ক্রমে জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সাধের শান্তিনিকেতন
Shantiniketan: জঙ্গল সাবাড় হচ্ছে, দখলদারিত্বে নদীপথের নাব্যতা হারাচ্ছে। আমাদের ছোট নদী কোপাই হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা বেবাক দেখে যাচ্ছি।
ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ চিরকালই আপেক্ষিক। যেভাবে ভালো লাগা, না লাগা। এর পেছনে তেমন কোনও সুনির্দিষ্ট যুক্তি হয়তো নেই। বৈদ্যুতিক আলো সাদা ভালো না হলুদ, চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্না না কয়েক হাজার কিলো ফ্লাডলাইটের অনুকৃতি, তা নিয়ে ভাগাভাগি আছে। কোথাও কোথাও আমাদের দৈনন্দিনের অভ্যাস হয়তো এই পছন্দ-অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। হয়তো সবার মতো আমারও আছে ভালো লাগা না লাগা। কিন্তু বিষয়টা ঘোরতর ভাবে আছে।
স্মৃতিতে আছে, যা কিছু না হলেও সাড়ে চার দশক আগের শান্তিনিকেতনের পারিপার্শ্ব, যেখানে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার ছিল। কোথাও জোনাকি তো কখনও চাঁদের হাসি। যেখানে সময় আর ঘড়ির আড়ালে মুখ লুকোতে পারেনি। রাতবিরেতের কথাই লিখছি। কোনও অনুষ্ঠান শেষে দীর্ঘ পথ হেঁটেছি মধ্যরাতে ছোট টর্চের আলোয়। কোথাও টিমটিমে স্ট্রিট লাইট, তাও সীমিত রাস্তায়। সে ছিল গ্রাম দিয়ে জড়ানো শান্তিনিকেতন। সেসব অধিকাংশ গ্রাম আজ মুছে গেছে, সে আর গ্রাম নেই। এখন তা পাড়ায় উন্নীত হয়েছে। যদিও তারপরেও গ্রামই রয়ে গেছে। আরেকটু প্রান্তিক হয়েছে কোথাও, কোথাও নগরায়নের ধাক্কায় তার চরিত্রটাই বদলে গেছে। আদতে যেটা ছিল প্রথম থেকেই শান্তিনিকেতনের মুখ্য গ্রামীণ পরিকল্পনা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিযুক্তির লম্বা আখ্যান তৈরি হয়েছে বছরে বছরে। তার মানে একথা বলছি না যে, দাও ফিরে সে অরণ্য বা অন্ধকারে রাত্রি লেপে যাক। নগরায়ন অবশ্যম্ভাবী। তাকে আটকানো যাবে না।
তার মানে আবার এও নয় যে, জঙ্গল সাফ করে নিয়নশোভিত গ্রাম মন্দ জীবনের আহ্লাদে ডুবে যাবে। প্রত্যন্ত গ্রামে বিদ্যুত থাকবে, পরিশ্রুত জল থাকবে। থাকবে একটা যথাযথ সামঞ্জস্যপূর্ণ আবস্থান। যাতে গ্রামের ঐতিহ্য, গ্রামের সংস্কৃতি নষ্ট না হয়ে যায়। তার বদলে এখন সম্পূর্ণত বদলে যাওয়া সঙ্কটাপন্ন এক মারাত্মক ছবি। ঠিক এইখান থেকেই স্মরণ করব একশো বছর পিছিয়ে সেই ইতিহাসকে, যেখানে শ্রীনিকেতনের পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে গ্রামীণ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে।
আরও পড়ুন- উইক এন্ড ট্যুর আর সস্তার হস্তশিল্প : যেভাবে বাঁচে সাধের সোনাঝুরি…
মাঝে মধ্যেই মনে হয় সেই কথাটা। কোনও একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ইতিহাস কি শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের নিবন্ধন? আজকের শান্তিনিকেতন সন্নিহিত গ্রামসমূহ দেখে তাকেই যেন সত্যি মনে হয়। ১৯২২ সালে সুরুলে একটি কৃষি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার দু'বছর পর অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে গ্রামের উন্নয়ন উপযোগী করে শিক্ষাসত্র বিদ্যালয় তৈরি হয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনা ১২ জন ছাত্রকে এই সময় কিছুটা জমিও দেওয়া হয় যাতে ছাত্ররা গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শিক্ষাকে মিলিয়ে কিছু শিখতে পারে। এটা ছিল বিরাট এক পরিকল্পনার অঙ্গ। প্রাথমিকভাবে লেনার্ড এলমহার্স্ট তাঁর সহযোগীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ অনুযায়ী সুরুল, বল্লভপুর ও তৎসন্নিহিত গ্রামগুলি ঘুরে দেখেন।
এরপর ১৯২৬ নাগাদ প্রকল্পের বিস্তার ঘটাতে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনের অন্যতম স্থপতি ও শিক্ষক কালীমোহন ঘোষকে নিযুক্ত করেন এই গ্রামগুলিকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করার জন্য। সেখানে প্রাধান্য পায় বল্লভপুর গ্রাম ও সংলগ্ন বনভূমি। তা নিয়ে কালীমোহন ঘোষের লিখিত একটি প্রতিবেদনও আছে। আজ প্রায় শতাধিক বছর পরও সেই গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামোর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং তা আরও খারাপ হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বীরভূমের লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকে মানুষ এসে এখানে বাসা বেঁধেছে। কালীমোহন ঘোষের প্রতিবেদনে যে কিছু ঘর তাঁতিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের তাঁত গেছে। এখন তাদের বংশধরেরা মামুলি চাষাবাদ করে বা পরের জমিতে জন খাটে।
এখানকার আদিবাসী তথা কৌমসমাজের মানুষ মূলত কৃষিকাজেই জীবন অতিবাহিত করত। আজ আর তাদের হাতে জমি নেই। জমির হস্তান্তর ঘটেছে ভয়ঙ্কর ভাবে।
তা সেই জমি-জায়গা গেল কোথায়? একটা সময় পর্যন্ত আশেপাশের ছোট জমিদার আর ধনী চাষিরা এদের চড়া সুদে ঋণ দিয়েছে আর ঋণের টাকা শোধ দিতে পারেনি বলে এদের জমি বাজেয়াপ্ত করেছে। এরপর সময়ের নিয়মেই চলে এসেছে প্রোমোটারকুল। কোনওরকম নিয়মকানুন মানেনি তারা। অত্যন্ত সস্তায় আদিবাসীদের জমি হাতিয়েছে ওই একইভাবে, হয় ঋণ দিয়ে নয়তো নেশার পয়সা জুগিয়ে।এদিকে সরকার নিয়ম করেছে যে, কোনও আদিবাসী জমি নেওয়া যাবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! লিজ নামক এক পেছনের রাস্তা দিয়ে জমি লুট হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী ও প্রান্তিক চাষিরা ক্রমে নিঃস্ব হচ্ছে। গ্রামের জোয়ান ছেলেরা দলে দলে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে মুটে মজুরের কাজ করতে ট্রেন ধরছে আর মেয়েরা শহরে যাচ্ছে বাবুর বাড়িতে কাজ করতে। এছাড়া তাদের আর উপায় কী! যে সামান্য চাষের জমি আছে, যা প্রকৃতপক্ষে এদেরই বাপ-ঠাকুরদার জমি, সেখানেই হয়তো কেউ কেউ ভাগ চাষ করছে।
এই জমিহারাদের নিয়ে আরও লিখব পরবর্তী পর্বে। আপাতত ফিরে তাকাই শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের গ্রামীণ প্রকল্পের দিকে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল, বেশ কিছু দশক চলার পর তার ধার ও ভার কমতে থাকে। বিশেষত রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী ছাড়ার পর এই প্রকল্পের অধোগতিকে আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায় বিশ্বভারতী। সেই সূত্রে নানা খাতে নানা তহবিলে টাকা আসে। আসে এবং খরচও হয়। অথচ গ্রামীণ প্রকল্পের শোচনীয় অবস্থা। যা দিয়ে শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা আর মনে রাখা হলো না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষিকাজ, হস্তশিল্প ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি করার কথা এলমহার্স্ট সাহেব ও কালীমোহন বাবুরা রবীন্দ্রদীক্ষিত পথে চিহ্নিত করেছিলেন তার কী হলো?
শুরুতে সেই ১২ জন ছাত্রের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওজন এখন বেড়েছে। তার ছাত্রসংখ্যা ও বহর বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু খোদ বিশ্বভারতীর পঠনপাঠন ও প্রকল্পের বেহাল অবস্থা! সারা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর অধঃনমনকে রোখা যায়নি। ইদানিংকালের অবস্থা তো আরও খারাপ। এক একজন উপাচার্য নিজেদের খামখেয়ালে বিশ্বভারতীকে চালানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে বিক্ষোভ বেড়েছে। নানা মামলা-মোকদ্দমায় নাজেহাল বিশ্বভারতী। এখন দীর্ঘদিন হলো স্থায়ী কোনও উপাচার্যই নেই। যাঁরা আসছেন সবাই অস্থায়ী। তবে আপাতত বিশ্বভারতীর কথা থেকে সরে যাব। বরং বিশ্বভারতীকে ঘিরে থাকা গ্রামগুলো নিয়ে আরও দু'চার কথা এখানে লিখে যাই।
আরও পড়ুন-বাবুদের শান্তিনিকেতন আসলে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ
বল্লভপুরে প্রধানত দু'টি গ্রাম। একটি বল্লভপুরডাঙা অপরটি খেলেডাঙা। এই দুটো গ্রামই আদিবাসী অধ্যুষিত। এখানকার প্রাচীন ইতিহাস বলছে, এখান থেকে আদিবাসী বিদ্রোহের সময় নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ হতো। হয়তো এর কোনও পাথুরে ইতিহাস নেই। কিন্তু লোকমুখে সে কাহিনি এখনও বেঁচে আছে। বয়স্করা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছে সেইসব গল্প শুনেছেন। আজ তাঁরাও সংখ্যায় কমে যাচ্ছেন দিন দিন। সেকারণে নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানে না। তাদের এহেন ঐতিহ্য নিয়ে সচেতন করারও কোনও উদ্যোগ সরকারি বা বেসরকারি তরফে নেওয়া হয়নি। মাঝে মধ্যেই ভাবি, ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে কি কোনও জনগোষ্ঠী তার চরিত্র বা সামগ্রিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হবে? যদিও সমাজতাত্ত্বিকরা এর উল্টো দিকটাই লক্ষ্য করছেন। কী হবে না হবে তা ভবিষ্যতই সূচিত করবে। তবু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দিন ক্রমে ঘনিয়ে আসছে।
এখানকার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো আদিবাসী ছেলেমেয়েরা খেলাধুলোয় অত্যন্ত পারদর্শী। বিশেষত ফুটবলে তাদের অসম্ভব উৎসাহ। বীরভূমের নানা প্রান্তে এরা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট জয় করে আসে কোনওরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই। নিজেদের গ্রামেও আয়োজন করে ফুটবল টুর্নামেন্ট কিন্তু লেখাপড়ায় মন নেই। চার-পাঁচ ক্লাস যদি বা কেউ কেউ ইস্কুলে গেল তারপরই অন্তর্হিত হয় (ড্রপআউট)। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখেছি, এখানে যে গুটিকতক স্কুল আছে সেখানে পড়ানো হয় বাংলামাধ্যমে। কোনও সাঁওতাল ভাষা জানা শিক্ষক প্রায় নেই-ই। এরা কম বয়সে বাংলা তেমন জানে না বা শেখে না। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কিন্তু এই দায়িত্ব কার? সরকারের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। এনজিও অধ্যুষিত বীরভূম জেলার কোনও সংস্থাকে এক্ষেত্রে পা ফেলতে দেখা যায়নি।
বিবিধ কারণে নেশা বাড়ছে, চুরি ছ্যাঁচড়ামি বাড়ছে। একটু বয়স বাড়লেই ছেলেরা যাচ্ছে ভিনরাজ্যে রোজগারের আশায়। যারা থেকে যাচ্ছে তারা কিছুজন মজুর খাটছে, যাচ্ছে খাদানে, অবৈধ বালি বা মাটির কারবারে খাটছে, নয়তো আরও অধিক রোজগারের নেশায় জমির দালালি করছে। বলে রাখা ভালো, বোলপুর মহকুমায় এখন জমির থেকে জমির দালালের সংখ্যা প্রায় একশো গুণ বেশি। সেকারণেই জালিয়াতিও বেড়েছে। একটা জমি চারজনকে বিক্রি করার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। তো শান্তিনিকেতন তথা বোলপুর এক ক্রমবর্ধমান জমি জালিয়াতিতে ডুবে যাচ্ছে। কলকাতা শহরের অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত বাবু সম্প্রদায় এখনও 'স্টেটাস'-এর কারণে এখানে বাগানবাড়ি করার জন্য উন্মুখ। জঙ্গল সাবাড় হচ্ছে, দখলদারিত্বে নদীপথের নাব্যতা হারাচ্ছে। আমাদের ছোট নদী কোপাই হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা বেবাক দেখে যাচ্ছি। যেন এর থেকে পরিত্রাণ নেই কোনওমতে।