ডাইনি অপবাদে গোটা পরিবারকেই খুন! এই বর্বরতার শেষ কোথায়?

Witchcraft : দিল্লির নিরন্তর ট্রাস্ট ২০২৩-২৪ সালে বিহারে একটি সার্ভে করে। সেখানে উঠে আসে, ১৯৯৯ সালে এই নিয়ে আইন পাস হওয়ার ২৫ বছর পরেও এই প্রবণতা কমানো যায়নি।

ফের এক নরকীয় ঘটনা। ডাইনি অপবাদে একই পরিবারের ৫ জনকে খুন করে দেহ লোপাটের চেষ্টা করা হল বিহারের পূর্ণিয়া জেলায়। তাঁদের মারধর করে, পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এটি ৬ জুলাইয়ের ঘটনা। কী ঘটেছিল সে দিন?

ওই গ্রামের একটি জলাশয় থেকে ৭ জুলাই ৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পূর্ণিয়া সদরের সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) পঙ্কজ কুমার শর্মা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, "এই হত্যার সঙ্গে ঝাঁড়-ফুক, ডাইনিবিদ্যার যোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নিহত পরিবারের এক সদস্য জানিয়েছেন, ডাইনিবিদ্যা অনুশীলনের অভিযোগ তুলে তাঁর বাড়ির ৫ জনকে মারধর করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।" পুলিশ তরফে জানানো হয়, কিছু দিন আগে ওই গ্রামের একটি বাচ্চার মৃত্যু হয়। অভিযোগ ওঠে, এই ঘটনার জন্য বাবুলাল ওঁরাও-এর পরিবার দায়ী। পূর্ণিয়ার ডিআইজি প্রমোদ কুমার মণ্ডল এএনআই-কে জানিয়েছেন, দু'জন মূল অভিযুক্ত-সহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, গ্রামের রামদেও মাহাতর পরিবারের একটি বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য বাবুলালদের উপর চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু বাচ্চাটিকে বাঁচানো যায়নি। এর পর থেকে অভিযোগ ওঠে বাবুলাল ওঁরাও -এর পরিবার ওই বাচ্চাটির মৃত্যুর জন্য দায়ী। বাচ্চাটির মৃত্যুর ঠিক ৪ দিন পর বাবুলালদের হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, ৬ জুলাই রাতে একদল লোক বাবুলাল ওঁরাওর বাড়িতে হামলা করে। পরিবারের সদস্যদের বাড়ি থেকে টেনে বের করে এনে বেধড়ক মারধর করার পর তাঁদের মৃত্যু হলে, পুড়িয়ে দেহ লোপাটের চেষ্টাও করা হয়। মৃতদেহ গুম করতে জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মৃত বাবুলাল ওঁরা-এর ১৬ বছরের নাবালক সন্তান।

আরও পড়ুন- ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দে অ্যালার্জি! কাদের, কেন?

আগেও ডাইনি সন্দেহে হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে।

ডাইনি সন্দেহের বিভিন্ন ঘটনা

২৮ মার্চ, ২০২২ সালে বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের পাড়ুই থানা এলাকায় ডাইনি অপবাদে এক অন্তঃসত্ত্বা-সহ একই পরিবারে আট জনকে গ্রামছাড়া করার অভিযোগ উঠেছিল। তাঁদের ওপর গ্রামের একাংশ চড়াও হলে আতঙ্কে থানায় আশ্রয় নেয় ভুক্তোভোগী ওই পরিবার।

২০২৫ সালের ২১ নম্ভেম্বর, বিজলকোনা গ্রামের কুবিরবেড়ে নামের এক আদিবাসী পাড়ায় কিছু বছর ধরেই ছাগল-হাঁস-মুরগি অসুখে মারা যাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠছিল। এর মধ্যেই পাড়াতে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে ১২ বছরের একটি মেয়ের মৃত্যু হয়। গ্রামের সকলের সন্দেহ হয় গ্রামের বৃদ্ধা নীলমনি মূর্মূর জন্যই এ সব ঘটছে। গ্রামের কয়েকজন বাঁশ ও লাঠি দিয়ে তাঁকে মারধর করে। তাঁর স্বামী প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ নীলমণি দেবী এবং তাঁর স্বামী লক্ষ্মীকান্ত মুর্মুকে উদ্ধার করে।নীলমণিদেবীকে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল।

৮ আগষ্ট ২০১৫, ঝাড়খন্ডে পাঁচ মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। রাতের বেলা এই ৫ মহিলাকে ঘুম থেকে তুলে বাইরে এনে মারা হয়। পরিবারের সদস্যরা অনেক কাকুতি-মিনতি করলেও হামলাকারীরা ছাড়েনি।

আরও পড়ুন- কেন্দ্রের শিক্ষানীতি রাজ্যে চালু না হতে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে?

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ময়ূরেশ্বরের হরিশরা পাড়ায় ডাইনি সন্দেহে দুই মহিলাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে গ্রামবাসীরা। তিন দিন ধরে তাঁরা নিখোঁজ ছিলেন। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ডাইনে সন্দেহে খুনের কথা সামনে আসে।

দিল্লির নিরন্তর ট্রাস্ট ২০২৩-২৪ সালে বিহারে একটি সার্ভে করে। সেখানে উঠে আসে, ১৯৯৯ সালে এই নিয়ে আইন পাস হওয়ার ২৫ বছর পরেও এই প্রবণতা কমানো যায়নি। নিরন্তর ট্রাস্টের সদস্য দিপ্তা ভোগ ফ্রন্টলাইন-কে বলেছেন, বিহারের প্রতিটি গ্রামের কমপক্ষে দুই-ততাধিক মহিলাকে ডাইনি সন্দেহ করা হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৭৫,০০০ মহিলা।

এনসিআরবি -র তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১৫ বছরে ২,৫০০ মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে। ২০২২ সালের এনসিআরবি-র রিপোর্টে শুধুমাত্র সেই বছরেই ভারতজুড়ে ৮৫ জন মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করার তথ্য উঠে এসেছে। বেশিরভাগই ঘটেছে ঝাড়খণ্ড (২২.৬ শতাংশ), ওড়িশা (১৬.১ শতাংশ), মধ্যপ্রদেশ (১৫.১ শতাংশ) এবং ছত্তিশগড় (১৩.১ শতাংশ)-এ।

ডাইনি প্রথার মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারি ভাবে নানা সচেতনা প্রচারের পরেও ডাইনি সন্দেহে একের পর ভয়াবহ ঘটনা সামনে আসছে। প্রশ্ন উঠছে, কেন তবুও ডাইনি সন্দেহে হামলার আটকানো যাচ্ছে না?

More Articles