পারমাণবিক বসন্ত: ঋত্বিক ঘটকের ফিয়ার
Ritwik Ghatak Short Film Fear: ঋত্বিক ঘটক দিল্লির একটি সংবাদপত্রে শ্রূতকীর্তি চলচ্চিত্রকার ইংগমার বার্গম্যানকে আক্রমণ করেছিলেন তাঁর 'খ্রিস্টান বুজরুকির' জন্য। নায়ার সাহেব সেই লেখা পড়েছিলেন।
একথা এক ঝলক দখিন হাওয়ার মতো যে, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ঋত্বিক ঘটকের ১৯৬৫ সালে তোলা ছাত্রদের ডিপ্লোমা ছবি 'ফিয়ার' পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং তা এখন সমুদ্রতীরস্থ তরুণীর মতোই উজ্জ্বল। এই প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভের প্রাণপুরুষ পি.কে. নায়ারকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে উপায় নেই। আজ যে দেশে চলচ্চিত্র সংরক্ষণের জন্য একটি সচেতনতা তৈরি হয়েছে তাতে আমরা সকলেই — শিবেন্দ্র সিং দুঙ্গারপুর থেকে সাধারণ পদাতিক — নায়ার সাহেবের উদ্যোগকে স্মরণ করছি। আর প্রয়াত নায়ার সাহেবের প্রাণে এই উৎসাহটুকু একদা সঞ্চারিত করেছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম ঋত্বিক ঘটক। তিনি তখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উপাধ্যক্ষ।
একটি অবান্তর কথায় যাই। হয়েছিল কী, ঋত্বিক ঘটক দিল্লির একটি সংবাদপত্রে শ্রূতকীর্তি চলচ্চিত্রকার ইংগমার বার্গম্যানকে আক্রমণ করেছিলেন তাঁর 'খ্রিস্টান বুজরুকির' জন্য। নায়ার সাহেব সেই লেখা পড়েছিলেন। এমন হলো যে, কয়েকদিন বাদে পুনেতে ফিরে ঋত্বিক মনস্থ করলেন যে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে একটি বার্গম্যান বিষয়ক ভাষণ দেবেন। স্বভাবতই সেই যুগের ছোট্ট পুনে শহরে হইহই রইরই। অনেকেই এলেন অডিটোরিয়ামে, যাঁরা পুনের ছাত্রও নন। নায়ার সাহেব তো ছিলেনই। ঋত্বিক বলতে উঠে জানালেন, ইংগমার বার্গম্যান একজন মহত্তম পর্যায়ের চলচ্চিত্র স্রষ্টা। শ্রোতৃবৃন্দ তো শুনে থ! বিশেষত নায়ার সাহেব। তিনি আঙুল তুললেন। ঋত্বিক প্রথমে নায়ারকে পাত্তা দেননি। কিন্তু ক্রমাগত আঙুল তুলে দাঁড়িয়ে থাকায় বিরক্ত হয়ে অবশেষে জানতে চাইলেন, "নায়ার, আপনার কি কিছু বলার আছে?” নায়ার সাহেব সবিনয়ে উত্তর দিলেন, “সেদিন একটি ইংরেজি সংবাদপত্রে আপনিই বলেছেন বার্গম্যান একটি বুজরুক, আর আজ আপনি বলছেন তিনি মহত্তম?” ঋত্বিক, ঈষৎ থেমে, জবাব দিলেন, “Well, That is between me and Bergman. For you he is great.”
আরও পড়ুন- ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ নয়, আজ ঋত্বিককে ভুলতে পারলেই কেন সুবিধা বাঙালির?
আমার পাঠকরা কৌতূহলী হয়ে উঠবেন যে, ফিয়ার ছবিটির ধানভানা প্রসঙ্গে বার্গম্যানের মতো শিবের গীত গাওয়ার যুক্তি কী? আমার কাছে, সবচেয়ে জরুরি হলো, এই ছাত্রদের জন্য টিউটোরিয়াল নির্মাণ বস্তুত ঋত্বিক ও বার্গম্যানের মধ্যে অজান্তেই এক তাত্ত্বিক তর্কের অবতারণা করেছে। বস্তুত, ১৯৫৬ সালের দ্য সেভেন্থ সিল ছবিটি থেকে ১৯৬২-র উইন্টার লাইট পর্যন্ত বার্গম্যান ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত সংঘর্ষ চালিয়ে গেছেন, যাকে ঋত্বিক শ্রদ্ধা সত্ত্বেও দার্শনিকভাবে অনুমোদন করতে পারেননি। এমনকী আমরাও ভুলতে পারি না যে, উইন্টার লাইট ছবিতে আত্মহত্যার ঘটনাটি অনুষ্ঠিত হয় চৈনিক পারমাণবিক বিস্ফোরণের আতঙ্কে এবং বার্গম্যান তখনই অনুপস্থিত ঈশ্বর এবং জড় হৃদয় সম্পর্কে, নিষ্প্রাণ গির্জায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এরকম মর্মান্তিক শূন্যতা, চলচ্চিত্র আর প্রত্যক্ষ করেনি বিশ শতকে। বার্গম্যান বলতে চান, এই শূন্যতা একটা আয়না — "I see myself feel fear and loathing”। এই আতঙ্ক আধুনিক অস্তিত্বের রেখাচিত্র।
ফিয়ার ছবিটির কৃতিত্ব যে, তা তো কোনও ছবি নয়, অল্প বাজেটে মেকআপ, কস্টিউম ছাড়া, কোনও দৃশ্যসজ্জা ছাড়া একটা ভাবনার কাঠামো। ছাত্রদের ঋত্বিক ঘটক বোঝাতে চাইছিলেন চলচ্চিত্রের উপজীব্য কী হওয়া উচিত। আমরা সকৌতুকে লক্ষ্য করি, এখানে বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অভিনয় করছেন পরবর্তীকালে মুম্বই চলচ্চিত্রে যিনি প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠবেন, সেই সুভাষ ঘাই! স্থিতধী মানুষের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে যাঁকে, সেই আশরানিও পরবর্তীকালে মুম্বই পর্দায় তাঁর আসন পেতে নেবেন। অথচ ঋত্বিক কী শেখাচ্ছিলেন ছাত্রদের? একটি পারমাণবিক বাঙ্কারে মানুষের হৃদয়ের প্রস্থচ্ছেদ। এখানে স্পষ্টতই বোঝা যায়, কিছু 'পতিত' মানুষ — মৃত্যুর থেকে যারা পরিত্রাণ চেয়েছে মিথুনে, যারা হতবিহ্বল, যারা আত্মবিস্মৃত, তাদের কয়েকটি মুহূর্ত। মুখের ক্লোজআপ সমূহ যেন আত্মার অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়েছে। আলো ও ছায়া, সাদা ও কালোর কী অসামান্য অনুপাত! সিঁড়িটি তো অভিব্যক্তিবাদদের চূড়ান্ত অভিজ্ঞান। এই ছবি যদি ঋত্বিক স্বয়ং পূর্ণদৈর্ঘ্যের করতেন তাহলে আমার ধারণা, তা বুনুয়েলের এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেলের মতো আটকে পড়া একদল মানুষকে ধরত অথবা তারকোভস্কির স্যাক্রিফাইস ছবিতে দণ্ডিত মানুষের অন্তিম উচ্চারণ লিপিবদ্ধ করার সমান্তরাল প্রস্তাব দিত। ঋত্বিকের সেই সুযোগ ছিল না এই ছোট ছবিতে। তিনি শুধু ছাত্রদের শেখাতে চেয়েছিলেন চেতনার বিন্যাস, যে কীভাবে মহৎ ছবি তার উপাদান সংগ্রহ করতে পারে। মৌলিক বিষাদের মতো ভয় আমাদের চেতনাকে কোন মোহাবরণে মুড়ে রাখে?
আরও পড়ুন- সত্যজিৎ, ঋত্বিক নন; মধ্যবিত্ত সমাজকে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন মৃণাল সেনই!
আজ যখন ছবিটিকে দেখলাম, তার আলোকসম্পাত, মুখাবয়ব ও অধোগামী সিঁড়ি — তখন কেন জানি না, একজন চলচ্চিত্রশিক্ষক হিসেবে আবার নিজের অকিঞ্চিৎকরতা উপলব্ধি করলাম। আমরা তো ভাবতেই পারি না, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে, কে না জানে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক সীমান্ত রেখায় আগুন এবং বারুদের বিস্তারের কথা — তবু ঋত্বিক ঈশ্বরবিহীন অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করলেন, সুবর্ণরেখার অনুক্রমে "আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়" গানটির প্রয়োগ আমাদের জানিয়ে গেল, এই নির্মল শিশিরে ভোরের আলোয় সমস্ত আকাশ টোড়ির মতো। মানুষের মৃত্যু নেই। না, যদি তিনি শিল্পী না হয়ে শুধু চলচ্চিত্রশিক্ষকই হতেন তাহলেও আসমুদ্রহিমাচল তাঁর পায়ে শতবর্ষের প্রণামই রাখত। জীবনানন্দকেই মনে পড়ে — “আজীবন কেবলই বিপন্ন হয়ে চলে/ তারপর যে বিপদ আসে/ জানি হৃদয়ঙ্গম করার জিনিস।" আজ যখন ভারত পাক সীমান্ত রেখা আবার মেঘলা হয়ে উঠেছে তখন ফিয়ার ছবিটির গুরুত্ব অন্যরকম।