কাশ্মীরের জবাবে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত! ভারতের সিদ্ধান্তে কোন বিপদের মুখে পাকিস্তান?
India-Pakistan Indus Waters Treaty: আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে, ভারত চাইলে পাকিস্তানে বন্যা বা খরা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে।
বুধবার জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে বহুকালের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভারতের মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিএস)। পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর এই নৃশংস হামলার দায় স্বীকার করেছে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈবা জঙ্গিগোষ্ঠীর ছায়া সংগঠন দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ)। এই চুক্তি স্থগিত করে দেওয়ার ফলে সিন্ধু নদী এবং এর শাখা ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস ও সাতলুজের জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এই নদীগুলি পাকিস্তানের মানুষের জলের বড় উৎস। ফলে চুক্তি স্থগিত হওয়ার কারণে সেই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ সমস্যায় পড়বেন৷
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে যখন পুলওয়ামাতে আধাসামরিক কর্মীদের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্যাবিনেট কমিটিকে বলেছিলেন, "রক্ত এবং জল একসঙ্গে বইতে পারে না।" তবে সেই সময় ভারত চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করার পথে হাঁটেনি।
চুক্তির ইতিহাস
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৬০ সালে সিন্ধু জল চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি এই চুক্তিতে সই করেছিল বিশ্বব্যাংকও। চুক্তিতে সিন্ধু নদ এবং এর উপনদীর জল দুই দেশের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। চুক্তি মোতাবেক পূর্ব দিকের তিন নদী - বিয়াস, রাভি এবং সতলুজের জল ভারতকে এবং পশ্চিম দিকের তিনটি নদী চেনাব, সিন্ধু এবং ঝিলামের জল পাকিস্তানে যাবে।
চুক্তিতে বলা হয়, দুই দেশ নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে একে অন্যের নদীগুলি ব্যবহার করতে পারবে, যেমন ছোট জলবিদ্যুৎ প্রকল্প যাতে তেমনভাবে কোনও জল সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় না বা অল্প সঞ্চয় করলেই কাজ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-খাগড়াগড় থেকে পহেলগাঁও, কীভাবে কাজ করে জঙ্গিদের প্রতিশোধমূলক প্রক্সি প্যাটার্ন?
ভারত আর পাকিস্তানের ভগে কী কী আছে?
এই চুক্তির ফলে ভারত পূর্বদিকের তিনটি নদী - বিয়াস, রাভি এবং সতলেজের জলের উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছে। এই তিনটি নদীর গড় বার্ষিক জলপ্রবাহ ৪১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। অন্যদিকে তিনটি পশ্চিমবাহী নদী - সিন্ধু, চেনাব এবং ঝিলামের জলের উপর নিয়ন্ত্রণ আছে পাকিস্তানের। এই তিন নদীর গড় বার্ষিক জলপ্রবাহ ৯৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। ভারতে অবস্থিত সিন্ধু নদী প্রণালী দ্বারা বাহিত মোট জলের প্রায় ৩০% ভারত পেয়েছে, বাকি ৭০% পাকিস্তান পেয়েছে।
এই চুক্তির ফলে ভারত সীমিত সেচ ব্যবহারের জন্য পশ্চিমবাহী ৩টি নদীর জল ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌচলাচল, মাছ চাষ ইত্যাদির মতো ক্ষেত্রেও ওই জল ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। পশ্চিমবাহী নদীগুলির উপর প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতের জন্য বিশদ বিধিরও উল্লেখ আছে চুক্তিতে। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তির প্রস্তাবনায় সদিচ্ছা, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার চেতনার কথা বলা হয়েছে। সিন্ধু প্রণালী থেকে পাওয়া জলের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য প্রতিটি দেশের অধিকার এবং কর্তব্যকে নিশ্চিত করা হয়েছে চুক্তিতে।
সিন্ধু জল চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু প্রণালীর নদীগুলির ভারতীয় অংশে যদি পাকিস্তান বোমাবাজি করে বাঁধ ধ্বংস করে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নষ্ট করে দেয় তাহলে তা চুক্তির লঙ্ঘন। এগুলি সিন্ধু জল চুক্তি বাতিলের কারণ হতে পারে।
বাঁধ বিরোধ
সিন্ধু জল চুক্তিতে মূলত জল বণ্টন নিয়ে শান্তি সমঝোতা নিশ্চিত করা হলেও জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত কিষাণগঙ্গা এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ রয়েছে। কিষাণগঙ্গা নদী হচ্ছে ঝিলামের এক উপনদী। বান্দিপোরা জেলার কিষাণগঙ্গা নদীর ওপরে কিষাণগঙ্গা প্রকল্পটি ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল। কিশতওয়ার জেলার চেনাব নদীর উপর রাতল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে নির্মাণাধীন।
এই বাঁধ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই করা। পাকিস্তান ভারতীয় বাঁধের নকশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। তাদের দাবি, এতে নদীগুলির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের সেচের উপর নির্ভরশীল ফসলের ৮০% এই জলেই পুষ্ট। ভারতের এই প্রকল্পে পাকিস্তানের ক্ষতি বলে দাবি করে ভারতের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে পাকিস্তান৷
পরে আদালতের একটি অন্তর্বর্তী আদেশের ফলে ভারত আবার কিষাণগঙ্গা বাঁধ নির্মাণ শুরু করার অনুমতি পায়। আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, জলের প্রসারণ রোধ করতে হবে পাকিস্তানের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করেই কিন্তু ইসলামাবাদ বলে যে পাকিস্তানের উদ্বেগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ কারণ উপনদীর জল সেখানে সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়, ফলে খাদ্য নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য তা প্রয়োজনীয়।
আরও পড়ুন-কেউ মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে, কেউ পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে নিহত! পহেলগাঁও প্রাণ কাড়ল যাদের
এই বছর, নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত স্থায়ী সালিশি আদালত ভারত সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে রায় দেয় যে বিশ্বব্যাংক-নিযুক্ত একজন নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ সিন্ধু জল চুক্তির বিধানের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরের দু'টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নকশা এবং জল ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম৷
কাশ্মীরের কিষাণগঙ্গা এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আদালতে যে আবেদন করেছিল তার ভিত্তিতেই এই রায় দেওয়া হয়েছে। ভারত এর বিরোধিতা করে বিশ্বব্যাংক-নিযুক্ত নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে বিষয়গুলি সমাধান করার উপর জোর দিয়েছিল। রায় ভারতের পক্ষেই যায়।
অন্যদিকে পাকিস্তানের কিছু বড় বাঁধ, যেমন মংলা, ঝিলাম নদীর উপর নির্মিত, এগুলি পাকিস্তানের ব্যবহারের জন্য অনেকটা পরিমাণ বিদ্যুৎ উত্পাদন করে।
পাকিস্তানের ভয়
সিন্ধু জল চুক্তি দুই দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নয়। তবে পাকিস্তান, পূর্ববাহিনী এবং পশ্চিমবাহিনী দুই নদীর স্রোতধারার মাঝের দেশ হওয়ায়, আশঙ্কা থেকেই যায় ভারত চাইলে পাকিস্তানে বন্যা বা খরা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে।
১৯৪৮ সালে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় নদীর জলের উপর অধিকার ভারত-পাকিস্তান জল বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ১৯৬০ সালে চুক্তি সমর্থনের পর থেকে, ভারত ও পাকিস্তান বেশ কয়েকটি সামরিক সংঘাতে জড়িত থাকা সত্ত্বেও কোনও জলযুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। বেশিরভাগ মতবিরোধ এবং বিরোধিতাই আইনি পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
সিন্ধু জল চুক্তিকে একসময় বিশ্বের সবচেয়ে সফল জল-বণ্টনের প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। অবশ্য অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু প্রযুক্তিগত বদল দরকার এই চুক্তিতে।