পহেলগাঁও হামলা: কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে কীভাবে সক্রিয় কোন কোন জঙ্গি গোষ্ঠী?

Kashmir Terrorist Groups: এখনও পর্যন্ত লস্কর-ই-তৈবার মূল মাথাকে টার্গেট করতে পারেনি ভারতীয় সেনা। হাফিজ সাইদ এখনও ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় একেবারে শীর্ষে।

২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল। পহেলগাঁও, যে উপত্যকার নাম শুনলেই মনে পড়ে হিমালয়ের পাদদেশে শান্তির ছবি, সেই উপত্যকা এক বিকেলে রক্তাক্ত বধ্যভূমি হয়ে গেল। কেউ গিয়েছিলেন ভূস্বর্গকে উপভোগ করতে, কেউ গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমায়। তারই মাঝে সবুজ ঘাস, ঝাউবন এবং বরফের পাহাড় দিয়ে ঘেরা এই উপত্যকা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হয়ে গেল মৃত্যু উপত্যকা। বিগত কয়েক বছর ধরে এরকম জঙ্গিহানা দেখেনি জম্মু-কাশ্মীর। একে-৪৭ এর গর্জনে প্রাণ হারালেন ২৭ জন নিরীহ ভারতীয়। তাও আবার একে একে নাম জিজ্ঞেস করে হত্যা করা হয়েছে সকলকে। সূত্রের খবর, এই জঙ্গি হামলায় প্রায় ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসবাদীর জড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ থেকে ৭ জন পাকিস্তানের এবং বাকিরা ভারতেরই। স্থানীয় যে ক'জন ছিল, তারাও নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ওপার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে বলে মনে করছে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। স্থানীয় যুবকদের সাহায্য নিয়ে হত্যালীলা চালানো হয়েছে বলেই ধারণা ভারতের।

এই নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলার পর কয়েক ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, তবে মনে করা হচ্ছে এখনও আশেপাশের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে জঙ্গিরা। খবর এসেছে, কাশ্মীরের বারামুলায় সেনা এবং জঙ্গিদের মধ্যে গুলির লড়াইয়ে খতম হয়েছে ২ জঙ্গি। বুধবার সকালে ভারতীয় সেনার চিনার কর্পস ব্যাটেলিয়ানের তরফে এক্স হ্যান্ডেলে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম। অন্যদিকে, পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্যা রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট বা TRF। তবে এটা কেবলমাত্র একটা মুখোশ, এই সংগঠনের আসল শক্তি এবং মাথা হলো লস্কর-ই-তইবা (LeT)। এই সংগঠন যেন নতুন বোতলে পুরনো বিষ। কাশ্মীরে সক্রিয় এসব জঙ্গি সংগঠন এবং তাদের ঘোষিত ও গোপন এজেন্ডা আসলে কী?

১. লস্কর-ই-তইবা (LeT) – ভয়াবহতার স্থায়ী প্রতীক

পাকিস্তানের মুরিদকেতে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, এই সংগঠনটি সঙ্ঘবদ্ধভাবে পরিচালিত হয় জামাত-উদ-দাওয়ার অধীনে, যার প্রধান হাফিজ সঈদ। এই জঙ্গি সংগঠনের সব থেকে কুখ্যাত হামলা হলো ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা। এই মুম্বই হামলায় ১৬৬ জনকে হত্যা করেছিল লস্কর-ই-তইবা (LeT)। মুম্বইয়ের লিওপোল্ড ক্যাফে, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাস, তাজমহল প্যালেস হোটেল, ওবেরয় ট্রাইডেন্ট, কামা হসপিটাল, নরিমান হাউজ, মেট্রো সিনেমা এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে হামলা চালিয়েছিল লস্কর-ই-তইবা। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা ছাড়াও, লস্কর কাশ্মীর এবং ভারতের অন্যত্র অসংখ্য গণহত্যা, সেনা ছাউনিতে হামলা ও সাধারণ নাগরিকদের টার্গেট কিলিংয়ের জন্য কুখ্যাত।

এই জঙ্গি সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা। এছাড়াও এই জঙ্গি সংগঠন ভারতের অস্তিত্বকে অস্বীকার এবং ভারতের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে থাকে। যদিও এখনও পর্যন্ত এই সংগঠনের মূল মাথাকে টার্গেট করতে পারেনি ভারতীয় সেনা। হাফিজ সাইদ এখনও ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় একেবারে শীর্ষে।

TRF-র সঙ্গে সম্পর্ক

২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা সরিয়ে ভারতীয় সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা রদ করার পর, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে LeT নতুন নামে এবং ‘স্থানীয় আন্দোলনের মোড়কে’ TRF গঠন করে। TRF মূলত LeT-এর মুখোশ, যার মাধ্যমে তারা স্থানীয় যুবকদের মগজধোলাই করে এবং LeT-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে 'স্বজাতিয় প্রতিরোধ' হিসেবে প্রচার করে।

আরও পড়ুন-কাশ্মীরে নিরস্ত্র পর্যটকদের উপর মর্মান্তিক হামলার নেপথ্যে TRF! কারা এই গোষ্ঠী?

২. দ্য রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট (TRF)

এই সংগঠনটির উত্থান ২০১৯ সালে। তখন সবে সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ হয়েছে এবং কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা অবলুপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির মাঝেই লস্করের ছায়া সংগঠন হিসেবে উঠে আসে টিআরএফ। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, কাশ্মীরের বিভিন্ন হামলা ঘটানো এবং ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। পরিযায়ী শ্রমিক এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিশেষভাবে নিশানা করে এই জঙ্গি সংগঠন।

প্রথমদিকে এই জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি শুধুমাত্র অনলাইনে থাকলেও, ধীরে ধীরে এরা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বাস্তবে ময়দানে নেমে কাজ করতে শুরু করে। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এই জঙ্গি সংগঠনের ক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। উপস্থিতি জানান দিতে লস্কর এবং জৈশ-ই-মহম্মদের মতো একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সাহায্য নেয় তারা। এছাড়াও, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সরাসরি ভূমিকা ছিল এই জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানে। ২০২৩ সালে এই সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তারপরেই জারি হয় নিষেধাজ্ঞা।

ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে প্রচার, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আবেগকে উস্কে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছড়ানোর মতো এজেন্ডা নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই জঙ্গি সংগঠন। এই সংগঠনের মূল মাথা কাশ্মীরের জঙ্গি শেখ সাজ্জাদ গুল। নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করার আগে গুল ছিলেন লস্করের একজন কমান্ডার। এই জঙ্গির বিরুদ্ধে সাংবাদিক হত্যা থেকে শুরু করে একাধিক জঙ্গি হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জুন মাসে জম্মু-কাশ্মীরের রেইসি জেলায় পুণ্যার্থীদের একটি বাসে হামলা হয়েছিল, যেখানে ১০ পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। এই হামলার পিছনেও ছিল TRF।

৩. পিপল’স অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট (PAFF)

২০২০ সালে জৈশ-ই-মহম্মদ ও LeT-এর সমর্থনে গঠিত হয়েছিল আরও একটি কাশ্মীরি জঙ্গি সংগঠন, নাম পিপলস অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট বা PAFF। জম্মু ও কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা এবং জেহাদের ডাক দিতে এই সংগঠন তৈরি করেছিল পাকিস্তানের দুই জঙ্গি সংগঠনের নেতারা। এই সমস্ত ছোট সংগঠনের মূল লক্ষ্য থাকে পাকিস্তানের হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে কাজ করা। ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে কাশ্মীরি মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো এই সংগঠনের মূল এজেন্ডা।

সাধারণ নাগরিকদের হত্যা থেকে শুরু করে, বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ, কাশ্মীরের তরুণদের উগ্রপন্থী করে তোলার পিছনে এই সংগঠনের একটা ভূমিকা রয়েছে। এই জঙ্গি সংগঠন আবার নিজেকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' দেখানোর চেষ্টা করে। ৭ জানুয়ারি ২০২৩ সালে এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত করে ভারত সরকার। এই সংগঠনটি অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে মিলে একটি হাইব্রিড জঙ্গিবাদ সংগঠিত করে।

জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি হামলার অপারেশনে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল PAFF। এর মধ্যে অন্যতম হলো ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর কাশ্মীরের কারাগারে ডিজিপির মৃত্যু, কাশ্মীরের পুলওয়ামার কাকপোরায় পুলিশ স্টেশনে গ্রেনেড হামলা। এই জঙ্গি সংগঠনটি তার প্রচার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও এবং পোস্টার ব্যবহার করে থাকে। উল্লেখ্য, এই জঙ্গি সংগঠনটি কিন্তু কাশ্মীরের তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় বলে জানা যায়।

৪. হিজবুল মুজাহিদিন

হিজবুল মুজাহিদিন (Hizbul Mujahideen) কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয় একটি পাকিস্তান-সমর্থিত ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন, যা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে, জম্মু ও কাশ্মীরের কুলগাম জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এই সংগঠনের পাঁচজন জঙ্গি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সংগঠনের দীর্ঘদিনের কমান্ডার ফারুক আহমেদ ভাট ওরফে ফারুক নালি।

১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে জামাত-ই-ইসলামির সহায়তায় এই জঙ্গি সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে এই জঙ্গি সংগঠনটি।

২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর, কুলগাম জেলার কাদ্দার এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী, সিআরপিএফ এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের যৌথ অভিযানে হিজবুল মুজাহিদিনের পাঁচজন জঙ্গি নিহত হয়। এই অভিযানে নিহতদের মধ্যে ছিলেন ফারুক আহমেদ ভাট ওরফে ফারুক নালি, যিনি ২০১৫ সাল থেকে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সংগঠনের অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন এবং তার বিরুদ্ধে ২৫ লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। এই অভিযানে দুইজন সেনা সদস্য আহত হন এবং ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি একে-৪৭ রাইফেল, ২০টি ম্যাগাজিন, দু'টি গ্রেনেড এবং অন্যান্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। 

এর আগেও কাশ্মীর উপত্যকায় বহু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে হিজবুল মুজাহিদিন। কাশ্মীরের সাধারণ যুবকদেরকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে কাজ করে থাকে এই সংগঠনটি। ২০১৬ সালে বুরহান ওয়ানি নামে এক হিজবুল কমান্ডারের মৃত্যুর পর উপত্যকায় ব্যাপক অশান্তি সৃষ্টি হয়।

হিজবুল মুজাহিদিনের মতো সংগঠনগুলি কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। তবে, নিরাপত্তা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে এই সংগঠনের কার্যক্রমে বড় ধাক্কা লেগেছে। ফারুক নালির মতো শীর্ষ নেতার মৃত্যুর ফলে সংগঠনের মনোবলে প্রভাব পড়েছে বলেই ধারণা করা হয়।

৫. জৈশ-ই-মহম্মদ (JeM)

জৈশ-ই-মহম্মদ (Jaish-e-Mohammed বা JeM) পাকিস্তানের এক সুন্নি ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন, যা ২০০০ সালে মাসুদ আজহারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একটি ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা।

জৈশ-ই-মহম্মদ একটি দেওবন্দি মতাদর্শ-ভিত্তিক সংগঠন, যা হরকত-উল-মুজাহিদিন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আজহার ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ হাইজ্যাকের মাধ্যমে মুক্তি পান এবং পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। JeM ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন ও মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে তালিবানের সঙ্গে লড়াই করেছে।

JeM ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী। এর মধ্যে অন্যতম ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সংসদ ভবনে হামলা, যেখানে ৯ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি পাঠানকোট বিমান ঘাঁটিতে হামলা হয় যেখানে সাতজন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হন। এই হামলার দায় সরাসরি স্বীকার না করলেও, ভারতীয় ইন্টালিজেন্স জানিয়েছে, পাঠানকোটের হামলায় এই জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা জেলায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে হত্যার পিছনেও এই জঙ্গি সংগঠনের হাত ছিল। JeM-কে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাশাহি, অস্ট্রেলিয়া এবং জাতিসংঘ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৯ সালে, জাতিসংঘ মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, যা ভারতের জন্য একটি কূটনৈতিক সাফল্য ছিল।

২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল, জম্মু ও কাশ্মীরের কিশতওয়ার জেলার তুষারাবৃত অঞ্চলে একটি অভিযানে JeM-এর দুই জঙ্গি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে একজন শীর্ষ কমান্ডার সাইফুল্লাহ ছিলেন, যিনি চেনাব উপত্যকা অঞ্চলে গত এক বছর ধরে সক্রিয় ছিলেন।

আরও পড়ুন-পহেলগাম হামলার আগে ২০০০ সাল থেকে যেভাবে জঙ্গিদের নিশানা হয়েছে সাধারণ মানুষ

৬. আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ

আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ একটি আল-কায়েদা সংযুক্ত ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন, যা ২০১৭ সালে কাশ্মীরে গঠিত হয়। এই সংগঠনটি কাশ্মীরকে একটি স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে এবং ভারতের প্রশাসনের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনা করে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে জাকির রশিদ ভাট ওরফে জাকির মুসার নেতৃত্বে এই জঙ্গি সংগঠন গঠিত হয়। তিনি আগে হিজবুল মুজাহিদিনের ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন বলে জানা যায়। হুরিয়ত নেতাদের বিরুদ্ধে শরিয়া প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানোর পর তিনি হিজবুল মুজাহিদিন থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই নতুন সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সংগঠনটির নাম 'গজওয়াত-উল-হিন্দ' 'গজওয়া-ই-হিন্দ' থেকে নেওয়া হয়েছে, যা ইসলামিক উগ্রপন্থীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় একটি স্লোগান। এই সংগঠনের মূল দু'টি স্লোগান 'কাশ্মীর বনেগা দার-উল-ইসলাম' এবং 'শারিয়ত' বা 'শাহাদত'। কাশ্মীরকে একটি স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে এই জঙ্গি সংগঠন। আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ আল-কায়েদার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত এবং তাদের মিডিয়া চ্যানেল 'আল হুর'-এর মাধ্যমে তাদের সম্পূর্ণ প্রচার চালিয়ে থাকে। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর এই সংগঠনটি তালিবানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে।

এই সংগঠনটি কাশ্মীর অঞ্চলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী। ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর কাকাপোরায় সিআরপিএফ ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলা চালায় এই সংগঠন, যেখানে একজন সিআরপিএফ সদস্য নিহত হন এবং দুইজন আহত হন। ২০১৯ সালের ২৪ মে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা জাকির মুসা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। এর পরেই, ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর এই সংগঠনের দ্বিতীয় নেতা হামিদ লিলহারি আওয়ান্তিপুরায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে অভিযানে নিহত হন। ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল সোপিয়ান জেলার মেলহোরা গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এই সংগঠনের চারজন জঙ্গি নিহত হন। বর্তমানে এই সংগঠনটি অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে, তবে অনলাইনে এখনও তাদের আদর্শ এবং প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এই সংগঠন। কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যেও এই সংগঠনের কিছু প্রভাব রয়েছে।

৭. আল-বদর

আল-বদর পাকিস্তানের এক ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন, যেটি কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ছত্রছায়ায় ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর মদদপুষ্ট গুপ্ত ঘাতক বাহিনী হিসেবে এই সংগঠনের নাম উঠে আসলেও, পরবর্তীতে কাশ্মীর অঞ্চলে এই সংগঠন আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। আল-বদরের বর্তমান রূপটি ১৯৯০-এর দশকে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া অঞ্চলে গড়ে ওঠে। মূলত জামাত-ই-ইসলামির ছাত্র সংগঠন এবং হরকত-উল-মুজাহিদিনের একাংশ আল-বদর পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া শুরু করে। সংগঠনটি কট্টর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে এবং কাশ্মীরকে ভারতের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য রাখে। এরা দেওবন্দি মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং প্রায়শই লস্কর-ই-তইবা, হিজবুল মুজাহিদিনের মতো বড় সংগঠনগুলোর সহায়তাকারী হিসাবে কাজ করে।

আল-বদর তুলনামূলকভাবে ছোট সংগঠন হলেও, এর কার্যকলাপ অত্যন্ত সহিংস ও কৌশলগত। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, সংগঠনটি কাশ্মীরে 'হিট অ্যান্ড রান' ধাঁচের ছোট ছোট গেরিলা হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে। এদের ক্যাডার মূলত পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ ও কোহাট অঞ্চলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সংগঠনটি নিয়মিতভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে এবং অস্ত্র ও অর্থ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কাছ থেকে পায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

যদিও আল-বদর এতটা ব্যাপক ও সংবাদমাধ্যমে আলোচিত সংগঠন নয়, তবুও তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে কিছু বড় হামলায়। ২০০৫ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কনভয়ে গ্রেনেড হামলার পিছনে এই সংগঠনের নাম উঠে আসে। ২০১৩ সালে কুপোয়ারা অঞ্চলে একটি অস্ত্র চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে এই সংগঠনের কয়েকজন সদস্য ধরা পড়ে। এছাড়া ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকার দক্ষিণ অংশে কিছু বিচ্ছিন্ন গেরিলা হামলায় সংগঠনের বেশ কিছু অংশ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

২০২৪ সালের শেষদিকে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরের বান্দিপোরা অঞ্চলে আল-বদরের দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ও পাকিস্তানি-উৎপাদিত হ্যান্ড-গ্রেনেড উদ্ধার হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায়, তারা সীমান্ত পেরিয়ে সদ্য অনুপ্রবেশ করেছিল এবং কুলগামের দিকে একটি বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করছিল।

এগুলির পাশাপাশি, কাশ্মীরে আরও বেশ কিছু সংগঠন এমন রয়েছে যারা বিভিন্ন রকম সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে অন্যতম জামাত-উদ-দাওয়ার শাখা সংগঠন হিসেবে পরিচিত, TAJK, যারা আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে LeT এর প্রচারমূলক দিক সামলায়। এছাড়াও রয়েছে মুস্তাক জার্গারের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আল উমার মুজাহিদিন। এই সংগঠনটি মূলত বিক্ষিপ্ত কিছু হামলা সংগঠিত করেছে বিগত কয়েক দশকে। একেবারে নতুন গঠিত উদীয়মান জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে TRF ছাড়াও উল্লেখযোগ্য রয়েছে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট এবং গজনবী ফোর্স। এই প্রতিটি গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য একটাই, কাশ্মীরে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠা এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রতিটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের পিছনে হাত রয়েছে জৈশ-ই-মহম্মদ, হিজবুল মুজাহিদিন কিংবা লস্কর-ই-তইবার মতো সংগঠনের। LeT, TRF বা JeM-এর মতো সংগঠনগুলো আদতে শুধু অস্ত্র নয়, আদর্শের মারাত্মক বিষও ছড়াচ্ছে, যে বিষে আদতে কিন্তু কারওই সুবিধা হবে না, শুধু মারা যাবে সাধারণ মানুষ, রসাতলে যাবেন পর্যটন এবং সম্পর্কিত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সাধারণ কাশ্মীরিরাই।

More Articles