ললিত মোদি: কয়েকশো কোটি বাগিয়ে নির্বিঘ্নে পলাতক আইপিএলের জনক
Lalit Modi: ২০০৮ সালে আইপিএল প্রতিষ্ঠায় এই ললিত মোদির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যা এখন বহু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
নিন্দুকেরা বলে থাকেন, এক মোদির মাথায় আরেক মোদির হাত থাকায়, শত দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মোদি গ্রেফতার হননি। এক মোদি খোদ নরেন্দ্র দামোদরদাস এবং অন্যজন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ভারতীয় ব্যবসায়ী ললিত মোদি। হঠাৎ ললিত মোদি কেন? কারণ তিনি আবারও শিরোনামে এসেছেনে। ভানুয়াটুর প্রধানমন্ত্রী পলাতক ভারতীয় ব্যবসায়ী ললিত মোদীর দ্বীপরাষ্ট্র কর্তৃক জারি করা পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন। দুর্নীতির মামলায় দিল্লির ওয়ান্টেড তালিকায় ললিত আছেন দীর্ঘবছর। এতদিন ললিত ভারত থেকে পালিয়ে বাস করছিলেন লন্ডনে। কিছুদিন আগেই জানা যায়, তিনি ভানুয়াটু বলে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো একটি দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। ৮০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ভানুয়াটু সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক মানুষই ওয়াকিবহাল কিন্তু ললিতের নাগরিকত্ব গ্রহণের পর ওই দেশ সম্পর্কে ইন্টারনেটে তথ্য-তালাশ শুরু হয়। তবে ভানুয়াটুর নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় ললিতকে দেশে ফেরানো আরও কঠিন হতে পারে মনে হচ্ছিল। এখন কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা দেখতে হবে। ২০০৮ সালে আইপিএল প্রতিষ্ঠায় এই ললিত মোদির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যা এখন বহু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি-আরএসএস বুঝতে পেরেছিল এদেশে ক্রিকেট মানেই জাতীয়তাবাদ। ক্রিকেটকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা গেলে যুবসমাজকে আরও বেশি এই নেশায় বুঁদ করে রাখা যাবে। বিভিন্ন বলিউড তারকা সমন্বয়ে ২০ ওভারের ক্রিকেট শুরু হতেই কোন তারকা কত টাকা পেলেন, কাকে কোন দল, কত টাকায় কিনল — এই সমস্ত তথ্যের আড়ালে চপা পড়ে গেল ক্রিকেটকে ব্যবহার করে আরও ধনী হচ্ছেন কারা, সেই আসল কথাগুলি। ললিত মোদিও এই সুযোগকে ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকশো কোটি টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি একাধিক অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ বছরে যেভাবে ইডি এবং সিবিআই বিরোধী দলের নেতা-মন্ত্রীদের দুর্নীতির অভিযোগে তদন্তে তৎপর, এই সব ঋণখেলাপি এবং দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কিন্তু ততটা বিচলিত নয়। নরেন্দ্র মোদির দুর্নীতি বন্ধ করার সদিচ্ছা নিয়েও তাই প্রশ্ন ওঠে।
আরও পড়ুন- ড্রাগ থেকে প্রতারণা, সুস্মিতার জীবনসঙ্গী ‘ফেরার’ ললিত মোদির জীবন ভরা বিতর্কে
ললিত মোদির বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি ২০১০ সালের আইপিএলে দু'টি দলের ফ্র্যাঞ্চাইজির নিলামের সময় দরপত্রে জালিয়াতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর বিরুদ্ধে অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রচার এবং ইন্টারনেট অধিকার বিক্রির অভিযোগও আনা হয়েছিল। ২০১০ সাল থেকেই ললিত দেশছাড়া হলেও নানা সময়ে তিনি খবরে এসেছেন। সম্প্রতি লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের দ্বারস্থ হন তিনি। ভারতের পাসপোর্ট বাতিল করতে আবেদন জানান। সেই সঙ্গে ভানুয়াটুর নাগরিকত্ব গ্রহণের কথাও জানান। তবে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী, ললিত মোদির নাগরিকত্ব বাতিল করেছেন। তাহলে কি প্রাক্তন আইপিএল কর্তা ললিতের আগামী আর খুব সুখকর হবে না?
একাধিক তদন্তকারী সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। বিদেশি অনুদান আইন লঙ্ঘন নিয়ে আয়কর বিভাগ এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সামনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসাবাদ পর্বেই যোগ দেন তিনি। ২০১০ সালের মে মাসে দেশ ছাড়েন। ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে জামিন অয়োগ্য ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে মুম্বইয়ের বিশেষ আদালত। বিসিসিআই অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও ললিতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। একাধিক মামলায় ললিত দোষী বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছয় বোর্ড। আজীবনের জন্য ললিতকে নিষিদ্ধ করে তারা। নির্দেশ হয় ললিত যেন ক্রিকেট প্রশাসন থেকে দূরে থাকেন। ললিত যদিও নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। লাগাতার ললিতকে ভারতের প্রত্যর্পণের চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। কিন্তু ভানুয়াটুর নাগরিকত্ব গ্রহণ করায়, তাঁকে দেশে ফেরানো আরও কঠিন হতে পারে বলেই মনে করা হয়েছিল। ললিতের বিরুদ্ধে মামলা যেমন চলছে, চলবে বলে জানিয়েছে বিদেশমন্ত্রক। ভানুয়াটুর জনসংখ্যা ৩ লক্ষের আশেপাশে। সেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব হাসিল করার উপায় রয়েছে। সওয়া ১ থেকে দেড় কোটি টাকাতেই সেখানকার নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন- কেউ বলে ফেরার, কেউ বলে কুবের! ললিত মোদির সম্পত্তির পরিমাণ জানলে চোখ কপালে উঠবেই
বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, "আইন অনুযায়ী, ওঁর বিরুদ্ধে এখনও তদন্ত চলছে আমাদের, তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।" ললিত মোদিকে ফেরানোর বহু ব্যর্থ চেষ্টা করেছে ভারত। এত অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি কিন্তু নিশ্চিন্তে আছেন। সামাজিক মাধ্যমেও যথেষ্ট নিয়মিত ললিত। ইন্সটাগ্রামে বিভিন্ন বলিউড তারকার সঙ্গে দেখা যায় তাঁকে। মাঝে একবার তিনি টুইট করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ভারতের কোনও আদালতে কোনও মামলা চলছে না। তবে কিছুতেই তাঁকে আর ভারতে নিয়ে আসতে পারেনি কেন্দ্র সরকার। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, আদৌ সরকার ললিত মোদিকে ফিরিয়ে আনতে চায়? ললিত-সহ অন্যান্য এইরকম ঋণখেলাপি এবং দুর্নীততে অভিযুক্তদের ফিরিয়ে আনলে, শাসকদলের কোন কোন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা তা প্রকাশ্যে চলে আসার ভয়েই কি পলাতক বীরদের ফেরত আনার কথা ভাবছেই না সরকার? একটি নির্বাচনী সভায়, কংগ্রেসের রাহুল গান্ধি বলেছিলেন, "সমস্ত চোরদের পদবিই কি মোদি?" তা নিয়ে প্রবল বিতর্ক হওয়াতে রাহুল গান্ধি বলেছিলেন, তিনি নীরব মোদি এবং ললিত মোদির উল্লেখই করেছিলেন। এই বক্তব্যের ফলে রাহুল গান্ধিকে আদালত সাজা দেয় এবং তাঁর সাংসদ পদও বাতিল হয়। অথচ ঋণখেলাপি ললিত মোদির বেলায় কোনও ভূমিকা নেই সরকারের। ললিত মোদির দেশ থেকে পালানো এবং দীর্ঘদিন অধরা থাকার কারণ কি তাঁর মাথায় অন্য এক মোদির হাত থাকাই নয়?
ক্রিকেট জগতে ললিত মোদি কিন্তু অপরিচিত ছিলেন প্রাথমিকভাবে। বিসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি আইএস বিন্দ্রা তাঁকে একজন উদ্যমী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সবার সঙ্গে। বিন্দ্রার ধারণা ছিল, খেলার আর্থিক সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য উজ্জ্বল এক মুখ হয়ে উঠতে পারেন ললিত। ক্রিকেট প্রশাসনে ললিত মোদির প্রবেশও ছিল চারদিক কাঁপানো। তিনি এমন কিছু করেছিলেন যা অনেকেই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে তাঁর উত্থানও হয় উল্কাবেগে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (আরসিএ) নিয়ন্ত্রণকারী রুংটা পরিবারের শাসনের অবসান ঘটান ললিত। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ব্যবহার করে এই কাজটি করেছিলেন ললিত। ফলে খুব দ্রুত বিজেপির ওপর তলার নেতাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন ললিত। সেই সময়ে রাজস্থান সরকার নতুন ক্রীড়া আইন প্রণয়ন করে, যার ফলে দেখা যায় আরসিএ-র ভোটাধিকার ৩৩টি জেলার হাতে থাকবে, শুধুমাত্র অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের নয়। ললিত মোদির প্যানেল ক্ষমতায় আসে, তিনি আরসিএ-র দায়িত্ব নেন এবং রাজস্থান ক্রিকেট এক নতুন ভোর দেখে। রাজস্থান আধুনিক ক্রিকেট পরিকাঠামো অর্জন ও উন্নয়নের জন্য সম্পূর্ণরূপে ললিত মোদিকেই কৃতিত্ব দেওয়া যায় এবং তারা রঞ্জি ট্রফি জিতে নেয়।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যখন বুঝতে পারে যে ললিত মোদি অচিরেই এই খেলার সুপ্রতিষ্ঠিত অভিজ্ঞ প্রাক্তন তারকাদের গ্রাস করবেন, তখন তাঁকে ক্রিকেট থেকেই বহিষ্কার করা হয়। ক্রিকেট মহলে খুব একটা কেউ অবাক হয়নি এই সিদ্ধান্তে কারণ ললিত মোদি তাঁর অসংযমী আচরণের মাধ্যমে বেশ কিছু শত্রুও তৈরি করেছিলেন। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের সাফল্য তাঁকে এক উচ্চমানের ক্রিকেট প্রশাসনের প্রধান হওয়ার ঈর্ষণীয় পদে পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি খেলায় অর্থ এবং গ্ল্যামার এনেছিলেন। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আইপিএল পরিচালনা করার গৌরব উপভোগ করছিলেন ললিত, যা পরে তাঁর জীবনের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এর পরেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা শুরু হয়। অথচ এই সব বৃহৎ দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার জায়গায় এই সমস্ত ব্যবসায়ীরা কোন তারকার সঙ্গে ছবি দিলেন, কাকে বিয়ে করলেন, ক’বার বিবাহ বিচ্ছেদ হলো — এই সব আলোচনাতেই আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গোঁত্তা খেয়ে মরে। পালিয়ে গিয়েও, ক্ষমতার বদান্যতায় ললিতদের মতো মানুষজন বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে থাকেন।