লং কোভিড: যেভাবে কোমর ভেঙেছে অর্থনীতির

Long Covid: ২০২০ সালের মে মাসে একটি সরকারি জরিপে দেখা গেছে যে, ১০ শতাংশ কৃষক তাদের ফসল তুলতে পারেনি। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে ২০২০ সালের শুরুর দিকে শিল্পের উৎপাদন সূচক নীচের দিকে নামতে থাকে।

কোভিড-১৯ মহামারীর ভয়াবহ স্মৃতি এখনও টাটকা। 'কোয়ারেন্টাইন', 'লকডাউন' শব্দগুলির সঙ্গে বেশিরভাগ ভারতীয়রাই সেই প্রথম পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন ২০২০ সালে কোভিডের সময়। বর্তমানে কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও, সুস্থ হওয়ার পর কোভিডের নানারকম উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। গবেষণা থেকে জানতে পারা যায়, কোভিড-১৯ আসলে কোনো সাময়িক সংক্রমণ নয়। সুস্থ হয়ে ওঠার দীর্ঘদিন পরেও কোভিড-১৯-এর প্রভাব শরীরে থাকতে পারে। ডাক্তাররা একেই বলছেন: লং কোভিড।

করোনা ভাইরাস মানুষের শরীরকে বিধ্বস্ত করার পাশাপাশি সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতেও গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছিল। কয়েক বছর পেরিয়ে, এখনও অনেকই করোনা-সময়ের সেই ভেঙে-পড়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। এ-কথা ঠিক যে, লকডাউনের আগে থেকেই ক্রমাগত সংকুচিত হতে শুরু করেছিল ভারতের অর্থনীতি। তার ওপরে, কোভিড-১৯ অতিমারী এসেছিল 'মরার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে। বর্তমানে ভারতবর্ষের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৮১.৬৮ ট্রিলিয়ন (ভারতীয় মুদ্রায়), যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় ঋণ-ই রয়েছে। যদিও অনেকেই মনে করছেন, ভারতের অর্থনীতির ক্রমশ উত্থানই ঘটছে! ২০২৫ সালেই, বিশ্বঅর্থনীতিতে চতুর্থ স্থানে পৌঁছেছে ভারত। ২০২৪-'২৫-এ ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬.৫ শতাংশ। ২০২৫-'২৬-এ জিডিপিকে ৬.৩ থেকে ৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধি করাই এখন ভারতের লক্ষ্য। পিআইবি-র মতে, শীঘ্রই বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠবে ভারত। এইসব ধারণার পাশে, প্রায়ই দেখা দিচ্ছে একটি প্রশ্ন, তা হল, দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি আদৌ কি হয়েছে? করোনা-র সময় সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন অসংগঠিত খাতের কর্মীরা। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল সারা দেশজুড়েই। ২০২৫ সালে পৌঁছে সেই সমস্যা এখনও মিটেছে কি? 

Unemployment Rate

বর্তমানে ভারতের বেকারত্বের হার রেখচিত্রে

পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (PLFS)-র সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ২০২৫ সালের মে মাসে বেকারত্বের হার বেড়ে ৫.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, এপ্রিলে ছিল যা ৫.১ শতাংশ। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সব থেকে বেশি, যা যথেষ্ট চিন্তাজনক। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ-দেশের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে বেকারত্বের হার এপ্রিলে ১২.৩ শতাংশ থেকে মে মাসে বেড়ে ১৩.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শহরাঞ্চলে মে মাসে বেকারত্বের ১৭.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, এপ্রিল মাসে যা ছিল ১৭.২ শতাংশ। এই পরিসংখ্যানগুলির মধ্যে দেখা যাচ্ছে পুরুষদের থেকে মহিলাদের বেকারত্বের হার সামান্য হলেও বেশি (পুরুষ ৫.৬%, মহিলা ৫.৮%)।

আরও পড়ুন- কোভিড টিকা আদৌ নিরাপদ? কী বলছে আইসিএমআর এবং এনসিডিসি?

২০২০ সালের মার্চ মাসে, ভারতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়ার পর দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। এই সময়কালে ভারতীয়রা কেবল চাকরিই হারাননি, তাঁদের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CIME) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ভারতে বেকারত্বের হার ২০২০ সালের মে মাসে ছিল ২১.৭ শতাংশ। কিন্তু লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অর্থনীতি পুনরায় ঠিক হতে শুরু করেছিল। ২০২১ সালের মে মাসে বেকারত্বের হার হ্রাস পেয়ে হয়েছিল ১১.৮ শতাংশ। পিএলএফএস-এর তথ্যানুসারে, ২০১৯-'২০ সালে গ্রামীণভারতে বেকারত্বের হার ৪ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে ২০২০-২১-এ ৩.৩ শতাংশে নেমে আসে। এবং শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়ায় ৬.৭ শতাংশে।

Unemployment Graph During Covid Pandemic

করোনাকালে ভারতের বেকারত্ব রেখচিত্রে

 

১৯৪৭ সালের পর ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বার্ষিক গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ ছিল। ১৯৮০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৬ শতাংশে। ১৯৯১ সালে ভারত অর্থনীতিতে উদারীকরণনীতি গ্রহণ করেছিল, এই অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রথম দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সামান্য বেড়ে ৬.১ শতাংশ হয়। কিন্তু সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-'১২ সালের পর জিভিএ ২০১৬-'১৭ অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে, তবে ২০১৬-'১৭ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জিভিএ বৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে শুরু করে।

২০১৬-'১৭ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৯.৩ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯-'২০ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ৩.৫ শতাংশ এবং ২০১৯-'২০ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে ৩ শতাংশে নেমে আসে। এই পতনের একটি সম্ভাব্য কারণ, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, যা মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই অর্থনীতির প্রায় ৮৬ শতাংশ নগদ অর্থ শুষে নেয়। 

আরও পড়ুন- ভয় দেখাচ্ছে ঘাতক ‘লং কোভিড’! কেন এই হানাদারি, কী ভাবে মুক্তি…

২০২০ সালের মার্চ মাসে FICCI-এর এক জরিপ অনুসারে, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে লকডাউনের সময় ৫৩ শতাংশ ভারতীয় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২১ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেন। তার এক মাসের মধ্যে ভারতের বেকারত্বের হার প্রায় ১৯% থেকে বেড়ে ২৬% হয়ে যায়। লকডাউন-কালে প্রায় ১৪ কোটি ভারতীয় চাকরি হারিয়েছিলেন। বহু সংস্থাই টিকে থাকতে তখন কর্মীদের বেতন কমিয়ে দেয়। ৪৫ শতাংশেরও বেশি পরিবারের আয় মহামারীর আগের বছরের তুলনায় কমে গিয়েছিল। সে-সময়, কর আদায় কম হওয়ার কারণে সরকারি রাজস্বও হ্রাস পায়। কিছু রাজ্য, কর্মীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছিল। অনুমান করা হয়, প্রথম ২১ দিনের লকডাউনের ফলে ভারতের ১৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছিল।

Indian Economy Graph

করোনাকালে ভারতের অর্থনীতির রেখচিত্রে

মহামারী ও লকডাউন, ভারতের কৃষিক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ২০২০ সালের মে মাসে একটি সরকারি জরিপে দেখা গেছে যে, ১০ শতাংশ কৃষক তাদের ফসল তুলতে পারেনি। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে ২০২০ সালের শুরুর দিকে শিল্পের উৎপাদন সূচক নীচের দিকে নামতে থাকে। টাটা মোটরস, ভারত ফোর্জ, লারসেন অ্যান্ড টুব্রো এবং গ্রাসিম ইন্ডাস্ট্রিজের মতো সংস্থাগুলি তাদের কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। আইটিসি, ডাবর, এইচইউএল-এর মতো ভোক্তা কোম্পানিগুলি প্রয়োজনীয় উৎপাদন বাদে কারখানাগুলি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। অতিমারী পরবর্তী সময়ে, ২০২২ সালে ভারতে পন্য রপ্তানি ও আমদানি আবার আগের মতো করে শুরু হয়। সরকারি সংস্কারের ফলে, শিল্পক্ষেত্রেও একই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ কমে যাওয়ায়, ২০২৩ সালে ফের তার গতি ধীর হয়ে যায়। 

যদিও অর্থনৈতিক অবনতি ভারতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারণ, করোনা অতিমারী পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির মতো বিষয়গুলি ঢাকতে ধর্মের আবেগকে অস্ত্র করে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিল শাসকদল বিজেপি। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের ব্যাপক বিজ্ঞাপন করা হয়েছিল দেশজুড়ে। এ-কথা ঠিক যে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি গেরুয়াশিবির, কিন্তু তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে আসীন হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী-ই।

সূত্র - পিআইবি, উইকিপিডিয়া, ক্লিয়ারট্যাক্স.ইন

More Articles