কী ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী?
National Emergency : এই জরুরি অবস্থা ২১ মাস ধরে চলে, ১৯৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। এই সময়ে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, বিরোধী নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং নির্বাচন স্থগিত হয়।
১৯৭৫ সালের ১২ জুন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন। এই রায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ১৯৭১ সালের লোকসভা নির্বাচন বাতিল করা হয়। এই ঘটনা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা পরবর্তীতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পথ প্রশস্ত করে।
ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলি কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, সমাজবাদী নেতা রাজ নারায়ণ, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা করেন। তিনি দাবি করেন, ইন্দিরা সরকারি সম্পদ ও কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে নির্বাচনে সুবিধা নিয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট যশপাল কাপুর সরকারি কর্মচারী ছিলেন এবং তিনি পদত্যাগের আগেই নির্বাচনী কাজে অংশ নেন। এছাড়া, সরকারি বিদ্যুৎ ও পুলিশ ব্যবহারের অভিযোগও ওঠে। বিচারপতি সিনহা এই অভিযোগগুলো তদন্ত করে ইন্দিরাকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাঁর নির্বাচন বাতিল করেন। তিনি ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে নিষিদ্ধ হন।
এই রায় ঘোষণার সময় এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২৪ নম্বর কোর্টরুমে উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। ইন্দিরার পক্ষে উকিল এস সি খারে এবং রাজ নারায়ণের পক্ষে শান্তি ভূষণ ও আর সি শ্রীবাস্তব সওয়াল করেন। ইন্দিরা নিজে ১৯৭৫ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চ কোর্টে হাজির হন। কোর্টরুমে উপস্থিত ছিলেন বিরোধী নেতা মধু লিমায়ে, শ্যাম নন্দন মিশ্র এবং রবি রায়ের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ইন্দিরার পুত্র রাজীব গান্ধী ও পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীও উপস্থিত ছিলেন।
রায় ঘোষণার পর ইন্দিরার উকিলরা ২০ দিনের জন্য রায় স্থগিত রাখার আবেদন করেন। বিচারপতি সিনহা এই আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু ইন্দিরা এই রায় মেনে নেননি। তিনি এই পরাজয়কে দেশের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে দেখাতে শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন রাতে, রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের মাধ্যমে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এই জরুরি অবস্থা ২১ মাস ধরে চলে, ১৯৭৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। এই সময়ে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, বিরোধী নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয় এবং নির্বাচন স্থগিত হয়।
ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় বাতিল করে। এর আগে, ১৯৭৫ সালের আগস্টে, সংসদ ৩৯তম সংবিধান সংশোধনী পাস করে, যা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে বিচার পর্যালোচনার বাইরে রাখে। সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনী বাতিল করেছিল ঠিকই, তবু জরুরি অবস্থার প্রভাব ভারতের গণতন্ত্রে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
বিচারপতি সিনহার এই রায় ভারতের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন, এই বার্তা যায় দেশবাসীর কাছে। জরুরি অবস্থার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী এই রায়ের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করেছিলে। ফল ইন্দিরার পক্ষে যায়নি। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা উঠে গেলে নির্বাচন হয় এবং ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা হারান। এই ঘটনা ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।