দেশে দেশে গুপ্তহত্যা! কী ভাবে কাজ করে ইজরায়েলি গোয়েন্দা বিভাগ?
Israeli Intelligence : ইজরায়েলের এই দুই গোয়েন্দা সংস্থা, একটি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স 'মোসাদ', আরেকটি হলো ইন্টারনাল সিকিউরিটি এজেন্সি 'শিন বেট'। এই দুই সংস্থার সাথে যৌথভাবে কাজ করে মোসাদ।
বিদেশে টার্গেট করে যেসব গুপ্তহত্যা হয়েছে তাতে একাধিকবার ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর নাম উঠে এসেছে। বিশেষ করে সামনে এসেছে তাদের গোয়েন্দদের নাম। ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রথমদিনেই ইরানে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হন। এধরণের হামলা এটিই প্রথম নয়। ২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইজরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন লেবাননের ইরানপন্থি শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ-র প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ। দক্ষিণ বৈরুতের দাহিয়াহ এলাকায় হাসান নাসরাল্লাহ এবং তাঁর দলের অন্য উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা নিহত হন। খোলসা করা যাক, ইজরায়েল কীভাবে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়? ইজরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে? তাদের কী ধরণের সক্ষমতা রয়েছে?
ইজরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের প্রধান দুই ইউনিট
মোসাদ
মোসাদ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে, ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর পর।
তাদের কাজ ছিল ইজরায়েলকে বাইরের হুমকি থেকে রক্ষা করা। এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল ইজরায়েলকে নিরাপদ রাখা।
ইরান অভিযোগ করেছে, ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাদের দেশের ভেতর থেকেই ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালিয়েছে। বছরের পর বছর তেহরানের মাটিতে বসেই মোসাদ ইজরায়েলের অপারেশন 'রাইজিং লায়ন'-এর ছক কষেছে। এই নিখুঁত হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ইরানের পারমাণবিক গবেষণাগার। তারা ইরানের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক ঘাঁটি টার্গেট করে হামলা করেছে৷ এতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভ্যুলেশনারি গার্ড-এর কমান্ডার হোসেইন সালামি-সহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্তত ৯ জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইরান।
শাবাক বা শিন বেট
শাবাক বা শিন বেট গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব হলো ইজরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। শিন বেট দাবি করে, তারা গাজা থেকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে আসা হুমকির বিরুদ্ধে 'অদৃশ্য ঢাল' হিসেবে কাজ করে।
ইজরায়েলের এই দুই গোয়েন্দা সংস্থা, একটি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স 'মোসাদ', আরেকটি হলো ইন্টারনাল সিকিউরিটি এজেন্সি 'শিন বেট'। এই দুই সংস্থার সাথে যৌথভাবে কাজ করে মোসাদ।
আমান
আমান হলো ইজরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। এটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাধারণ সদর দপ্তরের অধীনে কাজ করে। এই সংস্থার প্রধান কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সামরিক কমান্ডকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা।
ইজরায়েলের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস ইজরায়েলের জন্মেরও আগের। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত "শাই" নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই দেশে কাজ করত। এটি ছিল ইহুদি আধা-সামরিক সংগঠন "হাগানাহ"-এর গোয়েন্দা শাখা। ইজরায়েল জন্ম নেওয়ার পর "আমান" তৈরি করা হয় হাগানাহর ধারণার ওপর ভিত্তি করেই। আমান বেশ কয়েকটি ইউনিট নিয়ে গঠিত। তার মধ্যে ৮২০০, ৯৯০০ এবং ৫০৪ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। এই ইউনিটগুলি গাজায় ইজরায়েলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই ইউনিটগুলোর দায়িত্ব হলো ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান থেকে আসা গোয়েন্দা ও সামরিক হুমকি সনাক্ত করা। গাজায় ইজরায়েলি আক্রমণ শুরুর আগে সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও উঠে এসেছিল যে ইজরায়েল তাদের গোয়েন্দা বাহিনীতে নতুন একটি ইউনিট যুক্ত করেছে, যার নাম "ব্রাঞ্চ ৫৪"। বলা হয়েছিল, "ব্রাঞ্চ ৫৪" দেশের সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের অধীনে কাজ করবে এবং দায়িত্ব হবে ইরান ও বিশেষ করে "পাসদারান-ই-ইনকিলাব" (ইরানি বিপ্লবী গার্ড)-এর সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া।
ইউনিট ৮২০০
ইউনিট ৮২০০-কে ইজরায়েলি গোয়েন্দা ব্যবস্থার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এই ইউনিটের মাধ্যমেই ওই দেশের সেনাবাহিনী ইলেকট্রনিক মাধ্যমে তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা করে।
তথ্য অনুযায়ী, ইউনিট ৮২০০-তে ১০ হাজারেরও বেশি লোক কাজ করে এবং এখানে যারা কাজ করে তারা এলিট এবং শিক্ষিত বাহিনী থেকে বাছাই করা। এমনও বলা হয়, এই ইউনিটের সদস্য সংখ্যা মোসাদ ও শিন বেটের সদস্যদের থেকেও বেশি। ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক যন্ত্র বানানোর দায়িত্বও ইউনিট ৮২০০-এর। প্রযুক্তির দিক থেকে এই ইউনিটের নাম আসে বিশ্বের বড় বড় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে। শুধু তাই নয়, আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সমতুল্য বলেও মনে করা হয়।
২০১০ সালে ইরানে পারমাণবিক ঘাঁটিগুলির উপর সাইবার হামলায় ইউনিট ৮২০০ জড়িত ছিল বলেও অভিযোগ। ইরানি ঘাঁটিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করতে স্টাক্সনেট (Stuxnet) নামে একটি ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছিল। একটি ইজরায়েলি সংবাদপত্র 'হারেতসে '- একটি সাক্ষাৎকারে ইউনিট ৮২০০-এর উপ-কমান্ডার ইউরি সিভ বলেছেন, "সাইবার জগতে ইরানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধের মতো নজির পৃথিবীতে আর দুটি নেই।"
এই ইউনিট গঠিত হয় ১৯৫২ সালে। প্রথম নাম ছিল সেকেন্ড ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ইউনিট। পরে এই ইউনিট ৮৪৮ বা ৫১৫ নামেও পরিচিত পায়। ১৯৬৭ সালে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইজরায়েলের ছয় দিনের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ইজরায়েল জিতেছিল। ইউনিট ৮২০০ মিশর ও সিরিয়া থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে মূল ভূমিকা রেখেছিলো।
ইউনিট ৯৯০০
ইউনিট ৯৯০০ ইজরায়েলের অন্যতম গোয়েন্দা সংস্থা। এই ইউনিটের দায়িত্ব হলো ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা। এজন্য এই ইউনিট স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে। এই ইউনিট ছবি ও ভিডিওর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সেনা কমান্ডার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট পৌঁছে দেয়। ইউনিটটির কাছে আধুনিক প্রযুক্তি আছে। এতে যুদ্ধে লিপ্ত ইজরায়েলি সেনাদের জন্য থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করা সহজ হয়।২০২০ সালে এই ইউনিটের ভেতরে আরেকটি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার দায়িত্ব হলো গোয়েন্দা ড্রোনের কার্যক্রম আরও বাড়ানো। বিবিসি-র তথ্য অনুযায়ী, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইরানকে পর্যবেক্ষণ করাও ইউনিট ৯৯০০-এর দায়িত্ব। যা ইজরায়েলের গোয়েন্দা স্যাটেলাইট 'হরাইজন ১৩' দিয়ে করা হয়।
ইউনিট ৫০৪
ইউনিট ৫০৪ গঠনের উদ্দেশ্য, মানুষের গোয়েন্দা তথ্য (হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স) সংগ্রহ।
এই ইউনিটের প্রধান দায়িত্ব, দেশের ভেতরের হুমকিগুলো নজরে রাখা। এই ইউনিট ইজরায়েলের সীমান্তের বাইরেও গুপ্তচর নিয়োগ করে। গাজা-সহ অন্যান্য দেশেও এদের সৈন্য ও গোয়েন্দারা সক্রিয়। ইউনিট ৫০৪ সাধারণ মানুষের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে এবং কাজের প্রয়োজনে তারা মোসাদ ও শিন বেট-এর সঙ্গেও যৌথভাবে কাজ করে।
ব্রাঞ্চ ৫৪
২০২৩ সালের জুনে, ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছিল, তাদের সেনাবাহিনীতে নতুন একটি গোয়েন্দা ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের প্রধান কাজ হবে ইরান এবং "পাসদারান-ই-ইনকিলাব" (ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী)-এর সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। এই তথ্য "ওয়াই নেট" নামে এক ইজরায়েলি ওয়েবসাইটে প্রথম প্রকাশ করা হয়। তারা জানায়, ব্রাঞ্চ ৫৪ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইরানের সামরিক কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ কৌশল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য।
ওয়াই নেট-এর তথ্য অনুযায়ী, তখন এই ইউনিটে মাত্র ৩০ জন সদস্য কাজ করতেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রাঞ্চ ৫৪ প্রতিষ্ঠা আসলে ইরানি সামরিক হুমকি সম্পর্কে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিন্তা-ভাবনায় যে পরিবর্তন এসেছে তার ইঙ্গিত। এই গোয়েন্দা ইউনিটের একটি অংশ ইরানের সেই স্থানগুলো খুঁজে বের করে, যেখানে যুদ্ধ শুরু হলে আক্রমণ চালানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আমাদের কার্যক্রম শুধু ইরানের 'পাসদারান-ই-ইনকিলাব' (বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী) ঘিরেই।
এই ইউনিট টার্গেট শনাক্ত করতে গবেষণা করে যে কীভাবে সেগুলোতে প্রভাব ফেলা যাবে। ইতিমধ্যেই ইরানের অনেক টার্গেট খুঁজে বের করেছে এরা। ইরানের ওপর সাম্প্রতিক হামলায়ও এই গোয়েন্দা ইউনিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।