ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কাশ্মীর বৈরিতার যে ইতিহাসে দাঁড়ি পড়েনি আজও

India Pakistan Relation: পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের উপজাতি মিলিশিয়ারা সরাসরি জম্মু-কাশ্মীরের এই দলীয় রাজ্যটিতে প্রবেশ করতে শুরু করে।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁও এলাকায় পর্যটকদের ওপর সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শত্রুতা ও অবিশ্বাসের ইতিহাসে নতুন এক উদ্বেগজনক অধ্যায় যোগ করেছে। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক দৃশ্যপটে পহেলগাঁও এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কাশ্মীরের পর্যটন ব্যবসার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই পহেলগাঁও। তাই এই আক্রমণ একদিকে যেমন ভারতীয়দের নিরাপত্তার উপরে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, তেমনই আবার সাধারণ কাশ্মীরিদের জীবন জীবিকার ভবিষ্যতকেও অনিশ্চিত করে দিয়েছে। এই ঘটনা শুধু এক বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী আক্রমণ নয়, বরং বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সংঘর্ষধর্মী গতিপ্রকৃতির প্রতিফলন। স্বাধীনতার প্রায় আট দশক পরেও এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে শীতল সম্পর্কের কেন্দ্রীয় কারণ রয়ে গেছে সেই — কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত বিরোধ এবং রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বিভাজনের রক্তাক্ত উত্তরাধিকার

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত ও পাকিস্তানের জন্মের মধ্য দিয়ে যে বিভাজন ঘটেছিল, তা কেবল ভৌগোলিক নয়, ছিল ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং মানসিক বিভাজনও। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্তি প্রশ্নেই দু'দেশের মধ্যে প্রথম সংঘাতের সূচনা হয়। পরবর্তীতে, এই কাশ্মীর সমস্যাই ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত মাত্রাও লাভ করেছে।

দীর্ঘ এবং ঘটনাবহুল এই ইতিহাসে ভারত ও পাকিস্তান আজ অবধি চারবার সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং বেশ কয়েকবার যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। আর প্রতিবারই এই যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আঞ্চলিক আধিপত্যের আকাঙ্খা, জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ। পহেলগাঁওয়ের সাম্প্রতিক এই ঘটনা সেই দীর্ঘ ইতিহাসেরই একটি অংশ, যা বারবার প্রমাণ করে যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথটি এখনও আগের মতোই রয়ে গিয়েছে কণ্টকাকীর্ণ।

১. ১৯৪৭-১৯৪৮: প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ — ভারতের সামরিক ব্যর্থতা

ভারত এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কাশ্মীরে একের পর এক সমস্যা শুরু হয়। যদিও সেই সময়, কাশ্মীর কিন্তু ভারত বা পাকিস্তান কোনও দেশেরই অংশ ছিল না। স্বাধীনতার সময় কাশ্মীর ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সেখানকার শাসক ছিলেন মহারাজ হরি সিং। ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানের ওয়াজিরিস্তানের উপজাতি মিলিশিয়ারা সরাসরি জম্মু-কাশ্মীরের এই দলীয় রাজ্যটিতে প্রবেশ করতে শুরু করে। এই মিলিশিয়া উপজাতিদের অধিকাংশই আজকের দিনে লস্কর হিসাবে পরিচিত। এই লস্কররা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এবং পাকিস্তান সরকার তাদের এই অনুপ্রবেশের জন্য সমর্থনও করেছিল। তাদের অনুপ্রবেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল, জম্মু-কাশ্মীরের দেশিয় রাজ্য দখল করা এবং এই অঞ্চলের শাসক মহারাজা হরি সিংকে ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখা।

তবে, সরাসরি যুদ্ধের আগে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং পশ্চিম কাশ্মীরের পুঞ্চ অঞ্চলে মুসলিম প্রজাদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। এর ফলে পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশ কিছু জেলা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পাকিস্তান এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। উপজাতি মিলিশিয়ারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে শ্রীনগরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। বারামুলায় ব্যাপক লুটপাটের কারণে তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হলেও, বিপদ কমে যায়নি রাজার। সেই কারণে কোনও উপায় না দেখে সরাসরি ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চেয়ে আবেদন জানান মহারাজ। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর মহারাজ হরি সিং ভারতের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তানের ভারতে অন্তর্ভুক্তির ঠিক পরেই ভারতীয় সেনারা শ্রীনগরে আকাশ পথে অবতরণ করে এবং শুরু হয় প্রথম ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ।

মহারাজা হরি সিং

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও, প্রাথমিকভাবে কিন্তু পাকিস্তান আর্মি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৪৮ সালের আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ঝাঙ্গার, নওশেরা ও পুঞ্চের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই লড়াই চলে ছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের পর এই যুদ্ধ শেষ হয়। ভারত পাকিস্তানের এই প্রথম যুদ্ধে, ভারত নিজেদের জমি হারায়। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের একটা বিস্তীর্ণ অংশ পাকিস্তানের হাতে চলে যায়, যা আর কখনই ফিরে আসেনি। যে অংশগুলি এই যুদ্ধের পর পাকিস্তানের হাতে চলে যায়, সেগুলি পরে পরিচিত হয় পাক অধিকৃত কাশ্মীর হিসেবে। পাকিস্তান এই অঞ্চলকে আজাদ কাশ্মীর নাম দেয় এবং এখনও এই অঞ্চলটি গিলগিট বালতিস্তান নাম নিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রথম ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের কৌশল ছিল ‘ফ্যাক্টস অন দ্য গ্রাউন্ড’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের প্রস্তাবনা কাশ্মীর ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ করলেও, বাস্তবে এটি এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকট হিসেবে থেকে যায়।

২. ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ—দ্বিতীয় কাশ্মীর সংঘাত

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ছিল কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সংঘটিত দ্বিতীয় বৃহৎ সামরিক সংঘাত। ১৯৪৮ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের হাতে কাশ্মীরের জমি হারানোর পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারতীয় সেনাকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টা করেন। ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার। তবুও, আইবির ব্যর্থতার কারণে ১৯৬২ সালের চিন ভারত যুদ্ধেও চিনের কাছে পরাস্ত হতে হয় ভারতকে। পাকিস্তান মনে করেছিল, ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে ভারতের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে, পাকিস্তান ১৯৬৫ সালের অগাস্ট মাসে 'অপারেশন জিব্রাল্টার' নামক এক দুঃসাহসিক সামরিক অভিযান শুরু করে।

কারণ: ভ্রান্ত ধারণা ও অপারেশন জিব্রাল্টার

'অপারেশন জিব্রাল্টার'-এর মূল পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানি সেনা ও প্রশিক্ষিত অনিয়মিত যোদ্ধাদের স্থানীয় কাশ্মীরিদের ছদ্মবেশে ভারতের কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করানো। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় জনগণের মধ্যে এক ব্যাপক বিদ্রোহের জন্ম দেওয়া এবং ভারতীয় শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া। পাকিস্তান আশা করেছিল, এই বিদ্রোহের ফলে কাশ্মীর ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে।

তবে, পাকিস্তানের এই পরিকল্পনা প্রথমেই মুখ থুবড়ে পড়ে। স্থানীয় কাশ্মীরি জনগণ অনুপ্রবেশকারীদের তেমন একটা সমর্থন জোগায়নি। বরং, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত এই অনুপ্রবেশের বিষয়টি জানতে পারে এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ভারতের সামরিক বাহিনী এর সমুচিত জবাব দেয়। তারা পীর পাঞ্জাল পাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হাজী পীর দখল করে নেয়। এই পীর পাঞ্জাল পাস ছিল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি বড় সাফল্য ছিল।

ভারতের এই পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায়, পাকিস্তান ১ল সেপ্টেম্বর 'অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম' শুরু করে। এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল জম্মুর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আখনুর দখল করা। আখনুর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্ভিস লাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং পাকিস্তান মনে করেছিল যে এটি দখল করতে পারলে ভারতীয় সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া যাবে।

পাকিস্তানের 'অপারেশন গ্র্যান্ড স্ল্যাম'-এর তীব্রতা উপলব্ধি করে ভারত একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়। ৬ সেপ্টেম্বর, ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহর লাহোর ও শিয়ালকোটের দিকে অগ্রসর হওয়া এবং পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা কাশ্মীর থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত তীব্র এবং এতে ট্যাঙ্ক ও বিমান বাহিনীর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করে এবং প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ফলাফল: অচলাবস্থা ও তাসখন্দ চুক্তি

দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত এক অচলাবস্থার দিকে ধাবিত হয়। উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় এবং এই যুদ্ধে কোনও পক্ষই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগের মুখে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২১১ নম্বর প্রস্তাব পাশ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। উভয় দেশ শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়।

যুদ্ধের পর, সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি উজবেকিস্তানের তাসখন্দ শহরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনার ফলস্বরূপ পরের দিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে 'তাসখন্দ ঘোষণাপত্র' স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আইয়ুব খান। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে উভয় দেশ তাদের যুদ্ধ শুরুর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে সম্মত হয়। তবে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের পর, একই দিন, ১১ জানুয়ারি, শাস্ত্রী তাসখন্দে মারা যান। এখনও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু এক বিরাট রহস্য হয়ে রয়ে গেছে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানের ভুল রণনীতি এবং স্থানীয় জনগণের সমর্থন না পাওয়ায় তাদের 'অপারেশন জিব্রাল্টার' ব্যর্থ হয়। ভারতের সাহসি পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক চাপের ফলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থামে এবং উভয় দেশ আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়। যদিও এই যুদ্ধ কোনও স্থায়ী সমাধান আনতে পারেনি, তবে এটি উভয় দেশের সামরিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

১৯৭১: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ—এক রক্তঝরা অধ্যায়

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের মূল কারণ নিহিত ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং এর ফলস্বরূপ সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় পূর্ব পাকিস্তানে এক বিরাট ক্ষোভের জন্ম দেয়, আর সেখান থেকেই উদ্ভূত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন।

১৯৭১ সালে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক পূর্ব বাংলার নিরীহ বাঙালি জনগণের উপর চালানো নৃশংস ও অমানবিক দমন-পীড়ন এক ভয়াবহ রূপ নেয়। অপারেশন সার্চলাইট নামক কুখ্যাত অভিযানের মাধ্যমে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। এই নারকীয় অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

ভারত, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে এই মানবিক সংকটকে উপেক্ষা করতে পারেনি। একদিকে যেমন বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করতে হচ্ছিল, তেমনই অন্যদিকে পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির আকাঙ্খাও ভারতের সহানুভূতি লাভ করে। ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে নৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি বৃদ্ধি করে।

এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে আকস্মিক বিমান হামলা চালায়। এই হামলা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণার শামিল ছিল এবং এই হামলা যুদ্ধ পরিস্থিতিকে এক চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী: বিজয়ের পথে অগ্রযাত্রা

পাকিস্তানের এই আগ্রাসী হামলার পর ভারত আর পিছু হটেনি। ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের সমন্বিত আক্রমণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রতিরোধ দ্রুত ভেঙে পড়তে শুরু করে।

একই সময়ে, পশ্চিম সীমান্তেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানেও সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এই যুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনী এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা সফলভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জলপথ অবরোধ করে, যার ফলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তাদের পিছু হটতে হয়।

স্যাম মানেকশ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান। মানেকশ ছিলেন এই যুদ্ধের প্রধান স্থপতি। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান পরিকল্পনা করেন এবং তা বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দেন। তিনি পূর্বাঞ্চলে দ্রুত অগ্রগতির জন্য সমন্বিত সামরিক কৌশল তৈরি করেন, যেখানে স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে।

স্যাম মানেকশ

ফলাফল: স্বাধীনতার সূর্যোদয় ও সিমলা চুক্তি

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ফলস্বরূপ, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় বাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

এই যুদ্ধে ভারতের নৈতিক বিজয় শুধু একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মই দেয়নি, বরং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেও সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দেয়। পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি নতুন সীমান্তকে স্বীকৃতি দেয় এবং উভয় দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। প্রসঙ্গত, পহেলগাঁও যুদ্ধের পর পাকিস্তান এই সিমলা চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

১৯৯৯: কার্গিল যুদ্ধ — হিমালয়ের শিখরে রক্তক্ষয়ী সংঘাত

১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত এক অপ্রত্যাশিত ও তীব্র সামরিক সংঘাত। এই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্য ও জঙ্গিদের এক দুঃসাহসিক ও ধৃষ্টতাপূর্ণ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে। কাশ্মীরি বিদ্রোহী হিসেবে ছদ্মবেশ ধারণ করে এই জঙ্গিরা ১৯৯৯ সালের মে মাসের শুরুতে লাদাখের কার্গিল জেলায় অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। এই জেলাটি কৌশলগতভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জেলায় যে কয়টি পর্বত শৃঙ্গ রয়েছে, সব ভারত নিয়ন্ত্রিত। অনুপ্রবেশের পর তারা ধীরে ধীরে কার্গিল জেলার এই ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত পর্বত চূড়াগুলির উপরে দখল নিতে শুরু করে।

পাকিস্তানের এই সুপরিকল্পিত অনুপ্রবেশের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের ভারতীয় সেনার উপরে চাপ সৃষ্টি করা এবং সারা বিশ্বের নজর কাশ্মীরের দিকে নিয়ে আসা। কার্গিলের দুর্গম ও উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এই চূড়াগুলো কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এখান থেকে ভারতীয় কাশ্মীর ভূখণ্ডের উপর নজরদারি করা এবং আক্রমণ চালানো সহজ ছিল।

পাকিস্তানের লাহোর চুক্তি উল্লঙ্ঘন

১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ঐতিহাসিক লাহোর চুক্তি। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ লাহোরে এক ঐতিহাসিক শীর্ষ বৈঠকের পর এই দ্বিপাক্ষিক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। লাহোর চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনা প্রশমন করা এবং শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। এই চুক্তিতে উভয় দেশ কাশ্মীরসহ সকল অমীমাংসিত বিষয় শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের অঙ্গীকার করে। এছাড়াও, পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি কমানো, আস্থা বৃদ্ধির পদক্ষেপ করা এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করলেও তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজে পরবর্তীতে এই কার্গিল অনুপ্রবেশকে 'চুক্তি লঙ্ঘন' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে, সেই সময়ের সামরিক নেতৃত্ব তাদের পদক্ষেপকে কৌশলগতভাবে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিল।

গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী: 'অপারেশন বিজয়'-এর সূচনা

অনুপ্রবেশের বিষয়টি জানতে পেরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সেনাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের জন্য শুরু হয় অপারেশন বিজয়। তবে ভারতীয় সেনার জন্য এই অপারেশন একেবারেই সহজ ছিল না। আগে থেকেই কার্গিলের এই সমস্ত শৃঙ্গ দখল করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। এর ফলে অনুপ্রবেশকারীদের সরিয়ে নিজেদের জমি ফিরিয়ে আনতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় ভারতীয় সেনাকে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গেই এই অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী। শত্রুদের অবস্থান লক্ষ্য করে নির্ভুল বোমা বর্ষণ করে বিমান বাহিনী ভারতীয় স্থল সেনাকে সাহায্য করে। এই অপ্রত্যাশিত সংঘাত আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং দ্রুত একটি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়। বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য তীব্র কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে।

ফলাফল: নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার

কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা তীব্র ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের বীরত্বের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে এবং শত্রুদের সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কার্গিল যুদ্ধ ভারতের জন্য একটি কঠিন বিজয় ছিল, যা দেশের সামরিক সক্ষমতা ও জাতীয় সংহতিকে আরও দৃঢ় করে তোলে। কার্গিলের বরফঢাকা পাহাড়ে সংঘটিত এই সংঘাত উভয় দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যায় এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্কবার্তা রেখে যায়।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থা (কালানুক্রমিক):

১. অপারেশন ব্রাসট্যাকস (১৯৮৬-১৯৮৭): সামরিক মহড়া ও উত্তেজনা

১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজস্থানে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে 'অপারেশন ব্রাসট্যাকস' নামে এক বিশাল সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। ভারত এটিকে একটি নিয়মিত মহড়া হিসেবে অভিহিত করলেও, এর ব্যাপক পরিসর এবং মহড়াটি সীমান্ত সন্নিহিত এলাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় পাকিস্তান একে ভারতের আগ্রাসী পদক্ষেপ হিসেবই বিবেচনা করে। ফলস্বরূপ, পাকিস্তানও পাল্টা সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই পরিস্থিতিতে উভয় দেশই যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে, কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত উত্তেজনা প্রশমিত হয় এবং সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো সম্ভব হয়।

২. ২০০১-২০০২ ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি অবস্থান: সন্ত্রাসী হামলা ও সেনা মোতায়েন

২০০১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় পার্লামেন্টে এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ভারত এই হামলার জন্য পাক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত 'অপারেশন পরাক্রম' শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণ রেখা লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে। পাকিস্তানও দ্রুত পাল্টা সেনা মোতায়েন করে। এই দীর্ঘস্থায়ী মুখোমুখি অবস্থান প্রায় কয়েক মাস ধরে চলে। সীমান্ত এলাকায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করে এবং সম্ভাব্য সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়। অবশেষে, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয় এবং উভয় দেশ সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়।

৩. ২০১৯ বালাকোট বিমান হামলা ও পরবর্তী পরিস্থিতি: পুলওয়ামা ও আকাশপথে সংঘাত

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় বহু ভারতীয় আধাসামরিক কর্মী নিহত হন। এই হামলার দায়ভার পাক জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ স্বীকার করে। এর জবাবে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বালাকোটে জইশ-ই-মহম্মদের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে বিমান হামলা চালায় বলে দাবি করে। পাকিস্তান এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ভারতের কাশ্মীরে বিমান হামলা চালায়। এই হামলা পাল্টা হামলায় আকাশপথে উভয় দেশের যুদ্ধবিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং একজন ভারতীয় পাইলট পাকিস্তানের হাতে বন্দি হন। আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যস্থতার পর শেষ পর্যন্ত ওই ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পায়। তবে, এই ঘটনা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে তোলে এবং পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।

অভিনন্দন বর্তমান

কাশ্মীর: বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু

কাশ্মীর সমস্যা শুধু ভৌগোলিক দাবি-দাওয়ার প্রশ্ন নয়; এটি ধর্মীয় পরিচয়, জাতীয়তাবাদ এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষস্থল। ভারতের কাছে কাশ্মীর বহুত্ববাদী জাতির মডেল আর পাকিস্তানের কাছে এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ‘স্বাভাবিক’ অধিগ্রহণের প্রতীক। একদিকে ভারত সংবিধানের মাধ্যমে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তিকে বৈধতা দিয়েছে, অন্যদিকে পাকিস্তান এটিকে অসম্পূর্ণ বিভাজনের অবশিষ্ট সমস্যা বলে বিবেচনা করে।

সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্ত উত্তেজনা: রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় উপাদানের ভূমিকা

১৯৮০-এর দশক থেকে পাকিস্তান সক্রিয়ভাবে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে সমর্থন দেয়, যা ১৯৯০-এর দশকে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদের রূপ নেয়। ভারতের অভিযোগ অনুযায়ী, পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থা (ISI) সরাসরি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে প্রশিক্ষণ ও সাহায্য দিয়ে এসেছে। এর ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সন্ত্রাসবাদী অনুপ্রবেশ, সীমান্তে গোলাগুলি এবং একাধিক বড় হামলা সংঘটিত হয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে পুলওয়ামা, উরি, পাঠানকোট এবং সাম্প্রতিক পহেলগাঁও হামলা।

ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায় সংঘাত, সন্দেহ এবং প্রতিশোধের ছায়ায় রচিত হয়েছে। পহেলগাঁও হামলা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি সেই দীর্ঘ, রক্তাক্ত, ও অসম্পূর্ণ অধ্যায়েরই ধারাবাহিকতা, যা কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। এখনও ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পহেলগাঁওয়ের ঘটনা নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়নি। তার আগেই এই ইস্যুতে আমেরিকার মধ্যস্থতা আশা করতে শুরু করেছে ইসলামাবাদ। অপরদিকে আবার পাকিস্তানের রক্তচাপ বাড়িয়ে প্রাক্তন পাক সেনা কর্মী আদিল রাজা ঘোষণা করেছেন, পাকিস্তানের মদতেই নাকি ঘটেছে এই কাশ্মীর হামলা। আর এই প্রেক্ষাপটে আবারো ভারতীয়দের মনে ঘুরতে শুরু করেছে একটিই প্রশ্ন — ভারত কীভাবে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করবে? ভারত কি এবারেও পুলওয়ামার ঘটনার মতো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেই ক্ষান্ত থাকবে? না কি আমরা দেখব ভারত ও পাকিস্তানের পঞ্চম যুদ্ধ?

More Articles