খাগড়াগড় থেকে পহেলগাঁও, কীভাবে কাজ করে জঙ্গিদের প্রতিশোধমূলক প্রক্সি প্যাটার্ন?
Pahalgam Situation: এই পুরো হামলার সঙ্গে কোথাও না কোথাও অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা, জড়িয়ে আছে এক কুখ্যাত জঙ্গির প্রত্যর্পণ।
কাশ্মীরের পহেলগাঁও উপত্যকা জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। পর্যটনে পরিপূর্ণ কাশ্মীরের এই উপত্যকা এখন এক বধ্যভূমি। পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন দ্যা রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন হিন্দু পর্যটক। তাদের সাথেই প্রাণ হারিয়েছেন এক কাশ্মীরি পর্যটন ব্যবসায়ীও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সেনাকে আদেশ দিয়েছেন জঙ্গিদের খুঁজে বের করার। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ওয়াকফ বিলের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা বিক্ষোভের দিকেই নিশানা করেছেন। সেখানেই আবার কংগ্রেস নেতা রবার্ট বঢরা জঙ্গি হামলাকে এক প্রকার বিজ্ঞপিত করে এবং খোয়াজা আসিফের কথার সঙ্গে অনেকটাই সহমত পোষণ করে বলছেন, এই হামলা হয়েছে কারণ ভারতে নাকি মুসলিমদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয় না। সেনা রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই খতম হয়েছে দুই জঙ্গিও। কিন্তু, এই ঘটনা যে শুধুমাত্র একটা অতর্কিত জঙ্গি হামলা সেটা কিন্তু সরাসরি বলা যায় না। বরং এর পিছনে রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিশোধ স্পৃহা। এই পুরো হামলার সঙ্গে কোথাও না কোথাও অবশ্যই জড়িয়ে রয়েছে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা, জড়িয়ে আছে এক কুখ্যাত জঙ্গির প্রত্যর্পণ, সঙ্গেই রয়েছে একটা 'প্রক্সি প্যাটার্ন' যা এর আগেও ব্যবহার করেছিল আমাদের আরেক প্রতিবেশী দেশের একটি জঙ্গি সংগঠন।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর, ভারতের ইতিহাসের কালো দিন। সেদিন আজমল কাসাভ-সহ অন্যান্য লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৬৬ জন সাধারণ ভারতীয়। সেই হামলার মাস্টারমাইন্ড তাহাউর হুসেন রানাকে সম্প্রতি ভারতে নিয়ে এসেছে মোদি সরকার। হাই প্রোফাইল এই জঙ্গি ছিল লস্কর-ই-তৈবার প্রধান সদস্যদের মধ্যে অন্যতম। বলতে গেলে তার নির্দেশেই পুরো মুম্বাই হামলার নীল নকশা তৈরি করেছিল লস্কর-ই-তৈবা ও ডেভিড কোলম্যান হেডলি। তাই রানার প্রত্যর্পণ লস্করের কাছে কার্যত একটা বিরাট বড় ধাক্কা।
আর এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই কাশ্মীরে হামলা। ঘটালোপাকিস্তানের জঙ্গি জগতের নতুন সংযোজন লস্কর-ই-তৈবার ছায়া সংগঠন দ্যা রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট। তবে, ভারতে এই প্যাটার্ন জঙ্গিদের একেবারে নতুন নয়। এর আগেও একবার এই প্রকৃতির হামলার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। আর সেবারে টার্গেট কাশ্মীরের পর্যটকরা নয়, ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর, সারা ভারত যখন গান্ধী জয়ন্তীর ছুটিতে মশগুল, ঠিক তখনই বর্ধমানের একটা ছোট্ট গ্রাম খাগড়াগড়, হঠাৎ উঠে এলো সংবাদ শিরোনামে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কীর্নাহারের মিরাটি গ্রামের বাড়ির থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খাগড়াগড় গ্রামে ঘটে গিয়েছে একটা বিরাট বিস্ফোরণ। কোনো কারণে হয়তো ভুলবশত সেই বোমা ফেটে গিয়েছিল খাগড়াগড়ে। তবে যদি এই ঘটনা না ঘটত তাহলে হয়তো গ্রামের বাড়ির পুজোতেই বোমার আঘাতে মৃত্যু হতে পারত প্রণব মুখোপাধ্যায় ও তাঁর দিদির।
আরও পড়ুন-পহেলগাঁও হামলা: কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে কীভাবে সক্রিয় কোন কোন জঙ্গি গোষ্ঠী?
কিন্তু হঠাৎ খাগড়াগড় বিস্ফোরণে প্রণব কেনো টার্গেট হয়ে উঠলেন? আর কিভাবে পহেলগাঁও আর খাগড়াগড় একসাথে এক প্যাটার্নে মিলে যায়? তা জানার জন্য আরো কিছু বছর পিছনে যেতে হবে। ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নিয়েছিলেন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত। ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার একমাত্র জীবিত জঙ্গি আজমল কাসাভের ফাঁসির শাস্তি মুকুবের আর্জি খারিজ করেছিলেন প্রণব। আর সেই বছরেরই ২১ নভেম্বর ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয় কাসাভকে। এরপর ২০১৩ সালে ৩ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট হামলার মূল চক্রী আফজল গুরু এবং ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল ১৯৯৩ সালের বোম্বে হামলায় ধৃত ইয়াকুব আব্দুল রাজ্জাক মেমনের ফাঁসির শাস্তি মুকুবের আর্জিও খারিজ করেন প্রণব।
একের পর এক জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হলে গোটা দেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লেও, আমাদের পূর্বের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নিঃশব্দে জেগে উঠেছিল প্রতিশোধের শপথ। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা দাবি করেছিলেন, খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের ঘটনা শুধুই একটা বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণের ঘটনা, এর সঙ্গে কোনো জঙ্গি সংগঠনের যোগ নেই। তবে, সেই বিস্ফোরণ কেবল একটি দুর্ঘটনা ছিল না—NIA তদন্তে উঠে আসে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, মাদ্রাসা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ শিবির, সীমান্ত পেরিয়ে আসা বাংলাদেশি জঙ্গি এবং বাংলার মাটিকে জেহাদির ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের ছক। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল ভারতের ভূখণ্ডে JMB’র একটা 'মেসেজ'।
প্রথম ধাক্কা, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় গ্রামের একটি বাড়িতে ঘটে একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ। মুহূর্তের মধ্যেই সারা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল একটা ভয়। বাড়ির মালিক হাসান চৌধুরী বেরিয়ে এসে দেখলেন বাড়ির দোতলা থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ওই বাড়িটি ভাড়া দিয়ে বেশ ভালই আয় হতো হাসান চৌধুরীর। এই সবথেকে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, তিনি কোনো কাগজ ছাড়াই সবাইকে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিতেন। এরকমই একদিন নদীয়ার বাসিন্দা শাকিল মণ্ডলকে এই বাড়ির দোতলা ভাড়া দিয়েছিলেন হাসান চৌধুরী। প্রাথমিকভাবে সবাই মনে করেছিলেন এটা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা। কিন্তু সন্দেহ তখন শুরু হয় যখন দেখা যায় বাড়ির দুই মহিলা পুলিশকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সন্দেহ গাঢ় হতেই বিরাট পুলিশ বাহিনী উপস্থিত হয় ঘটনাস্থলে।
বলপূর্বক বাড়িতে প্রবেশ করেই চোখ কপালে ওঠে পুলিশের। বাড়ির ভেতরে ভয়ংকর পরিস্থিতি। মাটিতে পড়ে রয়েছেন তিনজন ব্যক্তি। শাকিল আহমেদ ওরফে গাজী, শোভন মন্ডল এবং আব্দুল হাকিম। শাকিল আহমেদ এবং শোভন মন্ডল ঘটনাস্থলেই নিহত এবং আব্দুল হাকিম গুরুতর আহত। তবে এখানেই শেষ নয়। বাড়িতে রয়েছে আরো অনেক জিনিস, রয়েছে কিছু প্রচারপত্র, কিছু জিহাদী প্যাম্পলেট, জিহাদের ডিভিডি, বিস্ফোরক তৈরীর হ্যান্ডবুক এবং তার সাথেই প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম।
এর মধ্যেই একটি বিশেষ প্রচারপত্র নজর কাড়ে গোয়েন্দাদের। সেই প্রচারপত্রের প্রেরক ছিলেন কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার অন্যতম প্রধান, মিশরের ডাক্তার আয়মান আল জাওয়াহিরি। এই প্রচারপত্রে লেখা ছিল ‘মুজাহিদিন ভাইদের প্রতি আহ্বান’। এর সাথেই ছিল চেচনিয়া বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থনের বার্তাও। পরে এই জায়গা থেকে আরো একটি ডিভিডি উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা যেখানে বক্তা সরাসরি আল কায়েদা ও চেচেন যোদ্ধাদের সাথে থাকার এবং তাদের জঙ্গি কার্যকলাপে সমর্থন করার কথা বলছেন। আর এখান থেকেই বোঝা যায়, এই ঘটনা স্রেফ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এই পুরো ঘটনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছে জঙ্গি-যোগ। প্রত্যক্ষ যোগসাজশ রয়েছে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ ওরফে জেএমবির এবং এই বাড়িটিই ছিল জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশের পশ্চিমবঙ্গের একটি সক্রিয় সেল। সঙ্গেই, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের কয়েক দিনের মধ্যেই ওই পুরো এলাকা থেকে অনেক ভাড়াটে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যান। পুলিশ বোঝে, এই এলাকা পুরোটাই হয়ে গিয়েছিল জঙ্গিদের একটা ঘাঁটি।
জামাত উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (JMB) কী?
১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে আব্দুর রহমান নামের একজন কট্টর ইসলামপন্থী JMB নামের একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেন। প্রথমদিকে খুব একটা প্রচারের আলোয় না থাকলেও, ২০০৫ সালে একদিনে সারা বাংলাদেশে ৩০০ টি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হঠাৎ করে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে যায় এই জেএমবি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশকে শরিয়াহ্-ভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
তবে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা সরকার এই জেএমবিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ জুড়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সার্চ অপারেশন শুরু হয়। ততক্ষণে ২০১১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নির্বাচনে তৃণমূলের অন্যতম একটা ভোট ব্যাংক ছিল মুসলিম ভোট। পাশাপাশি, স্থানীয় মুসলিম নেতারাও তখন তৃণমূলের পক্ষেই রয়েছেন। তাই, আফগান তালিবানদের আদর্শে অনুপ্রাণিত এই সংগঠনটি পশ্চিমবঙ্গকেই তাদের ঘাঁটি গড়ার উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে বিবেচনা করে। আর খাগড়াগড়ের ওই বাড়িটি ছিল তাদের একটি অ্যাক্টিভ অপারেটিং সেল।
মাদ্রাসা, মডিউল, সীমান্ত: ছড়িয়ে পড়ার ছক
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে খাগড়াগড়ের আকস্মিক বিস্ফোরণ উন্মোচন করে দিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর ছায়াজগতের দরজা—যেখানে 'মাদ্রাসা' ছিল প্রশিক্ষণ শিবির, ‘ধর্মীয় শিক্ষা’ ছিল সন্ত্রাসের ছদ্মবেশ, আর 'স্বশিক্ষিত জেহাদি'রা ছিল আত্মবিসর্জনের প্রস্তুতিপ্রাপ্ত রণযোদ্ধা। ২০০২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই ধরনের বেশ কিছু মাদ্রাসা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, এই ধরনের মাদ্রাসাতে বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্য শিক্ষার থেকে বেশি কট্টরপন্থী ইসলামিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সেই সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং পরে তিনি নিজের কথার ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে বলে সরে আসেন। তবে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে বোঝা যায় তিনি ঠিকই বলেছিলেন সেই সময়।
এনআইএর তদন্তে জানা যায়, খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পেছনে একটি সুসংগঠিত জেএমবি নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অন্তত ১০০ জন পূর্ণকালীন ক্যাডার গঠন, যাদের দিয়ে শিবির, অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং জেহাদি প্রোপাগান্ডার বিস্তার ঘটানো যাবে। মূলত মালদহ, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার সাতটি মাদ্রাসা ছিল এই কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র। ২০১৩ সালে জুলাই ও আগষ্ট মাসে এই মাদ্রাসাগুলিতে এসেছিলেন জেএমবির শীর্ষস্থানীয় সদস্যরা এবং সেখানেই মাদ্রাসার ছাত্রদেরকেও এই কাজে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিলেন তারা। বাংলাদেশের নবাবগঞ্জের দারুল উলুম মাজহারুল মাদ্রাসায় তৈরি একটি প্ল্যানের ব্লু প্রিন্ট পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই হয়েছিল এই অভিযান।
এই সাতটি মাদ্রাসা হলো, বেহাদাহ আহলে হাদীস শিশু মাদ্রাসা, বেহাদাহ, মুর্শিদাবাদ; মাহাদুল তাওহীদ মতিনুঞ্জ মাদ্রাসা, রতুয়া, মালদহ; আল জামেয়াতুস সালাফিয়া দারুল কোরআন মাদ্রাসা, কাবিলপুর, মুর্শিদাবাদ; দেঙ্গেল মাদ্রাসা, নাটিদা; জামিয়া ইসলামি মাদ্রাসা, মায়াপুর, নদিয়া; ভাদো জামিয়া ইসলাজুল মুসেমিন মাদ্রাসা, রতুয়া, মালদহ, এবং শিমুলিয়া মাদ্রাসা, বর্ধমান। তদন্তে আরো জানা যায়, সেই সময় সারা বাংলাজুড়ে এই জেএমবি জঙ্গি সংগঠনের ৫৮টি মডিউল কার্যকরী ছিল।
বিস্ফোরণে নিহত জেএমবি জঙ্গি শাকিল আহমেদ ও বর্তমান সাজাপ্রাপ্ত কৌশার ভারতজুড়ে এক ছড়িয়ে থাকা সন্ত্রাসী জাল বিস্তার করেছিলেন, যাদের কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল বর্ধমানের সিমুলিয়া মাদ্রাসা। এখানেই তৈরি করা হতো নতুন জেহাদি ‘মডিউল’, প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বিস্ফোরক তৈরির, অস্ত্র ব্যবহারের, এবং তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ কৌশলে। তদন্তে উঠে আসে, এদের লক্ষ্য ছিল চেন্নাই রেলস্টেশন, পাটনার গান্ধী ময়দান—যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদির নির্বাচনী সভা ছিল নির্দিষ্ট টার্গেট।
আরও পড়ুন-কেউ মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে, কেউ পর্যটকদের বাঁচাতে গিয়ে নিহত! পহেলগাঁও প্রাণ কাড়ল যাদের
সিমুলিয়া মাদ্রাসা: প্রশিক্ষণ শিবিরের মুখোশ
নাম ‘মাদ্রাসা’ হলেও, সিমুলিয়া ছিল আদতে এক সন্ত্রাস প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা যখন এই মাদ্রাসা অপারেশনে যান, তখন দেখা যায় মাদ্রাসা পুরো ফাঁকা। তদন্তে জানা যায়, শাকিলের নেতৃত্বে এখানে আসত বাংলার বিভিন্ন জেলা ও বাংলাদেশের তরুণরা। তাদের সেখানেই শেখানো হতো কিভাবে রান্নাঘরের জিনিস দিয়ে তৈরি করা যায় আইইডি, কীভাবে ব্যবহার করতে হয় “সিগমা” টাইমার বা গ্যাস সিলিন্ডার বোমা। এমনকি আল-কায়েদার প্রচারপত্র ও ম্যাগাজিনও উদ্ধার হয় তাদের ঘাঁটি থেকে, যেখানে উল্লেখ ছিল—“কীভাবে রান্নাঘরকে বোমা তৈরির ঘরে রূপান্তরিত করা যায়।” তদন্তে জানা যায়, প্রতি ভোরে তিন শিফটে ১৫ জন করে যুবকদের বোমা বানানো, ফিজিকাল ট্রেনিং, এবং অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
ভারতব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নেটওয়ার্ক
এই মাদ্রাসা থেকেই তদন্তকারীরা খুঁজে পান বিস্ফোরক সরবরাহকারীর নাম—কাদের শেখ, সম্পর্কে শাকিলের দুলাভাই বা জামাইবাবু। মাদ্রাসা থেকে সরবরাহ হতো বিস্ফোরক উপাদান, র্যাডিক্যাল আইডিওলজির একাধিক বই, আর তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার লিফলেট। রাজ্যের বিভিন্ন শহর ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড ও চেন্নাই পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই নেটওয়ার্ক। সিমকার্ড কেনা হতো পশ্চিমবঙ্গে, ব্যবহৃত হতো বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায়।
জেএমবি পরিকল্পনা করেছিল, পশ্চিমবঙ্গ হয়ে তারা বিস্ফোরক পাঠাবে বাংলাদেশ সীমান্তে লালগোলা পর্যন্ত। ধৃতদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সকালে ট্রেনে করে বোমা বোঝাই বস্তা নিয়ে তারা বর্ধমান থেকে বেরিয়ে বেলডাঙায় বিশ্রাম নিত। এরপর সেখান থেকে রিকশায় এসে মাদ্রাসার ভেতরে রেখে দিত সেইসব বোমা। এরপরেই ওই বিস্ফোরক হস্তান্তর করা হত জঙ্গিদের হাতে। এনআইএ হায়দরাবাদ থেকে একজন রোহিঙ্গা নাগরিক খালিদ মহম্মদকেও গ্রেফতার করে। এতে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়—পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কে রোহিঙ্গা ও জেএমবির একজোট হওয়ার।
নারী জঙ্গিদের ভূমিকা ও জবানবন্দি
ঘটনাস্থলে পাওয়া যায় দুই নারী—শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও হাকিমের স্ত্রী আলিমা বিবি। NIA তাদেরকে গ্রেফতার করে এবং বারংবার তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শেষ পর্যন্ত বাচ্চার কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজিয়া। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, শিমুলিয়া মহিলা মাদ্রাসার এক মৌলবী তাদের দলে যুক্ত করেন। সেখানেই তাদের মানুষ মারার এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মহিলারাও মাদ্রাসায় ট্রেনিং দিতেন। তারাই বোমা বানানোর রাতের ব্যাচগুলো পরিচালনা করতেন।
আসাম সংযোগ: হুঁশিয়ারি ভবিষ্যতের
খাগড়াগড় কাণ্ডের পরে আসাম পুলিশ গ্রেপ্তার করে ছয় জন জঙ্গিকে, যারা এ নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাদের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে, একাধিক এনজিও ও প্রতিষ্ঠানের নাম—যাদের উপর উপর সামাজিক কাজের মুখোশ থাকলেও, কিন্তু আড়ালে চলত চরমপন্থী প্রশিক্ষণ। আসামের বারপেটা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া সইফুল স্বীকার করে, সে ঝাড়খণ্ড ও বর্ধমানে বিস্ফোরক তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
কীভাবে তৈরি হয়েছিল প্ল্যান?
এই গোটা ঘটনার মাস্টারমাইন্ড ছিল জেএমবি নেতা কওসর ওরফে বোমারু মিজান। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আগে বুদ্ধ গয়ায় দলাই লামাকে হত্যা করার ছক তৈরি করেছিল সে। বাংলাদেশী নাগরিক কওসর জেএমবির সূচনা পর্ব থেকেই ওই সংগঠনের বড় নেতা। তার আসল নাম জইদুল ইসলাম। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে যে বিস্ফোরণ ঘটে, তাতেও জড়িত ছিল সে। সে সময় বাংলাদেশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ জেলে স্থানান্তর করে। তবে একদিন আদালতে নিয়ে যাবার সময় ত্রিশাল এলাকা থেকে পুলিশ ভ্যানের উপর হামলা করে ভারতে পালিয়ে আসে কওসর।
ভারতের সীমানা পেরিয়ে প্রথমে সোজা মুর্শিদাবাদ এবং তারপর বীরভূমে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে জইদুল। বীরভূমে বিবাহ করে সরাসরি বর্ধমানের বাবুরবাগের কাছে থাকতে শুরু করে সে। সেখানেই একটি মাদ্রাসায় পড়াতো কওসর। এলাকায় তার পরিচিতি ছিল মাস্টারমশাই হিসেবে। কিন্তু আদতে সেই মাদ্রাসার পিছনে চলত জঙ্গি প্রশিক্ষণ। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে সংগঠনের শাখা খুলতে শুরু করে কওসর। এরপর একদিন বর্ধমানের ওই মাদ্রাসা থেকে উধাও হয়ে যায় সে। সরাসরি পৌঁছে যায় মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙাতে কওসরের সঙ্গে যোগাযোগ হয় আরো দুই জেএমবি নেতা সোহেল মাহফুজ এবং শাকিল গাজীর। এরপর মালদা মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমানের কিছু জায়গায় নিজেদের জাল বিছিয়ে ফেলে কওসর ও তার সঙ্গীরা। শাখা ছড়ায় ঝাড়খণ্ডেও।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর বর্ধমান থেকে ফেরার হয়ে যায় কওসর। অবশেষে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বেঙ্গালুরু থেকে কওসরকে গ্রেফতার করেন তদন্তকারীরা। সে নিজেই জানায়, বিস্ফোরণের পর শ্রমিক সেজে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে ছিল সে। কখনো কলের মিস্ত্রি, কখনো গাড়ির মিস্ত্রি আবার কখনো ফেরিওয়ালার সাজে তাকে দেখা গেছে। বাঙালি শ্রমিকদের এলাকায় লুকিয়ে থাকার পরিকল্পনা করেছিল সে। কওসর ছিল নতুন জেএমবি অর্থাৎ ইসলামিক স্টেটের মতাদর্শে বিশ্বাসী। ভারতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতেই কিছু সমস্যা রয়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে রোহিঙ্গাদের সমস্যা প্রবল। তাই কওসর তাদেরকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটা অচলাবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিল। এছাড়াও এই মামলায় আরো একজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের নির্দেশ দেয় আদালত এবং তিনি হলেন আবু মুসা। এই আবু মুসা ছিলেন একজন জেএমবি জঙ্গি এবং ট্রান্সন্যাশনাল সালাফী জিহাদী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দা লেভান্টের একজন সক্রিয় সদস্য। জেএমবি-র টার্গেট লিস্টে প্রণব মুখার্জি ছিলেন কিনা সেটা কোনোদিন তারা দুজনে স্বীকার না করলেও, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছিল। তদন্তকারীরা মনে করছেন, যদি সেদিন খাগড়াগড়ে ওই বোমা না ফেটে যেতো তাহলে হয়তো বাংলায় দুর্গাপুজো বা কালীপুজোয় অনেক বড় একটা নাশকতা ঘটে যেতে পারত।
জঙ্গিদের অজানা প্রক্সি প্যাটার্ন
এই ধরনের জঙ্গি হামলা যেন এক অদৃশ্য সময়সূত্র। রাষ্ট্র যখন জঙ্গিবাদ বিরোধী চূড়ান্ত পদক্ষেপে যায়, সেই শাসকের ভূখণ্ডেই ঘটে যায় প্রতিশোধ। রাষ্ট্র যখন কোনও বড় অভিযুক্তকে ফেরত আনে, জঙ্গিদের তরফে আসে ‘রেসপন্স’। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন ফাঁসির শাস্তি মুকুবের আবেদন নাকচ করছেন, তখনই তার বাড়ির ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে ঘটে যাচ্ছে বিস্ফোরণ। প্রধানমন্ত্রী যখনই ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মাস্টারমাইন্ডকে ভারতে আনছেন তখনই কাশ্মীরে চলছে জঙ্গি হামলা। নাম জিজ্ঞেস করে করে হিন্দুদের হত্যা করে ইসলামের শাসন কায়েম করতে চাওয়া জঙ্গিরা বলছেন, "তোমাকে মারলাম না, যাতে এটা তুমি মোদিকে গিয়ে বলো!"
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলি অবশ্য এই ধরনের প্রতিশোধমূলক প্রক্সি প্যাটার্নের সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের এই জঙ্গি সংগঠনগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় তাত্ত্বিকতায় নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশল এবং প্রতীকী আঘাতের উপরেও জোর দিচ্ছে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই—এই প্যাটার্নের শেষ কোথায়? কীভাবে এই জঙ্গি আক্রমণ শেষ করতে পারবে ভারত? এর পিছনে শুধুমাত্র যে প্রতিশোধ রয়েছে সেটাও নয় যদিও। এই জঙ্গি হামলার পিছনে রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ এবং ভারতের মুসলিম তরুণদের মগজে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে দেওয়ার একটা সুচতুর পরিকল্পনা।