাবাসীকে তাঁবু উপহার দেয় ইজরায়েল সরকার। যাতে উদ্বাস্তু স্রোত মাথা গুঁজতে পারে অন্য কোনও আশ্রয়ে। সেই আশ্রয়, যা যে কোনও মুহূর্তে নেই হয়ে যাবে ইজরায়েলি রাষ্ট্রনেতার এক ইশারায়।
মার্চ মাসের গোড়াতেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল সতর্ক করেছিলেন, রাফাহতে ইজরায়েলের অভিযান মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে প্যালেস্টাইনকে। কিন্তু তার পরেও রাফাহ জুড়ে একের পর এক হামলা চালাতে থাকে ইজরায়েল। এপ্রিল মাসে খান ইউনিস থেকে সেনা সরাতে শুরু করে ইজরায়েল। ততদিনে খান ইউনিস আস্ত একটা ধ্বংসস্তূপ। সেখানে নিরাপত্তা শব্দটাই একটা আলেয়ার মতো। রাফাহ অনিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও সেখানেই মাথা গোঁজার চেষ্টা করতে থাকেন সাধারণ বাসিন্দারা। এপ্রিলের শেষে ফের গর্জে ওঠেন নেতানিয়াহু। জানান, হামাস নির্মূল করতে বড়সড় অভিযান চলবে রাফাহতে। মে মাসের গোড়াতেই ইজরায়েল রাফাহ শহরের দক্ষিণাঞ্চলের লোকজনকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ঘুমচক্ষু ছেড়ে মানুষ দেখেন লিফলেটে ভরে গিয়েছে এলাকা। স্থানীয় মানুষের মোবাইলেও বার্তা পাঠানো হয়। আবার মানুষ জিনিসপত্র গুছিয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন।
আজ এখানে তো, কাল ওখানে। পরশু ফের মাথা বাঁচাতে অন্যত্র। গোটা এক বছর ধরে শুধু জায়গা পাল্টে গিয়েছেন গাজাবাসী। বদলে গিয়েছে ঠিকানা, বদলেছে বাসা। কোনও মতে যাযাবরের মতো ঠাঁইনাড়া হতে হতে হতে নেই হয়ে গিয়েছে একটা-দু'টো করে মানুষ। উদ্বাস্তু স্রোত হেঁটে বেরিয়েছে গাজার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ইজরায়েলের ভয়াবহ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাঁড়ায় বিশ্বের মানুষ। কিন্তু তাতে অবস্থাটা বদলায় না। এরই মধ্যে বাহামাস প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশগুলি ফের যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। না, কর্ণপাত করে না ইজরায়েল। হামলা চলতে থাকে গাজা জুড়ে। মানুষ মরতে থাকে রোজ। কখনও শরণার্থী শিবির, তো কখনও স্কুল, কখনও হাসপাতাল, মধ্যরাতে ইজরায়েলের বিমান থেকে নামে বোমা। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গাজার শরীর। গোটা দেশটাই যেন গণকবর। যেখানে কাফন দেওয়ার লোকের সংখ্যা কমতে থাকে ক্রমশ।
গাজার যুদ্ধে প্রথম থেকেই সব চেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে সেখানকার শৈশব। যেমনটা হয় যে কোনও জায়গায় যুদ্ধ লাগলে। তুরস্ক, সিরিয়া প্রায় সর্বত্রই সেই ছবি আমরা দেখেছি। হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ নেই, ভয়ঙ্কর অপুষ্টি, পেটে একফোঁটা খাবার নেই। এরই মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। শোনা যায়, আন্তর্জাতিক আদালতে গ্রেফতারও হতে পারেন তিনি। তবে তার মধ্যেই গাজায় হামলা চালানো জারি রাখে সে দেশ। বন্দিমুক্তি নিয়ে ইজরায়েল-হামাসের রফা হয় না। যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা মাঠে মারা যায় প্রতিবার। আর ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে প্রহর গুনতে থাকেন অজস্র মানুষ। কখনও ত্রাণের লাইনে বাটি হাতে কাতর মুখগুলোর শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে দেয় ইজরায়েলি গুলি, কখনও বা আল-জালার মতো নিরাপদ জায়গাও হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ।
যুদ্ধ আসে যুদ্ধ যায়
এরই মধ্যে ইরানে মৃত্যু হল হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়েহর। তার আগেই অবশ্য তাঁর বাড়ির সদস্যদের গাজায় হত্যা করেছে ইজরায়েলি সেনা। তার জায়গায় হামাসের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে। তার আগে তিনি ছিলেন সংগঠনের সশস্ত্র শাখার প্রধান। হানিয়েহের অবর্তমানে তিনিই হয়ে উঠলেন হামাসের মূল সংগঠনের হত্তাকর্তা। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার পর থেকেই নানা ভাবে ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে গিয়েছে লেবাননের সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের জঙ্গিগোষ্ঠী হাউথিরা। এই হিজবুল্লাহ, হাউথি বা হামাস, তিনটি সংগঠনকেই ভিতরে ভিতরে মদত জুগিয়ে চলে ইরান। হামাসের সঙ্গে সংঘাতের আবহে বহুবার ইজরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেঁধেছে হিজবুল্লাহ ও হাউথির। এমনকী সম্ভাবনা উস্কে মধ্যিখানে একবার ইরানের সঙ্গেও সংঘাতে জড়িয়েছিল ইজরায়েল। তবে আমেরিকার মধ্যস্থতায় সেই জল বেশি দূর গড়ায়নি। রাফাহ আক্রমণকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ইজরায়েলকে অস্ত্রের জোগান বন্ধ করার হুমকি দিলেও শেষপর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। রাফাহতে যথেচ্ছ হামলা চালিয়ে গিয়েছে ইজরায়েল। সম্প্রতি লেবাননে পেজার বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে হিজবুল্লাহ-ইজরায়েল সংঘাত ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গাজার মতোই প্রবল আগ্রাসন নিয়ে লেবাননের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে ইজরায়েল। পরবর্তী গাজা কি হতে চলেছে তবে লেবানন, এই সম্ভাবনায় যখন কাঁটা গোটা বিশ্ব, সেই সময় হিজবুল্লাহ নেতা নাসরাল্লাহকে হত্যার প্রতিবাদে ইজরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে বসে ইরান। এই পরিস্থিতিতে ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আমেরিকাও। ইতিমধ্যেই হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতের আবহে ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে হাউথিরাও। যার উত্তর ইয়েমেনে ফিরিয়েছে ইজরায়েল।
আরও পড়ুন: গাজার আশ্রয় শিবির, স্কুলে বারবার হামলা! নিরপরাধের ‘গণহত্যা’ই কি পাখির চোখ নেতানিয়াহুর?
মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতবস্থা ঘেঁটে যখন প্রবল হয়ে উঠছে দুই অক্ষশক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা, সেই সময়েও কিন্তু গাজাবাসীর মাথার উপর ঘাই মেরে চলেছে ইজরায়েলের বোমারু বিমান। হামলা-হিংসা এখনও চলছেই গাজা জুড়ে। এরই মধ্যে গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধশুরুর বর্ষপূর্তি। শান্তি ফেরেনি গাজায়। দেখতে দেখতে গাজায় মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে প্রায় ৪২ হাজার। জখম এক লক্ষেরও বেশি। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রাণ এখনও ঝুলছে সেই গিলেটিনেই। যে কোনও মুহূর্তে যা কিছু ঘটে যেতে পারে। ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধের কাঁটা যে তাঁদের মুক্তির পথ হবে না, তা ভালোই জানেন নিরপরাধ গাজাবাসী। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যে নরক-যাপনে প্রবেশ করেছিল গাজার মানুষ, তার থেকে মুক্তি কোথায়, কবে, সেই উত্তর বোধহয় নেই কারওর কাছেই। আসলে কি গাজার মানুষের পক্ষে কোথাও কেউ কখনও ছিলেন? হামাস মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে নিরপরাধ মানুষগুলোকে। ইজরায়েল দাম দেয়নি প্রাণের। ইরান কিংবা যুদ্ধবাজ অন্য কোনও সংগঠনের কাছেও যে তাঁদের প্রাণের মূল্য নিতান্তই শূন্য, তা জানে গাজা। তাই বোধহয় প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ার আগে দৈবের কাছে একটা করে দিন প্রাণভিক্ষা চেয়ে যান গাজার মানুষ। যদি আরও একটা দিন বেঁচে যান তাঁরা। যদি আরও একটা দিন সূর্যের আলোয় চোখ ধোয়ার সুযোগ হয়, কোনও বোমা কিংবা যুদ্ধবিমান এসে মাটিতে চিরতরে শুইয়ে দেওয়ার আগে। ঈশ্বরের কাছে নতজানু হন, কৃতজ্ঞ হন প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য। এ-ও এক বিস্ময় যেন।