যোগ্য ১৭,২০৬ জন, তাও কেন তালিকা প্রকাশ করছে না এসএসসি? কী যুক্তি শিক্ষামন্ত্রীর?

Bratya Basu on SSC: ব্রাত্য স্পষ্ট জানিয়েছেন, অযোগ্য তালিকার বাইরে ১৭,২০৬ জন রয়েছেন। তাহলে এই ১৭,২০৬ জন কারা সেই তালিকা কেন প্রকাশ করছে না এসএসসি?

কথা ছিল, ২১ এপ্রিল স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য এবং অযোগ্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করবে। এই তালিকা এবং ওএমআর শিট প্রকাশ্যে আনার দাবি তুলেছিলেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তালিকা প্রকাশ সহ একাধিক দাবিতে এসএসসি ভবনের সামনে অবস্থানও করেছেন তাঁরা। অপেক্ষা করেছেন সেই কাঙ্খিত তালিকাটির যা সামনে এলেই জানা যাবে কতজন নিজ মেধায় চাকরি পেয়েছেন কোনও দুর্নীতি না করে, আর কতজন পেয়েছেন শাসকের বদান্যতায়। তবে সন্ধে গড়িয়ে গেলেও সেই তালিকা এসএসসি প্রকাশ করেনি। কেন প্রকাশ করা হলো না সেই নিয়ে কিছু স্পষ্ট জানায়ওনি। তাই রাতভর ওই কার্যালয়ের সামনে অবস্থান চালিয়ে গেছেন শিক্ষকরা। মঙ্গলবারও চলছে অবস্থান-বিক্ষোভ। এসএসসির এমন অবস্থানের পর মঙ্গলবারই বিকাশ ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।

সোমবার গভীর রাতে কমিশন এক বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, “২০১৬ সালে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে যে, এসএসসি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে চলবে এবং বিভাগ কর্তৃক জানানো হচ্ছে, যে শিক্ষকেরা চাকরি করেছেন, তাঁদের বেতন বর্তমান ব্যবস্থা অনুসারে বিতরণ করা হবে।” যোগ্য অযোগ্যের তালিকা নিয়ে কোনও কথাই বলেনি কমিশন। এসএসসি-র বিবৃতির পর ব্রাত্য বসু বলেছিলেন, “যাঁরা বঞ্চিত শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমতো তাঁদের মাইনে পাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাই এই আন্দোলনেরও কোনও মানে নেই। আর যাঁরা ওখানে আছেন (অর্থাৎ যাঁরা এসএসসি ভবনের সামনে আন্দোলন করছেন) , তাঁদের অনেকেই হয়তো অযোগ্য। তাঁদের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কোনও গাইডলাইন না দিলে তো আমরা কিছু বলতে পারি না। আমরা দ্রুত রিভিউ পিটিশনের জন্য যাচ্ছি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টই আমাদের গাইডলাইন দিয়ে দেবেন। আমরা যে ভাবে এগোচ্ছি, তাঁদের আস্থা রাখা উচিত। এ বার আস্থা রাখবেন কি রাখবেন না, সেটা তাঁদের ব্যাপার।’’

কিন্তু মঙ্গলবার ব্রাত্য এমন কিছু তথ্য দিলেন এবং এমন এমন কিছু তথ্য চাপলেন যাতে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির জটিলতা আরও বাড়ল এবং শিক্ষকদের আন্দোলনও খানিক টলমলে হলো বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুন- কী কী দাবিতে রাতভর অবস্থান এসএসসি শিক্ষকদের? সদুত্তর দেবে শিক্ষা দফতর?

বিকাশ ভবনে সাংবাদিক বৈঠকে ব্রাত্য বসু বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া এখনও চালু তথা লাগু আছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমরা দায়বদ্ধ। আমাদের এটিও মনে রাখতে হবে আমাদের সরকার, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সাম্প্রতিক আবেদনে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উপযুক্ত শিক্ষকদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছে।” উল্লেখ্য, মেদিনীপুর থেকে এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খানিক এমনই বার্তা দিয়েছেন। চাকরিহারা শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, “কেন গরমের মধ্যে বসে রয়েছেন? আপনারা স্কুলে যান। যাঁরা আপনাদের উস্কানি দিচ্ছে, তাঁরা টাকা দেবেন না। সরকার আপনাদের বেতন দেবে। আমি কলকাতায় থাকলে এক সেকেন্ডে মিটিয়ে দিতাম। আমি মেদিনীপুরে ছিলাম। রাত পর্যন্ত কথা বলেছি। ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন কিনা সেটা দেখা দরকার। বাকিটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন।”

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেছেন, “আমরা রিভিউ পিটিশন করছি। তাই এমন কোনও কিছু করা উচিত নয় যাতে আপনাদের রিভিউ পিটিশনকে দুর্বল করে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘিত হয় কিংবা আপনাদের বা আমাদের আদালত অবমাননা না হয়, তা আপনাদের বজায় রাখতে অনুরোধ করছি। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে যোগ দিতে অনুরোধ করছি উপযুক্ত শিক্ষকদের। বেতনের বিষয়ে আমাদের দফতর কাজ করে যাচ্ছে। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি। আগামিকালও ডিভিশন বেঞ্চে এসএসসির মামলা রয়েছে। আপনাদের জন্যই এসএএসসি লড়ছে। একমাত্র সরকারই আপনাদের পাশে রয়েছে।”

অর্থাৎ বিষয়টি সম্পূর্ণই সুপ্রিম কোর্টের ঘাড়েই ফেলতে চাইছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে এখানেই শেষ না। তিনি এও বলছেন যোগ্য আসলে কতজন! ব্রাত্য স্পষ্ট জানিয়েছেন, অযোগ্য তালিকার বাইরে ১৭,২০৬ জন রয়েছেন। তাহলে এই ১৭,২০৬ জন কারা সেই তালিকা কেন প্রকাশ করছে না এসএসসি! কেন প্রায় ৮ হাজার অযোগ্যের জন্য ভুক্তভোগী হচ্ছেন যোগ্য, মেধাবী শিক্ষকরা? ব্রাত্য বলছেন, “আমাদের কাছে ভাগ রয়েছে। সেই অনুসারে আমরা কাজ করছি। এমন কোনও কাজ করবেন না, বা এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না, যাতে রিভিউ পিটিশনে আপনাদের বিপক্ষে চলে যায়।” বিশ্লেষকদের একাংশের মত, এই মন্তব্যে আসলে আন্দোলনকারীদের পিছু হটার প্রচ্ছন্ন হুমকিই দিয়েছেন ব্রাত্য। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ চালিয়ে গেলে তা আইনের ভাষা ব্যবহার করে, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ।

চাকরিহারা শিক্ষকরা বারেবারে এই তালিকা চেয়েছেন। তাঁরা এও দাবি তুলেছিলেন যে, যদি একান্তই যোগ্যদের বাছা না যায়, তাহলে অন্তত অযোগ্যদেরই বাছাই করা হোক। অন্তত ‘অযোগ্য’-দের তালিকা প্রকাশ করে অবিলম্বে কমিশন চাকরি থেকে বহিষ্কার করুক তাঁদের। কিন্তু ব্রাত্য বসু জানালেন, যোগ্য কতজন। তাহলে তালিকা তো আছেই। কেন অযোগ্যদের সেই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে পরিচ্ছন্ন তালিকা সামনে আনা হচ্ছে না? ব্রাত্য বসুর দাবি, আইনি পরামর্শ না-পাওয়ার কারণেই তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। ব্রাত্য বসু বলছেন, “তালিকা তো সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে দিয়েছে। আমাদের তো চিহ্নিত করার কিছু নেই। সুপ্রিম কোর্টই জানিয়েছে। সেটি প্রকাশ্যেই রয়েছে।” আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অভিযোগ ছিল, তৃতীয় দফার কাউন্সেলিংয়ের পর বাকি দফার কাউন্সেলিংগুলি নিয়ে কোনও মন্তব্য করছে না কমিশন। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, “এগুলির কথা আমরা বলিনি। এসএসসি চেয়ারম্যানও এটি বলেননি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেও এটি উল্লেখ নেই। যা লেখা নেই, তা কাল্পনিক ভাবে ধরে নিয়ে কেন ওঁরা কথা বলছেন, তা আমি জানি না।”

উল্লেখ্য, কমিশন যে ২১ এপ্রিল তালিকা প্রকাশ করবে এই আশ্বাস গত ১১ এপ্রিল বিকাশ ভবনে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে এক বৈঠকেই পান শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরা। ব্রাত্য বসু নিজেই বলেছিলেন, আইনি পরামর্শ নিয়ে ওই দিনের মধ্যে যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করার চেষ্টা করবে এসএসসি। এখন ব্রাত্য নিজেই যোগ্যদের সংখ্যা বলে দিচ্ছেন, আবার একইসঙ্গে বলছেন, এই আন্দোলনের কোনও অর্থই নেই। চাকরিহারা শিক্ষকরা কী করবেন এবার? সুপ্রিম কোর্টের ভরসায় থাকবেন? আন্দোলন গুটিয়ে নেবেন ভয়ে? শিক্ষকরা অনড়। সমস্ত চাপের মুখে, প্রতিশ্রুতিভঙ্গের মুখে এখনও তাঁরা বলে চলেছেন, হয় তালিকা প্রকাশ করতে হবে, না হয় আন্দোলন জারি থাকবে। 

More Articles