আজ বিয়ে! দিলীপ ঘোষ কি সঙ্ঘের উল্টোপথে হাঁটলেন তবে?

Dilip Ghosh Wedding: দিলীপ ঘোষ ছিলেন সংঘের প্রচারক। বিয়ে তাঁর অগ্রাধিকারের থাকার কথা নয়। তাহলে কি সংঘের উল্টো পথে হাঁটলেন দিলীপ?

সাধারণ চাকরিজীবনে মানুষ ৬০-এ অবসর নেন, গুছিয়ে রাখেন মেডিক্লেমের ফাইল, রোজের হুড়োতাড়া থেকে ছুটি নিয়ে শান্ত হয়ে যান। তবে ষাট পেরিয়ে কেউ কেউ জীবনকে নতুনভাবে দেখাও শুরু করেন। যেমন, দেখতে চলেছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ৬১ বছর বয়সি বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ বিয়ে করছেন, প্রথমবার! পাত্রী দলেরই মহিলা মোর্চার নেত্রী রিংকু মজুমদার। বিয়ের বয়স নেই, প্রেমেরও না। তবে দিলীপ ঘোষ নেহাতই সাধারণ মানুষ নন। তাঁর শিকড় গাঁথা আরএসএসে। আর আরএসএসের বিবাহ-প্রেম নিয়ে নিজস্ব বক্তব্যও আছে। মনে রাখতে হবে, দিলীপ ঘোষ ছিলেন সংঘের প্রচারক। বিয়ে তাঁর অগ্রাধিকারের থাকার কথা নয়। তাহলে কি সংঘের উল্টো পথে হাঁটলেন দিলীপ?

১৮ এপ্রিল নিউটাউনের নিজের বাড়িতেই আইনি বিয়ে সারবেন দিলীপ রিংকু। রিংকু মজুমদার বিবাহ বিচ্ছিন্না, তাঁর ২৫ বছর বয়সি এক পুত্র রয়েছে। যিনি বর্তমানে সেক্টর ফাইভের তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রে কর্মরত। শোনা গিয়েছে, দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলেছেন আরএসএসের নেতারাও। তবে দিলীপ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। প্রচারকরা কি সত্যিই বিয়ের অনুমতি পান না? কেন প্রচারকদের বিবাহ-সন্তানের ক্ষেত্রে এতবার ভাবতে হয়। বিজেপির অন্যান্য আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতারা কি সংসারধর্ম পালন করেননি? কেন নরেন্দ্র মোদি বৈবাহিক সংসার ছেড়ে দিয়েছিলেন? কেন অটল বিহারী আজীবন অবিবাহিত ছিলেন?

আরও পড়ুন-“তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী,” কেন যশোদাবেনকে বিয়ের কথা স্বীকার করতে চাননি মোদি?

দিলীপ ঘোষের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোপীবল্লভপুরের কাছে কুলিয়ানা গ্রামে। ভোলানাথ ঘোষ এবং পুষ্পলতা ঘোষের চার পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় দিলীপ ঘোষ ১৯৮৪ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের 'প্রচারক' হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আরএসএসের প্রচারক হিসেবে বাংলার বিভিন্ন জেলায়, এমনকী বাংলার বাইরেও কাজ করেছেন তিনি। দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সুনামি পরবর্তী আন্দামানে সঙ্ঘের তরফে যে ত্রাণপ্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন দিলীপই। ২০১৪ সালে দিলীপ ঘোষকে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। বঙ্গ বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ২০১৫ সালেই দিলীপ ঘোষ বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন।

এবার দেখা যাক, প্রচারকদের নিয়ে ঠিক কী কী নিয়ম আছে সংঘের। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সর্বক্ষণের স্বেচ্ছাসেবককে বলা হয় 'প্রচারক'। প্রচারকের জীবন ব্রহ্মচর্য, উত্সর্গ এবং প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। সাধারণত, যাঁরা 'সংঘ শিক্ষা বর্গ' নামে আরএসএস-এর তিনটি বড় প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়েছেন, তাঁদেরই পরবর্তীতে প্রচারক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। বর্তমানে, প্রায় ৬,০০০ প্রচারক রয়েছে আরএসএসের।

এছাড়াও আরএসএস-এর কিছু সর্বক্ষণের স্বেচ্ছাসেবককে 'বিস্তারক' নামেও ডাকা হয়। বিস্তরক প্রচারকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, বিস্তরক সর্বক্ষণের স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে এক বছর কাটান, আর প্রচারকের সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে এক বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা থাকে।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রচারকদের বলা হয় ঠিকানাবিহীন পোস্টকার্ড। কারণ যে কোনও ধরনের সাংগঠনিক কাজের জন্য যে কোনও সময় যে কোনও জায়গায় এই প্রচারকদের পাঠানো যেতে পারে। যে কোনও দায়িত্ব নিতে এবং সেই কাজের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিজেকে উত্সর্গ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে প্রচারকদের। আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক, সরকার্যবাহী এবং সহ-সরকার্যবাহীরা সকলেই প্রচারক।

প্রচারক বিয়ে করেন না। আরএসএসে প্রচারকদের গুরুত্ব ঠিক কতখানি তা বোঝা যাবে একটি উদাহরণ থেকেই। ভারতীয় জনতা পার্টির উৎপাদিত দুই প্রধানমন্ত্রী, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং নরেন্দ্র মোদি ছিলেন আরএসএস প্রচারক। বিজেপির সমস্ত রাজ্য ইউনিটের পাশাপাশি জাতীয় স্তরে 'সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন)'-এর সর্বোচ্চ পদে শুধুমাত্র একজন আরএসএস প্রচারকই থাকতে পারেন।

প্রচারকের রোজের জীবন ঠিক কেমন? প্রচারকরা আরএসএসের কার্যালয়েই থাকেন এবং সংঘের মতাদর্শ প্রসারের উদ্দেশে সারা দেশে ব্যাপক সফর করেন। প্রবীণ প্রচারকদেরও নিজেদের এই সফরের খরচের বিল জমা দিতে হয়, বদলে সেই খরচ তাঁদের সংঘ দেয়। কোনও বিলাসবহুল ভ্রমণ নয়। সবচেয়ে সস্তা উপায়ে যাওয়া আসা, থাকা খাওয়া সারতে হবে। ভোর হওয়ার আগে উঠে কাজ শুরু করতে হবে, কাজ চলবে মধ্যরাত অবধি। প্রতিদিন ১৬-২০ ঘণ্টা একজন প্রচারককে সাংগঠনিক কাজই করতে হয়। প্রতিদিনের খরচের জন্য নামেমাত্র বৃত্তি দেওয়া হয় তাঁদের।

বেশিরভাগ প্রচারকই স্বয়ংসেবকদের বাড়িতে খেতে পছন্দ করেন। তাতে বৃহত্তর সংখ্যক মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের পথ প্রশস্ত হয়। অনেক প্রচারকই সর্বক্ষণের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কয়েক বছর কাটান এবং তারপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান, বিয়ে করেন, কোথাও কাজ করে বা ব্যবসা শুরু করেন, তবে সারাজীবন আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।

আরও পড়ুন-বান্ধবীর মেয়েকে দত্তক! বাজপেয়ী আর ‘মিসেস কৌলে’র বন্ধুত্বের যে রসায়ন রইল অজানাই

প্রচারক বিষয়টি আরএসএসের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত। ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, প্রাথমিকভাবে আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ছিলেন একমাত্র সর্বক্ষণের স্বেচ্ছাসেবক। আরএসএস-এর কাজ যত ছড়িয়ে পড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে সেবকের সংখ্যা। প্রাথমিকভাবে, কলেজের কিছু ছাত্ররা স্বয়ংসেবক হয়েছিলেন। তাঁদের গ্রীষ্মের ছুটিতে বিদর্ভ এবং মহাকৌশল এলাকায় পাঠানো হয়েছিল। সেখানে প্রায় চার-ছয় সপ্তাহ কাটিয়ে আরএসএস শাখা শুরু করতেন তাঁরা। এঁদের বলা হতো ‘বিস্তারক’।

১৯৩২ সাল পর্যন্ত, আরএসএস 'প্রচারক' শব্দটি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করেনি। ওই সময় আরএসএস কর্মী দাদারাও পারমার্থ, বাবাসাহেব আপ্তে, রামভাউ জামগডে এবং গোপালরাও ইয়েরকুন্টওয়ার আরএসএসের প্রচার প্রসারের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ সময় কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৩২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, তাঁরা আরএসএসের পূর্ণ-সময়ের কর্মী হয়ে ওঠেন। বিজেপির নেতা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী নিজে আরএসএস প্রচারকদের দ্বারা এতটাই গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি ১৯৪৭ সালে আরএসএস প্রচারক হওয়ার জন্য পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

প্রচারকের উচিত ঠিকানাবিহীন পোস্টকার্ড হওয়া। কিন্তু দিলীপ তো নতুন ঠিকানায় ঠাঁই দিলেন জীবনকে। দিলীপ ঘোষ প্রচারক ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। বেতন পেতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ তিনি আর নিছক প্রচারক নন। দিলীপ ঘোষ আগেই খড়্গপুর থেকে বিধায়ক হয়েছেন। পরে তিনি মেদিনীপুরের সাংসদ হয়েছেন। দিলীপবাবু বিধায়ক ও সাংসদ হিসাবে বেতন পেয়েছেন। তাই তিনি আর প্রচারক নন। সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করতে বা বিয়ে করতে তাঁর আর কোনও বাধা নেই। প্রেম তো কাজের অন্তরায় নয়, বরং প্রেম কর্মশক্তিই। রাজনৈতিক কাজে প্রেম বা বিয়ের জন্য ব্যাঘাত ঘটার যে ধারণা বিজেপির একাংশের মধ্যে আছে, তা দিলীপ ঘোষ চুরমার করে দিতে পারেন কিনা, সেটিই দেখার।

More Articles