প্রসেনজিৎরা বাংলা বলা নিয়ে কেন লজ্জিত?

Prosenjit: কয়েকদিন আগেই, ‘মালিক’-এর ট্রেলার লঞ্চ হয়ে গেল বম্বের জুহুতে। আর সেই ট্রেলার লঞ্চের অনুষ্ঠানকে ঘিরেই এখন তীব্র বিতর্ক। সৌজন্যে প্রসেনজিতের উষ্মা।

অনেক দিন পর রাজকুমার রাও আসছেন তাঁর নতুন ছবি ‘মালিক’ নিয়ে। ছবির বিষয়: অ্যাকশন-থ্রিলার। রাজকুমার ছাড়াও, ছবিতে রয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ শুক্লা, স্বনন্দ কিরকিরে, হুমা খুরেশি, মানসী চিল্লার প্রমুখ অভিনেতারা। কয়েকদিন আগেই, ‘মালিক’-এর ট্রেলার লঞ্চ হয়ে গেল বম্বের জুহুতে। আর সেই ট্রেলার লঞ্চের অনুষ্ঠানকে ঘিরেই এখন তীব্র বিতর্ক। সৌজন্যে প্রসেনজিতের উষ্মা। আসলে, ট্রেলার লঞ্চের অনুষ্ঠানে, ছবিটি সম্পর্কে কথা বলছিলেন অভিনেতারা। যেমনটা অন্যান্য ট্রেলার লঞ্চেও হয়ে থাকে। সেখানে বাংলার প্রসিদ্ধ অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কেও সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। এবং তিনি তাঁর অভিনীত চরিত্র ও ‘মালিক’-এ অভিনয় করার অভিজ্ঞতা বিষয়ে বলতে থাকেন।

এইসব প্রশ্ন-উত্তরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক প্রসেনজিৎকে সকলের মধ্যে বাংলা ভাষায় নিজের প্রশ্নটি করেন। কী বলেন সেই সাংবাদিক? ট্রেলার লঞ্চের ভিডিওটি লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেই সাংবাদিক স্পষ্টত নিজের নাম ও পত্রিকার পরিচয় ইংরেজি ভাষায় জানিয়ে, তারপর নিজের প্রশ্নটি বাংলায় প্রসেনজিতের সামনে রাখছেন। অর্থাৎ তিনি যে ইংরেজি ভাষাতেও সমগ্র কথোপকথনটি চালাতে সক্ষম, তার একটি ভাষাসাবলীল নমুনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি নিজের পরিচয়টুকু জানানোর পর, মূল প্রশ্নবক্তব্যে ফিরে যেতে চাইলেন নিজের মাতৃভাষার কাছে। এবং প্রসেনজিৎকে প্রশ্ন করলেন, বাংলায়।

যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি একজন বাঙালি। যাঁকে প্রশ্ন করছেন, তিনিও একজন বাঙালি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? ফিরে যাব ট্রেলার লঞ্চের ভিডিওটির কাছে। দেখা যাচ্ছে, বাংলায় প্রশ্নটি করামাত্র বাঙালি অভিনেতার মুখমণ্ডল ভরে যাচ্ছে এক অদ্ভুত সংকোচ-বিস্ময়ে। প্রসেনজিৎ সেই সাংবাদিককে সরাসরি জিজ্ঞেস করছেন, ‘ওয়াই ডু ইউ নিড টু টক ইন বেঙ্গলি?’ তখন সেই বাঙালি সাংবাদিক বিনীতভাবে জানাচ্ছেন, ‘আমি বাংলাতে কথা বলতে চাই।’
বম্বেতে, বাঙালি অভিনেতার এই আচরণ অনেকের ভেতরেই কতগুলি তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণকে জাগিয়ে তুলেছে। বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও অধ্যাপক পবিত্র সরকার পুরো ঘটনাটির প্রেক্ষিতে জানিয়েছেন:

‘কোনও বাঙালি বাংলা বলার জন্য লজ্জিত বোধ করছেন, এ আমার জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতা। এর আগে অমিত শাহ মশাই বলেছিলেন, ভারতীয়রা ইংরেজি বলার জন্য লজ্জিত বোধ করবেন। সেটা করবে কি না করবে, পরের কথা। কিন্তু প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, একজন বাঙালি অভিনেতা হয়ে বম্বেতে গিয়ে তিনি এত বেশি ভারতীয় হয়ে গেলেন যে তিনি বাংলা শুনে লজ্জিত হচ্ছেন, বাংলায় প্রশ্ন করার জন্য লজ্জিত হচ্ছেন, এ আমার পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য বলে মনে হয়। আমি খুবই অবাক হয়েছি।’

‘আমি বাংলাতে কথা বলতে চাই’ ট্রেলার লঞ্চে সাংবাদিকের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম উত্তর কে দেয়? সেই সভায় উপস্থিত আরেকজন বাঙালি-অভিনেতা প্রসেনজিৎ? না। মঞ্চে, তাঁর পাশেই বসে-থাকা ভিন্নভাষী রাজকুমার রাও প্রত্তুত্যরে সেই সাংবাদিককে বলেন, ‘আপনি আপনার ভাষাতেই কথা বলুন, আমরা সকলের জন্য অনুবাদ করে নেব।’ এখন প্রশ্ন হল, বম্বের জুহুতে সমস্ত অবাঙালি মানুষের মধ্যে যদি একজন বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাকিরা বুঝবে কী করে? এ-সম্পর্কে ‘বোধশব্দ’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বাংলা হরফ, ভাষা ও বানান বিষয়ে একজন বিশিষ্ট চিন্তক সুস্নাত চৌধুরী-র বক্তব্য:

‘প্রসেনজিতের অবস্থান সত্যিই আপত্তিকর। আমার মাতৃভাষায় কেন আমি পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় কথা বলতে কুণ্ঠিত হব? যদিও মাথায় রাখা উচিত, যদি খুব মূলগত জায়গা থেকে দেখি, আমি যখন কোথাও গিয়ে নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে চাইছি, সেই প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হল, আমার ভাষা। এখন ভাষার কারণে কারোর কাছে আমার বক্তব্যতথ্য যদি না পৌঁছয়, সেটা মুশকিল। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে সেই ভিন্ন ভাষা-পরিমণ্ডলে কি কোনও দোভাষী আছেন? বা কেউ কি ট্রান্সক্রিপ্ট করে দিতে পারবেন? অনেকেই বলছেন, দক্ষিণের অভিনেতারা নিজের ভাষায় দেশের সর্বত্র কথা বলেন। শুধু দক্ষিণ কেন? বিভিন্ন দেশেই এমন হয়ে থাকে। শুধু দেখে নেওয়া উচিত, আমার ভাষাকে তর্জমা করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে কিনা। কারণ, ভাষার মূল লক্ষ কমিউনিকেট করা।’


এই বক্তব্যের যুক্তিকে মেনে নিয়েই মনে করিয়ে দিতে চাইব, ট্রেলার লঞ্চে সকলের সুবিধার জন্য এবং বাঙালি সাংবাদিকটিকে উৎসাহিত করার জন্যও আনন্দের সঙ্গে রাজকুমার রাও নিজেই সেই সাংবাদিকের প্রশ্নটি তর্জমা করে দিয়েছিলেন। বিরক্তি, সংকোচ, বা বাংলায় প্রশ্ন করছেন কেন? এমন বক্তব্যের বদলে, এই তর্জমাকাজটি তো প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় নিজেই করে দিতে পারতেন! বাংলা, তাঁর মাতৃভাষা। পাশাপাশি, হিন্দি ও ইংরেজিতেও তিনি সাবলীল। সেই সাংবাদিককে বাংলায় উত্তর দিয়ে, সকলের জন্য প্রশ্ন ও উত্তরটির ভাষান্তর করে নেওয়া কি তাঁর পক্ষে খুব কঠিন কাজ হত? বোধহয় না।

তাহলে সেই কাজ করার বদলে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মুখশ্রী ট্রেলার লঞ্চের অনুষ্ঠানে সংকোচ-বিরক্তিতে ভরে রইল কেন? এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চিন্তার দিকে সুস্নাত চৌধুরী আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রসেনজিৎবাবু নতুন কিছু করেননি। আজকের অধিকাংশ বাঙালি এই কাজটিই করে থাকেন। কলকাতা শহরের সামান্য একটু দামি রেস্তরাঁয় গেলে, বেশিরভাগ বাঙালিই অর্ডারটা ইংরেজিতেই দেন। কারণ তাঁদের দেখাতে হয়, তাঁরা ইংরেজিতে কথা বলছেন। যাঁরা প্রসেনজিতের বাংলা ভাষার সংকোচ নিয়ে এত কথা তুলছেন, তাঁদের মধ্যে ক-জন নিজেদের সন্তানের স্কুলের মিটিং-এ গিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন? আসলে, আজকের বাঙালিসমাজের এক প্রধান অংশ মনে করেন, ইংরেজি বলতে পাড়ার সঙ্গে আধুনিকতার এবং বিত্তের একটি সম্পর্ক আছে। ফলে, বাঙালি যা করে থাকেন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ঠিক তা-ই করেছেন।’

এই মনোভাবের আরও উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়, শহরের বিভিন্ন ফিল্ম পুরস্কার অনুষ্ঠানগুলিতে। যেখানে অনেক সময়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রায় জোর করে একটি পোশাকি ইংরেজি বলার চেষ্টা করেন। ফলে, অনেক সময়েই তাঁদের বক্তব্য ও ব্যক্তিত্ব, দুই-ই অস্পষ্ট থেকে যায়।

এখানে প্রশ্ন জাগে, কোনও এক কাঠামোকে মানতে গিয়ে আমরা নিজের জিনিসকে হারিয়ে ফেলব কেন? একটি নির্দিষ্ট ভাষা, নির্দিষ্ট কিছু পোশাক এবং নির্দিষ্ট কিছু আচরণ সমাজের সামনে রাখতে পারলেই কি আমরা এক অব্যক্ত অথচ অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবেশ করার রাজ-দরোজাটি দেখতে পাই? নাকি এ কেবলই এক মানসিক দুর্বলতা? নিজের মতো নয়, অন্যের মতো হওয়ার অন্ধ ও নেশাময় ইচ্ছে?

এর উত্তর আজকের বাঙালির কাছে আছে কি?

More Articles