মানুষ কি চুম্বক হয়ে উঠতে পারে?
Biomagnetism: আমাদের হৃদযন্ত্র, মাথা যে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে, তো লোহা বা কোনও চৌম্বক পদার্থকে তো কখনও আকর্ষণ করে না, কেন?
এই যে আমরা ছুটির দিন অলস মস্তিষ্কে ড্রয়িং রুমে বসে অখণ্ড অবসর কাটাই, তখন আমাদের শরীর যতই আরামে থাকুক না কেন, তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্রিয়াকলাপ চলতেই থাকে। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন, বেশিরভাগ মানবকোষ বিশ্রাম নেওয়ার সময় ১০০ ওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে! আমরা জানি, গতিশীল তড়িৎআধান চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। মানবদেহে, বিভিন্ন কোষের মধ্যে সংযোগকারী চ্যানেল এবং পাম্পগুলি তড়িৎগ্রস্থ পরমাণুগুলিকে অর্থাৎ আয়নগুলিকে চারপাশে ঠেলে সরিয়ে দেয়, ফলে চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘Bio magnetism’ বা ‘জৈব চৌম্বকতত্ত্ব’।
১৯৬৩ সালে জি. বাউলে এবং আর. ম্যাকফি নামে দুই বিজ্ঞানী সর্ব প্রথম জৈব চৌম্বকত্বের সন্ধান পান। তাঁরা ইন্ডাকশন কয়েল ব্যবহার করে মানুষের হৃৎপিণ্ডের চারপাশে বিরাজমান চৌম্বকক্ষেত্র শনাক্ত করছিলেন। সেই সময় সন্ধান মেলে জৈব চৌম্বকতত্ত্বের। তারপর থেকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রতিটি হৃদস্পন্দনেই তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের উৎপত্তি হয় এবং মানবশরীর থেকে প্রায় ০.৯ মিটার দূরে হৃদস্পন্দনের ফলে সৃষ্ট চৌম্বকক্ষেত্র শনাক্ত করা সম্ভব; এককথায় হৃৎপিণ্ড মানবশরীরের চৌম্বকক্ষেত্র তৈরির অন্যতম একটি উৎস।
কেবল হৃৎপিণ্ড নয়, আমাদের মস্তিষ্কও চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যার পারিভাষিক নাম ‘নিউরোম্যাগনেটিক ক্ষেত্র’। দরকার পড়লে ডাক্তাররা এটি পরিমাপ করে থাকেন — যেটি ‘ম্যাগনেটোএনসেফালোগ্রাফি’ (MEG) নামে পরিচিত। এটি একটি নন-ইনভেসিভ ইমেজিং কৌশল যা মস্তিষ্কের নিউরন দ্বারা উৎপাদিত চৌম্বক ক্ষেত্র পরিমাপ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি সরাসরি মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরিমাপ করে। মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ কখন এবং কোথায় ঘটে সে সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য প্রদান করে এই MEG। সেইজন্য মৃগীরোগ এবং খিঁচুনির কারণ নির্ধারণের জন্য এটি বিশেষভাবে কার্যকরী। এছাড়া চিকিৎসকরা মস্তিষ্কের টিউমার অথবা নিউরোসার্জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারের আগে রোগীদের মস্তিষ্কের ম্যাপিংয়ের জন্য MEG ব্যবহার করেন।
আরও পড়ুন-এলইডি-তে বহুল ব্যবহার, যে প্রযুক্তির আবিষ্কার বিজ্ঞানী-ত্রয়কে এনে দিল রসায়নে নোবেল
MEG মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহের ফলে উৎপন্ন ক্ষুদ্র চৌম্বকক্ষেত্রকে শনাক্ত করে। এই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি পরিমাপ করতে ব্যবহার করা হয় ‘সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম ইন্টারফেরেন্স ডিভাইস’ বা SQUIDs নামের অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র, যা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের চেয়ে কোটি কোটি গুণ ছোট চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন পর্যন্ত শনাক্ত করতে সক্ষম। এতে যেহেতু বিকিরণ জনিত সমস্যা নেই, তাই এটি বিভিন্ন ক্লিনিকাল এবং গবেষণার ক্ষেত্রে নিরাপদে ব্যবহার করা হয়।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে মনে যে, আমাদের হৃদযন্ত্র, মাথা যে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে, তো লোহা বা কোনও চৌম্বক পদার্থকে তো কখনও আকর্ষণ করে না, কেন? আসলে ধাতব পদার্থকে কাছে টানতে গেলে যে তীব্রতার চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রয়োজন পড়ে, সেই তুলনায় আমাদেরটা অনেক কম। হৃৎপিণ্ডের চৌম্বক ক্ষেত্রের মান ৫০ থেকে ১০০ পিকোটেসলা পর্যন্ত হয়। একটি ম্যাগনেটিক রেসোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) মেশিন এক পিকোটেসলার শক্তির এক মিলিয়নেরও কম মাত্রার চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। যদিও বিশ্বজুড়ে এমন অনেক মানব চুম্বক রয়েছেন, যাঁরা দাবি করেন যে তাঁদের ত্বক ধাতু আঁকড়ে রাখতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এটি কেবল চর্বিযুক্ত স্তরের একটি উদাহরণ যা ত্বককে ঢেকে দেয় এবং চামচ ও কাঁটার মতো জিনিসগুলিকে আঁকড়ে রাখতে সহায়তা করে মাত্র।
আরও পড়ুন-আপনার শরীরের প্রেমে পড়তে পারে মশারাও! ‘মশক চুম্বকে’র গবেষণায় মিলল অবিশ্বাস্য তথ্য
শুধু মানুষ বা প্রাণীরাই নয়, উদ্ভিদরা চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারে কিনা, ২০২১ সালে সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন একদল গবেষক। তাঁরা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ নামক একটি উদ্ভিদ নিয়ে কাজ করেন, যেটি শিকার ধরতে বৈদ্যুতিক সংকেত বা electric signal ব্যবহার করে। জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত জাতীয় মেট্রোলজি ইনস্টিটিউটে পরীক্ষার সময় একটি চৌম্বকীয়ভাবে সুরক্ষিত ঘরে তাঁরা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ স্থাপন করেন। এর ফলে বাইরের কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র বা তড়িৎ ক্ষেত্রের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে কেবল উদ্ভিদের দ্বারা উৎপন্ন চৌম্বক ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের চেষ্টা করেন। শিকার ধরার মুহূর্তে চৌম্বক ক্ষেত্রের সম্ভাব্য মান পরিমাপের জন্য তাঁরা অ্যাটমিক ম্যাগনেটোমিটার ব্যবহার করেন।তাঁরা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপের ট্রাপ বা ফাঁদের পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ মিলিমিটার দূরে প্রায় ০.৫ পিকোটেসলা মান বিশিষ্ট চৌম্বকক্ষেত্রের অস্তিত্ব খুঁজে পান।
চৌম্বকীয় ক্ষেত্র শনাক্ত করতে সক্ষম এমন প্রাণীও অনেক আছে। এই বিশেষ ক্ষমতার নাম ম্যাগনেটো বিসেপশন। এই ক্ষমতার ডানায় ভর করে পরিযায়ী পাখিরা তাদের রাস্তা খোঁজে।
ছোটবেলায় পড়া যে, পৃথিবী একটি বিশাল চুম্বক। দণ্ড চুম্বক বা চুম্বক শলাকার মতো এটির ও উত্তর ও দক্ষিণ মেরু থাকে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে কেবল আমাদের পৃথিবী একা নয়, বিভিন্ন উদ্ভিদ, প্রাণী, এমনকী আমরা নিজেরাও বিভিন্ন মাত্রার চুম্বকক্ষেত্রের উৎস।