গুরু পূর্ণিমার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গৌতম বুদ্ধ, বেদব্যাস, শিব ও সপ্তর্ষিমণ্ডল!
Guru Purnima: ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকেই গুরুবাদের এক বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। ‘গুরু পূর্ণিমা’ দিনটিতে সেই ঐতিহ্যকেই শ্রদ্ধাসহ উদাযপন করা হয়। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় এই উৎসব।
গুরু কৃপাহি কেবলম। কিন্তু কেন? ‘গুরু’ শব্দটিকে ভাগ করলে পাওয়া যায় – ‘গু’ আর ‘রু’। ‘গু’ অর্থে অজ্ঞানের অন্ধকার, যার মধ্যে জীবজগৎ নিমজ্জমান। আর ‘রু’ অর্থে জ্ঞানের আলো, যা আমাদের অজ্ঞানের জগৎ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় আলোর দিকে। অর্থাৎ গুরু হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ভেতরের অজ্ঞানের অন্ধকার নাশ করে আমাদের এগিয়ে দেন আলকময় জীবনের পথে।
গুরু যে কেবল ধর্মগুরুই হবেন, তা কিন্তু নয়। জীবনের যে-কোনো পথে চলতে গেলেই প্রয়োজন হয় একজন পথপ্রদর্শক বা গাইডের, যিনি আগে থেকেই সেই পথ সম্পর্কে বিশদভাবে জানেন এবং আমাদের চিনিয়ে দেন। যেমন শিক্ষাসত্রে, শিক্ষক। আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের ক্ষেত্রে ধর্মীয় গুরু। আর, জীবনে চলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা। ‘গুরু’ হতে পারেন যে-কোনো সাধারণ মানুষও। যাঁদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা, আমাদের জীবনে কোনও-না-কোনওভাবে দাগ রেখে গেছে, তাঁরা সকলেই গুরুপদবাচ্য।
আরও পড়ুন-
বৌদ্ধ ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে গুপ্তচর! অবাক করবে এই বাঙালির রহস্যময় জীবন
ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রাচীনকাল থেকেই গুরুবাদের এক বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। ‘গুরু পূর্ণিমা’ দিনটিতে সেই ঐতিহ্যকেই শ্রদ্ধাসহ উদাযপন করা হয়। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় এই উৎসব। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মে গুরু পূর্ণিমার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। হিন্দু ধর্মমতে, দেবাদিদেব মহাদেব এই তিথিতে দক্ষিণামূর্তি রূপ ধারণ করে ব্রহ্মার চার মানসপুত্রকে বেদের গুহ্য পরমজ্ঞান দান করেছিলেন এবং এরপরমহাদেব হয়ে ওঠেন সকলের আদি গুরু। তাই এই তিথিটি দেবাদিদেব মহাদেবের প্রতি সমর্পিত।

রামনগরের ব্যাস মন্দির
অন্য একটি কাহিনি-মতে, শিব হিমালয়ে যোগী হিসেবে বাস করতেন। অনেক সাধক তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানলাভের আশায় এলেও বেশিরভাগই তাঁকে তুষ্ট করতে পারেননি। অজস্র সাধকের মধ্যে সাতজন ছাড়া বাকি সবাই চলে যান। সেই সাতজন ঋষি দশকের পর দশক ধরে শিবের তপস্যা করতে থাকেন। তারপর, এই গুরু পূর্ণিমার দিনে, মহাদেব তাঁদেরকে নিজের দৈব্য জ্ঞান প্রদান করেন। এবং ওই সাতজন সাধকই হয়ে ওঠেন আকাশের সপ্তর্ষিমণ্ডলী। জানা যায়, এই দিনটি থেকেই গুরু পূর্ণিমার উৎপত্তি।
গুরু পূর্ণিমার দিনেই, পরাশর মুনির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘মহাভারত’ রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস। এজন্য এই দিনটিকে ব্যাস পূর্ণিমাও বলা হয়। বেদব্যাস বেদ সংকলন করে, তাকে চার ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ভাগগুলিল— ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ। এরপরই, একজন আদর্শ গুরু-র মান্যতা পেয়েছিলেন বেদব্যাস। তাই, তাঁর জন্ম তিথিকেও গুরু পূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হয়।
আরও পড়ুন-
শকুন্তলা মানেই, নরম, স্নিগ্ধ, কোমলমতি? অবাক করবে ‘আসল’ শকুন্তলার কাহিনি
বৌদ্ধধর্মেও গুরু পূর্ণিমার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন যে, আষাঢ় পূর্ণিমার এই দিনে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের কাছে প্রথম ধর্মোপদেশ দিয়েছিলেন। নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষের নীচে বোধি লাভ করার পাঁচ সপ্তাহ পরে বুদ্ধ সেখান থেকে মৃগদাব চলে যান, যে-স্থানটি বর্তমানে সারনাথ নামে পরিচিত, সেখানে তিনি তাঁর পাঁচ পুরনো সঙ্গিকে প্রথম উপদেশবাণী প্রদান করেন। সেই পাঁচ পুরনো সঙ্গি ‘পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু’ নামে পরিচিত। জৈন ধর্মাবলম্বীরা ২৪ তম তীর্থঙ্কর এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ভগবান মহাবীরকে শ্রদ্ধা জানাতে গুরু পূর্ণিমা পালন করে থাকেন। মহাবীর এই দিনে গৌতম স্বামীকে তাঁর প্রথম শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘটনাটি জৈন ঐতিহ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের সূচনা করে, যা আধ্যাত্মিক জ্ঞান-প্রেরণার প্রতীক।

কাঠমান্ডুর লিঙ্গভৈরবী মন্দির
এই দিনে বৌদ্ধরা ‘উপোসথ’ নামক একটি অনুশীলনের মাধ্যমে বুদ্ধের আটটি মূল শিক্ষা এবং সন্ন্যাস শৃঙ্খলার নিয়মগুলিকে অনুশীলন করে থাকেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যান এবং কঠোর শৃঙ্খলার একটি সময় শুরু করেন, যা ‘ভাস’ নামে পরিচিত এক সন্ন্যাসত্যাগের রীতি। অনেকেই এই দিনে উপবাস, দান, আধ্যাত্মিক দীক্ষা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করেন। বেশ কিছু বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হয়। কেউ-কেউ নিজেদের গুরু এবং গণেশের প্রতি উৎসর্গীকৃত পূজা করে তথাকে। যাঁদের আধ্যাত্মিক গুরু রয়েছেন, তাঁরা কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য গুরুর কাছে ফল, ফুল এবং মিষ্টির মতো নৈবেদ্য প্রদান করেন। নেপালে, শিক্ষকদের স্বীকৃতির জন্য স্কুল এবং কলেজগুলিতে এই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। শিক্ষার্থীরা উপাদেয় খাবার, মালা এবং দেশীয় কাপড় দিয়ে তৈরি এক বিশেষ টুপি (নেপালি ভাষায় টপি) দিয়ে শিক্ষকদের সম্মান জানায়। এ-দেশেও অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সম্মান জানিয়ে এই দিনটি উদযাপন করে থাকে। অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও (বিশেষত গুরুকুল) এই দিনটি পালন করা হয়। এই দিন বিভিন্ন মন্দিরেও গুরু পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশেষ পূজার প্রচলন আছে। বারাণসীর রামনগরে ব্যাস মন্দিরে এ-দিন ব্যাসদেবের পূজা হয়। আজকের দিনেই, ঝাড়খণ্ডের গিরিভহ জেলায় পরশনাথ পাহাড়ের উপর শিখরজি জৈন মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশেষ পূজার। কাঠমান্ডুর লিঙ্গ ভৈরবী মন্দিরেও এই দিনটি বিশেষভাবে পালন করা হয়। বহু বছর ধরেই, পশ্চিমবঙ্গের রামকৃষ্ণ মিশনের মঠগুলিতেও গুরু পূর্ণিমা উদযাপিত হয়ে আসছে।
জীবনে চলার পথে গুরুর ভূমিকা অপরিসীম। মহাভারত-এর যুদ্ধে অর্জুনের পরম মিত্র ও গুরু শ্রীকৃষ্ণমধুসূদন তাঁকে বলেছিলেন:
‘তদ্ বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ’
এর অর্থ, গুরুর শরণাগত হয়ে জ্ঞান লাভের চেষ্টা করা, বিনম্র চিত্তে তাঁকে প্রশ্ন করা এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করা, তা হলে সেই তত্ত্বদ্রষ্টা গুরু, জ্ঞান উপদেশ প্রদান করবেন। ভারতের এই প্রাচীন কাব্যের চিন্তাকে সামনে রেখে এ-কথা বলাই যে, এই সমস্ত কিছুই আসলে জীবনে জ্ঞানপ্রাপ্তির নিমগ্ন আয়োজন। কারণ জ্ঞানের আলোকচিত্র আকাশের পূর্ণিমার সমার্থক!