Long COVID: ক্লান্তি পিছু ছাড়ে না, তাড়া করছে লং কোভিড?
Long COVID: পাশাপাশি অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রায় তারতম্য দেখা দিচ্ছে । দেখা যাচ্ছে যে, কর্টিসল, টেস্টোস্টেরন তাদের স্বাভাবিক মাত্রার থেকে কমে গেছে।
বর্তমানে দশ জনের মধ্যে অন্তত একজন লং কোভিডের শিকার হচ্ছেন। নোভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দীর্ঘদিন পরেও শরীরে নানানরকম অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে। সংক্রমিত হওয়ার বছর চারেক পরেও থেকে যাচ্ছে নানান উপসর্গ। তবে লং কোভিডের উপসর্গ কিন্তু এখনও খুব সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ লং কোভিডের সঙ্গে অন্যান্য অনেক অসুখের নানাবিধ উপসর্গের মিল রয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির রোগপ্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ড: আকিকো ইওয়াসাকির মতে, অনেকে বুঝতেই পারেন না যে তাঁরা লং কোভিডের শিকার। সব থেকে সমস্যাজনক বিষয়টি হল, ভুক্তভোগীদের রক্ত পরীক্ষা এবং অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষার ফলাফলেও চট করে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে, রোগকে শণাক্ত করাই একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতবর্ষে বহু মানুষ লং কোভিডে ভুগলেও, এ-দেশে বেশিরভাগ ডাক্তারই রোগীর উপসর্গগুলিকে লং কোভিডের আওতায় ফেলতে নারাজ। ডাক্তারদের অনেকেই আবার ভুক্তভোগীদের মনোবিদের সাহায্য নেওয়ার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। কারণ তাঁদের মতে, সমস্যা রোগীদের শরীরে নয়। সমস্যা, রোগীদের মনে। (তথ্যসূত্র: 'দ্য ওয়্যার')
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিসের ক্রিটিকাল কেয়ার এবং উদীয়মান সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড: ক্রিস্টিয়ান স্যান্ডরক কিন্তু বলছেন অন্য কথা। তাঁর মতে, “লং কোভিডের লক্ষণগুলিকে এখনও স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও, এটি আসলে একটি গুরুতর রোগ।" এবং বিশেষজ্ঞরা এ-সম্পর্কে রোজই যেন নতুন কিছু শিখছেন!
লং কোভিডের লক্ষণ কী কী?
”লং কোভিড আসলে ‘আম্ব্রেলা টার্ম’। অর্থাৎ যেখানে এই রোগের সামগ্রিক উপসর্গকে একই ছাতার তলায় এনে, বোঝার চেষ্টা চলছে এই রোগ কীভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সিস্টেমকে প্রভাবিত করে,” জানিয়েছেন ইওয়াসাকি। স্যান্ডরকের মতে, লং কোভিডে সচরাচর যে উপসর্গগুলি দেখা যায়, তার মধ্যে শারীরিক দুর্বলতা, ব্রেন ফগ, আলস্য, ঘুমের সমস্যা, হরমোনাল তারতম্য অন্যতম। 'দ্য ওয়্যার'-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে এরকম একাধিক মানুষের কথা। লং কোভিডের সঙ্গে তাঁরা যেভাবে যুঝছেন, সেখানে ক্লান্তির মতো আপাত সাধারণ বিষয় বদলে দিয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক রসায়ন। বদল এসেছে কর্মজীবনেও। সেরকমই একজন হলেন আগ্রার সীমা নামের এক যুবতী। বয়স কুড়ির কোঠায়। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আগে তাঁর জীবন ছিল অন্যরকম। পাহাড় চড়ার নেশার পাশাপাশি, যোগব্যায়ামেও উৎসাহী ছিলেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার এতগুলো বছর পরেও স্রেফ একটানা ক্লান্তির কারণে স্নান করার মতো একটা সাধারণ দৈনন্দিন কাজ সারতেও তাঁর সমস্যা হয়। সীমা এখন স্নান করেন চেয়ারে বা টুলে বসে। ক্লান্তির কারণে, একেকদিন স্নান করাই বন্ধ করে দেন তিনি। এমনকী এয়ারপোর্টে চলাফেরার সময়ে এই বয়সেই তাঁকে হুইলচেয়ারের সাহায্য নিতে হয়।
আরও পড়ুন-
কোভিড টিকা আদৌ নিরাপদ? কী বলছে আইসিএমআর এবং এনসিডিসি?
মীনাক্ষী নামে দিল্লির এক যুবতীরও একই সমস্যা। বয়স কুড়ির কোঠায়। কিন্তু কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার এত বছর পরেও কিছুক্ষণের জন্যে কথা বলতেও তাঁর অসুবিধা হয়। শরীরের সমস্ত জোর যেন ফুরিয়ে আসে। স্যান্ডরকের মতে, এই লক্ষণগুলির পাশাপাশি কিছু-কিছু রোগীর ক্ষেত্রে আবার হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসের সম্মিলিত সমস্যাও দেখা দিচ্ছে, যাকে বলে কার্ডিও-পালমোনারি ইস্যু। বুকের বামদিকে ব্যথা, নিঃশ্বাসে সমস্যা, এবং ঘনঘন হৃদস্পন্দন বা ট্যাকিকার্ডিয়া— এর অন্যতম উপসর্গ। “আবার বেশ কিছু রোগীর মধ্যে গাঁটে ব্যথা এবং গায়ে র্যাশও দেখা দিতে পারে। অনেকক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলি একসঙ্গেই দেখা যায় রোগীদের মধ্যে,” জানাচ্ছেন স্যান্ডরক।
সীমা 'দ্য ওয়্যার'কে যখন লং কোভিড নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন, তিনি জানান একটানা ক্লান্তির পাশাপাশি অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা অ্যারিদমিয়ারও শিকার তিনি। সীমা-র বক্তব্য:
যে মুহূর্তেই আমি উঠে দাঁড়াই আর একটু নড়াচড়া করা শুরু করি, আমার হৃদস্পন্দন ভীষণ বেড়ে যায়। আর রক্তচাপ কমে যায়।
ড: ইওয়াসাকি জানাচ্ছেন, লং কোভিডের কারণে শরীরে থাকা অনেক নিষ্ক্রিয় ভাইরাস, যেমন হার্পিস, এপস্টেইন-বার সক্রিয় হয়ে উঠছে। তাঁর মতে, “আমাদের শরীরে অনেক রকমের ভাইরাস বাসা বাঁধে। তার মানেই এই নয় যে তারা সক্রিয় এবং আমাদের শরীরে রোগ সৃষ্টি করবে। কিন্তু লং কোভিডের কারণে, এরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।" পাশাপাশি অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রায় তারতম্য দেখা দিচ্ছে । দেখা যাচ্ছে যে, কর্টিসল, টেস্টোস্টেরন তাদের স্বাভাবিক মাত্রার থেকে কমে গেছে। “লং কোভিডে ভোগা এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কাঁপুনি এবং ইন্টারনাল ভাইব্রেশনের শিকার হচ্ছেন,” একটি সাক্ষাৎকারে এ-কথা জানিয়েছেন ইওয়াসাকি। অথচ এরকম ক্ষেত্রেও বাইরে থেকে কিচ্ছুটি বোঝা যায় না।
কেন দেখা যায় লং কোভিড
ড: ইওয়াসাকির মতে, লং কোভিডের মূল কারণ হল, কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কলা-কোষের নোভেল করোনা ভাইরাসের ভান্ডারে পরিণত হওয়া। সেক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস শরীরে থাকে না ঠিকই। কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পর, তার সামান্য অংশও যদি শরীরে থেকে যায়, তাহলে ক্রমাগত সেগুলি নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে শুরু করে ও কোষের মধ্যে জমা হয়। সাধারণত ভাইরাসের জেনেটিক পদার্থ, নোভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে যা হল আরএনএ এবং এই ভাইরাসের একদম বাইরের আবরণে থাকা স্পাইক প্রোটিনই ভাইরাসের অবশিষ্টাংশ হিসেবে আমাদের শরীরে থেকে যায়।
ড: ইওয়াসাকি জানাচ্ছেন, রক্ত পরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়লেও, লং কোভিডে ভোগা রোগীর বায়োপসি বা অটোপসি পরীক্ষার ফলাফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নোভেল করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন তাঁরা। কিন্তু ভাইরাসের অবশিষ্টাংশ রয়ে গেলে সমস্যা কোথায়, তা বোঝার জন্য জানতে হবে আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা কী ভাবে কাজ করে। আমাদের শরীরে, শরীরবহিঃর্ভূত কোনো পদার্থ বা ফরেন মেটেরিয়াল ঢুকলে, তাদের প্রতিহত করতে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে থাকে। ভাইরাসের প্রোটিন কিংবা তার জেনেটিক পদার্থ আমাদের শরীরের কাছে ফরেন মেটেরিয়াল। এরা অবাঞ্ছিত তো বটেই। কিন্তু তারা মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ-কলায় জমা হওয়ার ফলে সেখানকার রোগপ্রতিরোধী কোষ, প্রোটিন এবং অন্যান্য পদার্থ সারাক্ষণই সক্রিয় থাকে। শত্রুকে দমন করতে তারা সংখ্যা ও পরিমাণে বাড়তেও থাকে। ফলে দেখা যায় ইনফ্ল্যামেশন।
আরও পড়ুন- কমিয়ে দেখানো হয়েছে সংখ্যা? সরকারি নথিতেই উঠে আসছে কোভিডে মৃত্যুর গরমিল তত্ত্ব
এই ইনফ্ল্যামেশন বিষয়টা একদম শাঁখের করাতের মতো। হলেও সমস্যা, না হলেও সমস্যা। ইনফ্ল্যামেশন না হলে রোগ প্রতিরোধ সম্ভব না। সম্ভব না, ভাইরাসকে ঘায়েল করা। আবার ইনফ্ল্যামেশন হলেও শরীরে নানানরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যখন কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার আক্রমণে আমাদের জ্বর হয়, গা ব্যথা করে, কখনও-বা র্যাশ বেরোয়, তা কিন্তু আসলে ইনফ্ল্যামেশনের ফল। ভেবে দেখুন, তাতেই আমরা কীভাবে কাবু হয়ে যাই। কিন্তু আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সেই ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়াকে ঘায়েল করতে গিয়ে, আমাদের নিজেদের শরীরের কলা-কোষ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও আক্রমণ করা শুরু করে। একে বলে অটোইমিউনিটি। বিষয়টি আসলে, বাড়িতে ঢুকে-আসা শত্রুকে আক্রমণ করতে গিয়ে, নিজের বাড়ির জিনিসপত্র ভেঙে ফেলার মতন।
অটো-ইমিউনিটি থেকে হওয়া ইনফ্ল্যামেশন আমাদের হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, যকৃৎ-সহ, নানানরকম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। ক্ষতি করে নার্ভকোষের। এমনকী শিরা-ধমনীর ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধিয়ে, স্বাভাবিক রক্ত পরিবহনেও বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। স্যান্ডরকের মতে, “এখন যথাযথ চিকিৎসার জন্যে সঠিক ডাক্তারি পদক্ষেপের পাশাপাশি, গভীর গবেষণা জরুরি। জরুরি, লং কোভিডে ভোগা রোগীদের সংগঠন বা কমিউনিটি গড়ে তুলে, প্রয়োজনে একে-অপরের পাশে দাঁড়ানো।" ইওয়াসাকির বক্তব্য, "এই মুহূর্তে লং কোভিডের মোকাবিলা করতে সবার আগে প্রয়োজন রোগ শনাক্তকরণের উপযুক্ত পদ্ধতি এবং পরিকাঠামো।" লং কোভিডের ফলে শরীরে যে জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন আসে, তা শণাক্ত করার জন্যে উপযুক্ত জৈব-চিহ্নিতকারী পদার্থ বা বায়োমার্কার তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।