ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি: ব্রিটিশ ইতিহাসের প্রথম মহিলা গোয়েন্দাপ্রধান, সাম্রাজ্যবাদের নারীমুখ?

Blaise Metreweli: ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি — নাম শুনলেই মনে হয়, হয় একজন রহস্যময় ভিলেন, না হয় হ্যারি পটারের স্লিদারিন হাউসের প্রাক্তন ছাত্রী। কিন্তু না, তিনি হচ্ছেন বাস্তবের 'কিউ' থেকে 'সি' হওয়া এক সাহসী কর্মকর্তা।

এমআই৬-এ শেষ পর্যন্ত একজন মহিলা প্রধান! এ যেন সেই কল্পনারই বাস্তব রূপ, যেখানে পিয়ার্স ব্রসনানের ঠোঁটের কোণে সিগারেটের ধোঁয়া, আর ডেম জুডি ডেঞ্চ 'এম' হয়ে বলছেন, “বন্ড, তুমি একদম প্রস্তরযুগের পুরুষ।” এবং এখন, যখন বাস্তব এমআই৬-এ আসল 'এম' হচ্ছেন ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি, তখন মনে হচ্ছে, বন্ড সাহেব সম্ভবত এখন এক কাপ ক্যামোমিল চা নিয়ে রিটায়ারমেন্ট হোমে বসে ব্লগ লিখছেন: “Women in espionage: shaken, not stirred.”

ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি — নাম শুনলেই মনে হয়, হয় একজন রহস্যময় ভিলেন, না হয় হ্যারি পটারের স্লিদারিন হাউসের প্রাক্তন ছাত্রী। কিন্তু না, তিনি হচ্ছেন বাস্তবের 'কিউ' থেকে 'সি' হওয়া এক সাহসী কর্মকর্তা। 'কিউ' বিভাগ মানে যাঁরা প্রযুক্তি তৈরি করেন, বন্ডের ঘড়িতে রকেট বসান, পেনে বন্দুক ঢোকান, আর দরজার কাঁচ দিয়ে চিনির ঘনত্ব মাপেন — সেইরকমই এক বিভাগ। ভাবা যায়, ওই সব আবিষ্কারের মাথা এখন সোজা ডিরেক্টর চেয়ার গরম করছেন!

এমনিতেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার নাম শুনলেই মনে পড়ে সেই শীতল হাওয়ায় ভরা, গ্রে কোট পরে হাঁটা লোকজন, গোপন পাবে লেনদেন, আর মাথার ওপরে ক্যামেরা — যেটাকে ওরা বলে 'সিকিউরিটি', আমরা বলি 'ফেসবুকের বাপ'। আর এই গোয়েন্দাগিরির সাম্রাজ্যের চূড়ায় এখন বসছেন একজন মহিলা — মেট্রেওয়েলি। হ্যাঁ, ঠিক সেই মহিলা, যিনি ব্রিফকেস খুলে মগের চা রেখে বলেন, “আচ্ছা, আজ কাকে ফলো করি বলুন তো?”

আরও পড়ুন- সাহিত্যে উপেক্ষিত, পৃথিবীর প্রথম মহিলা গোয়েন্দার গল্প চমকে দেবে আপনাকেও

তবে একটা কথা মানতেই হবে — সময় কিন্তু অনেকটা লাগল। জুডি ডেঞ্চ 'এম' হয়েছেন ১৯৯৫ সালে। আর বাস্তবে একজন মহিলা 'সি' হচ্ছেন ২০২৫ সালে। মানে সিনেমা যা করে, ব্রিটেন তা করতে ৩০ বছর সময় নেয়। এমন হাল দেখে বন্ড সাহেবও বলতেন, “লাইসেন্স টু ডিলে!”

কুয়াশাচ্ছন্ন এক সকাল। লন্ডনের কোনও অদৃশ্য ঠিকানায়, অন্ধকার কাঁচঘেরা কক্ষে বসে আছেন এক নারী— ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি। বাইরের জগৎ জানবে না, ঠিক কী করেন তিনি। তাঁর টেবিলের ওপারে পড়ে থাকবে অদেখা এক মহাদেশের মানচিত্র, কিছু নামহীন ফাইল, আর একটি খোলা ল্যাপটপ, যার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ডেটা-স্ট্রিম। তিনি এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছায়া-মস্তিষ্কের অধীশ্বরী—এমআই৬-এর নতুন 'সি'।

দর্শনে শান্ত, উচ্চারণে সংযত, পোশাকে শালীন— তাঁর নিয়োগকে বলা হচ্ছে 'ব্রিটিশ গোয়েন্দা ইতিহাসের এক বৈপ্লবিক মুহূর্ত'। নারী নেতৃত্বের বিজয়, অন্তর্ভুক্তির জয়গাথা, আধুনিক যুগের বিজ্ঞাপন— সবই এখন তাঁকে ঘিরে। অথচ, এই সোনালি আলোচনার পেছনে এক গভীর ছায়া লুকিয়ে আছে। কারণ ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি কোনও কাল্পনিক চরিত্র তো নন; তিনি এক রাজনৈতিক বিন্যাসের বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণ। আর তাঁর অফিসের দেওয়াল— সেখানে আজও প্রতিধ্বনিত হয় ইতিহাসের কান্না।

তাঁর পেছনে যে প্রতিষ্ঠান, এমআই৬, তার হাতে রক্ত আছে— এ কথা আর নতুন কিছু নয়। ইরানের মোসাদকে ফেলে দেওয়া হোক, বা প্যালেস্টাইনে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আরব বিদ্রোহীদের গুপ্তহত্যার তালিকা— এই সংস্থার হাত ধরেই তৈরি হয়েছে আধুনিক ছায়াসাম্রাজ্য। আর সেইসব 'পাপের' পেছনে কখনও কোনও মুখ ছিল না। আজ, ইতিহাসের এই পাপচক্র যেন এক নতুন মুখ পেয়েছে— ব্লেইজ মেট্রেওয়েলি। তিনি হবেন সেই 'সফট পাওয়ার'-এর মুখ, যিনি ক্ষমতার নিশ্ছিদ্র নির্মাণকে 'নারী শক্তি'-র আলেয়ায় ঢেকে দেবেন।

এই নাটক নিছক নিপুণ নয়, চূড়ান্ত কৌশলী। যে দেশ তাদের ঔপনিবেশিক ছোবল দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী রক্ত ঝরিয়েছে, সেসব দেশের মানুষের কাছে আজ তাদের বার্তা— “দেখো, আমাদের চেহারা বদলে গেছে। আমরা আর সেই পুরনো ব্রিটিশ নই। এখন নেতৃত্বে আছেন একজন নারী, একজন আধুনিক, সংবেদনশীল, টেকনোক্র্যাটিক মস্তিষ্ক।” কিন্তু বাস্তব বদলেছে কি?

ব্লেইজ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থী ছিলেন। আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইওরোপ— তাঁর কাজের অঞ্চল যেন সেইসব মানচিত্রের ছায়া, যেখানকার প্রতিটি কোণে আজও ব্রিটিশ নকশা জমে আছে। তিনি দায়িত্বে এসেছেন এমন এক সময়ে যখন পশ্চিমা গোয়েন্দা ব্যবস্থা ধসে পড়ছে চিন ও রাশিয়ার ডিজিটাল উত্থানের সামনে; যখন আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স ছিটকে পড়েছে, আর ব্রিটেন ফের গোপনে ‘স্থলদখল’ শুরু করেছে।

এমন সময়ে এমআই৬-এর এই নারীমুখ যেন এক নতুন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের ব্যানার। পুরনো আধিপত্য নতুন পোশাকে।

ঠিক যেমন ২০১৮ সালে সিআইএ প্রধান হলেন জিনা হাসপেল— আরও এক নারী, আরও এক 'প্রথম'— যিনি গুয়ানতানামোর নির্যাতনের সুদৃঢ় ব্যবস্থাপক ছিলেন। নারীমুখে আধিপত্যের মুখোশ নতুন নয়; নারী যখন রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ব্যাজ পরেন, তখন তা হয়ে ওঠে নারীবাদের এক ভয়ানক প্রহসন।

ব্লেইজ এখন বলছেন, নতুন চ্যালেঞ্জ হলো সাইবার গুপ্তচরবৃত্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে 'শত্রু' চিহ্নিতকরণ, কোয়ান্টাম এনক্রিপশন ভেঙে তথ্য সংগ্রহ। বাস্তব অর্থ হলো — বিক্ষোভ দেখানো নাগরিক, সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করা ব্যক্তি কিংবা কোনও অভিবাসী সম্প্রদায়— তাদের ‘ঝুঁকি’ হিসেবে চিহ্নিত করার নতুন ব্যবস্থা। এক ধরনের ‘অদৃশ্য স্বৈরতন্ত্র’। আর এই নজরদারির মাথায় থাকবেন একজন নারী— তাতে যেন আপত্তির জায়গা স্বয়ং নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে।

আরও পড়ুন-রুদ্ধশ্বাস! যেভাবে গোয়েন্দারা উদ্ধার করলেন ভ্যান গগের চুরি যাওয়া ছবি

এই গোয়েন্দা নজরদারি শুধু বিদেশের জন্য নয়, ঘরের ভেতরেও। ব্রিটেনে এখন অভিবাসন-বিরোধী আইন, ধর্মীয় প্রোফাইলিং, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের নজরদারি—সব কিছুতেই এমআই৫-এর পাশাপাশি এমআই৬ যুক্ত। 'বিদেশি হুমকি' আর 'ঘরের শত্রু'-র সীমারেখা আজ ঝাপসা। সেই রেখার ওপারে দাঁড়িয়ে ব্লেইজ এখন ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি’-র মুখ— একজন নারী যিনি দৃশ্যত শান্ত, বাস্তবে এক যন্ত্রের চালক।

তাঁর নিয়োগ কি শুধুই প্রগতির চিত্র? না কি এক চূড়ান্ত প্রতীকী সিদ্ধান্ত— যেখানে সাম্রাজ্যবাদের নতুন আস্তর লাগানো হচ্ছে নারীবাদের রংতুলিতে?

যখন ব্রিটিশ রাজার অভিষেক হয় আফ্রিকার হীরকমুকুট মাথায় রেখে, যখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নাইজারে সামরিক শাসনের পতন দেখে অসহায়, তখন পশ্চিমা দুনিয়া জানে— তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। ঠিক তখনই প্রতীক এসে দাঁড়ায়। এক নারী, যিনি বলবেন, “আমরা বদলে গেছি।” অথচ তাঁর অফিসে সাঁজোয়া চেয়ারে বসে সেই পুরনো নির্দেশনাই লেখা থাকবে— “তথ্য আনো, নিয়ন্ত্রণ করো, এবং যেকোনও মূল্যে প্রভাব ধরে রাখো।”

এটাই ব্লেইজ মেট্রেওয়েলির ট্র্যাজেডি— তিনি একজন নারী নন শুধু, তিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এক নিপুণ নির্মাণ। আমরা যদি এই নির্মাণকে চ্যালেঞ্জ না করি, তাহলে এই খণ্ড নারীবাদ একদিন শুধুই রাষ্ট্রের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠবে। ব্লেইজ মেট্রেওয়েলির নিয়োগ শুধুই এক 'প্রথম' নয়— এটি একটি নাটক, এক নিখুঁত মঞ্চায়ন। নারীমুখ দিয়ে আধিপত্যের নতুন সংস্করণ তৈরি হচ্ছে। আর আমরা যদি সেই মুখে শুধুই সম্ভাবনার আলো দেখি, তবে অন্ধকার আমাদের অগোচরেই আরও ঘনীভূত হবে। নারীর নাম নিয়ে তৈরি এই নৈঃশব্দ্য সবচেয়ে বিপজ্জনক গোয়েন্দা অস্ত্র।

More Articles