আহত ঘাস কীভাবে বিপদ থেকে বাঁচায় অন্যান্য গাছেদের?

Grass Protects other Plants: গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের দেহের কোনও অংশে কেটে গেলে যেমন রক্ত ঝরতে থাকে, ঘাসের পাতাও ক্ষতিগ্রস্ত হলে ‘লাইনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ‘লিনোলিয়েক অ্যাসিড’ নির্গত হয়।

‘ঘাস’ বলামাত্র কী মনে পড়ে আমাদের? সবুজে-ভরা এক ধরনের শান্ত নিরীহ গাছ, যে সামান্য একটু মাটি পেলেই জন্ম নেয়। বিন্দু মাত্র যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে। এ কারণেই হয়তো এক টুকরো জমি থেকে রাস্তার ধার, কিংবা ফাঁকা মাঠ, জঙ্গল— সর্বত্রই বিভিন্ন রকমের ঘাস, এই শহরায়নের যুগে এখনও দুর্লভ হয়ে যায়নি।

চারপাশে নিত্যদিন দেখতে পাওয়া এই ঘাসের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রাণী সমাজের একটা আশ্চর্য মিল রয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের দেহের কোনও অংশে কেটে গেলে যেমন রক্ত ঝরতে থাকে, তেমনই একটি ঘাসের পাতাও ক্ষতিগ্রস্ত হলে ‘লাইনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ‘লিনোলিয়েক অ্যাসিড’ নির্গত হয়। আসলে, যখনই ঘাস কাটা হয় বা ঘাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঘাসে উপস্থিত ‘লাইপক্সিজিনেজ’ নামক এক প্রকার উৎসেচক ঘাসের কিছু কোষের কোষপর্দায় রাসায়নিক ভাঙন ঘটাতে শুরু করে।

আরও পড়ুন-

রূপান্তরকামী হয় গাছও! প্রতি ঋতুতে কীভাবে লিঙ্গ বদলায় আখরোট গাছ?

প্রসঙ্গত জানাই, ঘাসের কোষপর্দার গঠন প্রক্রিয়া নির্ভর করে আছে কতগুলি জৈব যৌগিক পদার্থের ওপরে। ফসফোলিপিড, প্রোটিন, কোলেস্টেরল, কার্বোহাইড্রেট—- এর মধ্যে অন্যতম! যখনই ঘাস উপড়ে ফেলা হয় বা, ঘাসকে মাড়িয়ে চলে যায় কেউ, কোনও-না-কোনও ভাবে আহত হওয়া মাত্রই, ঘাসের সেই কোষপর্দা রাসায়নিক ভাবে ভেঙে পড়ে। এবং এর ফলে ‘লাইনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ‘লিনোলিয়েক অ্যাসিড’ উৎপন্ন হয়। শুধু তাই নয়, ‘লাইনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ‘লিনোলিয়েক অ্যাসিড’ ঘাস থেকে নির্গত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়াপর্ব শুরু করে দেয়। অক্সিজেনের সংস্পর্শে ‘লাইনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ‘লিনোলিয়েক অ্যাসিড’ বিক্রিয়া করে ‘সিস্-৩-হেক্সেনাল’ নামক এক অস্থায়ী জৈব যৌগিক পদার্থ উৎপাদন করে।

জনজীবনে পরিচিত ঘাস

এই জৈব যৌগিক পদার্থের এক বিশেষ গন্ধ আছে। যে-গন্ধের সঙ্গে কম-বেশি সকলেই পরিচিত। ঘাস কাটার পর, এই বিশেষ গন্ধটিই আমাদের নাকে আসে। এই জৈব যৌগিক পদার্থটি খুবই সামান্য পরিমাণে উৎপন্ন হলেও, মানুষের ঘ্রাণইন্দ্রিয়ে তার বিশেষ গন্ধটি ধরা পড়ে।

এখানে একটি তারতম্যের উল্লেখ করা জরুরি। পরীক্ষালব্ধ ফলাফল বলছে, উজ্জ্বল সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ঘাস কাটা হলে এই জৈব যৌগিক পদার্থটির উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়! তবে এই জৈব পদার্থ অস্থায়ী বলে ওই বিশেষ ঘাস কাটার গন্ধটিও বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। আবার এই গন্ধ বিভিন্ন পাখি ও কীটদেরও আকর্ষণ করে, যাদের জীবনখাদ্য হল ঘাসে বসবাসকারী বিভিন্ন উদ্ভিদভুক পোকা। ফলে, কোনও উদ্ভিদভুক কীট, কোনও ঘাসে কামড় বসালেও সেই ঘাস থেকে উৎপন্ন হওয়া বিশেষ গন্ধ সেই ঘাসকে আত্মরক্ষায় সাহায্য তো করেই, এমনকী অন্যান্য ঘাস ও উদ্ভিদেও কামড় বসাতে সেই উদ্ভিদভুক পোকাকে বাধা দেয়! 

আরও পড়ুন-

প্লাস্টিক, ডিজে, গাছ কাটা — সোনাঝুরি হাটের যে কুৎসিত দশা চোখে দেখা যায় না

আগেই বলেছি যে, 'সিস্--হেক্সেনাল' পদার্থটি অস্থায়ী, তাই উৎপন্ন হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটি বিশ্লিষ্ট হয়ে ‘সিস্-৩-হেক্সেনল’ ও ‘ট্রান্স-২-হেক্সেনাল’ নামক দু-রকম পদার্থ উৎপন্ন করে। উল্লেখ্য যে, ‘সিস্-৩-হেক্সেনল’ হল অ্যালকোহল জাতীয় এক রকম জৈব পদার্থ এবং ‘ট্রান্স-২- হেক্সেনাল’ হল অ্যালডিহাইড জাতীয় জৈব পদার্থ। ‘সিস্-৩-হেক্সেনল’ পদার্থটি উৎপন্ন হয়ে ঘাসের ক্ষতকে মেরামত করে, আবার ‘ট্রান্স-২- হেক্সেনাল’ পদার্থটি উদ্বায়ী বলে উৎপন্ন হওয়ার পরেই তা বাষ্পে পরিণত হয় এবং বাতাসে ছড়িয়ে যায়।

বিভিন্ন ধরনের ঘাস

আহত ঘাস থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া এই ‘ট্রান্স-২- হেক্সেনাল’ পদার্থটি অন্যান্য সকল ঘাস ও উদ্ভিদকে আসন্ন আক্রমণের সংকেত পাঠায়। কারণ ‘ট্রান্স-২-হেক্সেনাল’ পদার্থটি অন্যান্য ঘাস ও উদ্ভিদের কোষের কোষপর্দার স্বাভাবিক তড়িৎ বিভবকে কিছুটা বাড়িয়ে দেয়। এ যেন এক ভীতির শিহরণ! একটি ঘাস আহত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই সেই আহত তড়িৎসংবাদ সকল ঘাস ও উদ্ভিদের শরীরে খেলে যায়!

প্রকৃতির মধ্যে বসবাসকারী এমন বিশেষ কিছু বুদ্ধিমান উদ্ভিদ আছে যাদের শরীরে এই শিহরন খেলে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তারা তাদের পাতার রাসায়নিক গঠন খুব তাড়াতাড়ি বদলে ফেলে, যাতে সেই পাতার স্বাদ, গন্ধ মানুষ ও উদ্ভিদভুক পোকাদের পছন্দ না হয়! এর ফলে, সেই বিশেষ উদ্ভিদেরা মানুষ ও উদ্ভিদভুক পোকাদের আসন্ন আক্রমণ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষা পায়। আত্মরক্ষার এই তৎক্ষণাৎ আয়োজন খুবই আশ্চর্যময় হলেও, স্বীকার করতেই হয় যে সেই আয়োজনেও ছোট ছোট ঘাসেদের ভূমিকাই সব চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ!

More Articles