নীরব মোদি: দেশের ১১ হাজার কোটি লুট করে আজও পলাতক হিরে ব্যবসায়ী
Nirav Modi PNB Scam: পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় বেআইনিভাবে বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হতো, যার দায় পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বহন করত কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঋণ শোধ করা হতো না।
"কিন্তু ব্যাংকের চেয়ে সে তার সোনার কারিগরের উপর বেশি ভরসা রাখে। সে বড় বড় জুয়েলারি শোরুমে যাবে, কিন্তু কেনার পর নিজের সোনার কারিগরের কাছে যাবে, 'জারা চেক করলো ভাই'। যত বড়ই শোরুম হোক, আমাদের মেহুল ভাই এখানে বসে আছেন।"
এটা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণের একটি অংশ। ২০১৫ সালে সোনার উপর নির্ভরতা কমাতে এবং দেশের ঘরে ঘরে থাকা সোনার সঞ্চয়কে কাজে লাগানোর জন্য ঘোষিত সোনার মনিটাইজেশন স্কিমের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মেহুল চোক্সিকে 'মেহুল ভাই' বলে সম্বোধন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিন বছর পরে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের ১৩,৫৭৮ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেলেন মেহুলভাই।
মেহুল চোক্সির গুণধর ভাগ্নে নীরব মোদি। মামাকে অনুসরণ করেই ভাগ্নে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ১১,০০০ কোটি টাকার আর্থিক প্রতারণা করেছেন। মামা-ভাগ্নে জুটির সম্মিলিত প্রতারণার মোট পরিমাণ, তদন্ত সংস্থাগুলোর তথ্য অনুসারে ২৪,৫৭৮ কোটি টাকা। প্রতারণার কৌশল মামা-ভাগ্নের একই, তাই সেই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। ২০১৮ সালে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের অডিটে বিষয়টি ধরা পড়ে এবং তদন্ত শুরু হয়। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (সিবিআই) ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) নীরব মোদির বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্তে তাঁর একাধিক বিদেশি অ্যাকাউন্ট, সম্পত্তি এবং জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়। নীরব মোদি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং পরে ব্রিটেনে আত্মগোপন করেন। ব্রিটেনে ধরা পড়ার পর, ভারত সরকার তাঁর প্রত্যর্পণের জন্য আইনি পদক্ষেপ করে। ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের একটি আদালত সিদ্ধান্ত নেয় যে নীরব মোদিকে ভারতে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। তবে তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন এবং এখনও ভারতে প্রত্যর্পণ হয়নি। এদিকে ভারতের বিভিন্ন আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা, অর্থ পাচার এবং সরকারি সংস্থাকে প্রতারণার মামলাগুলি চলছে।
নীরব মোদির জন্ম ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, গুজরাতের পালানপুরে, এক জৈন ব্যবসায়ী পরিবারে। তাঁর পরিবার বহু প্রজন্ম ধরে হিরে ও রত্ন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ছোটবেলায় তিনি ও তাঁর পরিবার মুম্বাইয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে নীরব মোদি বেলজিয়ামে চলে যান এবং সেখানে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্টন স্কুলে ভর্তি হলেও স্নাতক সম্পূর্ণ করেননি। নীরবের হিরে ব্যবসার হাতেখড়ি হয় মামা মেহুল চোক্সির ‘গীতাঞ্জলি গ্রুপ’-এ কাজ করার মাধ্যমে। সেখান থেকেই তিনি রত্নের বাজার, বিশেষ করে হিরে কাটিং ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি নিজেই ‘ফায়ারস্টার ডায়মন্ড’ নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ধীরে ধীরে নিজের ব্র্যান্ড গড়ে তোলেন। ২০০৮ সালে ‘নীরব মোদি’ নামে বিলাসবহুল গয়নার ব্র্যান্ড চালু করেন। তাঁর ডিজাইন করা গয়না আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত হয়। নিউ ইয়র্ক, হংকং, লন্ডন, বেইজিং-সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহরে তাঁর বুটিক খোলা হয়। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও হাই-প্রোফাইল অনুষ্ঠানগুলোতে তাঁর নাম উঠে আসে এবং তিনি ধনী ও প্রভাবশালী গ্রাহকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
আরও পড়ুন-লোপাট কোটি কোটি টাকা, ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির শিকড় কতটা গভীরে?
ব্যক্তিগত জীবনে, নীরব মোদির স্ত্রী অ্যামি মোদি একজন মার্কিন নাগরিক, যিনি মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত। অ্যামিও হিরে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং নীরবের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতেন। তাঁদের তিনটি সন্তান রয়েছে। কেলেঙ্কারির পরপরই পুরো পরিবার দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যায় এবং একান্ত জীবনযাপন শুরু করে। নীরব মোদি আগে ছিলেন ভারতের ধনীদের একজন, ফোর্বসের ধনী ব্যক্তিদের তালিকাতেও উঠে এসেছিল তাঁর নাম কিন্তু ২০১৮ সালে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর তিনি পলাতক হয়ে পড়েন এবং বর্তমানে তিনি ব্রিটেনে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে ভারত সরকার তাঁকে প্রত্যর্পণ করতে না পারে।

নীরব মোদি, অ্যামি মোদি
নীরব মোদির বিরুদ্ধে সিবিআই ও ইডি — এই দুই কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের করেছে, যা মূলত পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করেই। মোট প্রতারণার পরিমাণ প্রায় ১১,০০০ কোটি টাকা । এটি ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। সিবিআই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম এফআইআর দায়ের করে। মামলার মূল অভিযোগ ছিল, নীরব মোদি ও তাঁর কোম্পানিগুলি— যেমন ফায়ারস্টার ডায়মন্ড, সোলার এক্সপোর্টস ও স্টেলার ডায়মন্ডস —পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় বেআইনিভাবে 'Letter of Undertaking' (LoU) সংগ্রহ করেছিল। এই LoU-র ভিত্তিতে বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হতো, যার দায় পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বহন করত কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঋণ শোধ করা হতো না। নীরব মোদির সঙ্গে এইসব মামলায় নাম আছে তাঁর ভাই নিশাল মোদি, স্ত্রী অ্যামি মোদি, ব্যাংকের একাধিক প্রাক্তন কর্মকর্তা, বিশেষ করে ব্র্যডি হাউস শাখার দুই সিনিয়র কর্মকর্তা গোকুলনাথ শেট্টি ও মনোজ খান্ডারের। এই মামলায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা), ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ (জাল দলিল তৈরি), এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের অধীনে অভিযোগ আনা হয়েছে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) মূলত অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন (পিএমএলএ) অনুযায়ী নীরব মোদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ইডি তদন্তে উঠে আসে, পিএনবি-র প্রতারণামূলক ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে এবং এই অর্থ দিয়ে বহু সম্পত্তি, গয়না, শিল্পকর্ম ও বিলাসবহুল সামগ্রী কেনা হয়েছে।

মামা মেহুল চোক্সি
আরও পড়ুন-লক্ষ কোটি টাকা ফিরল না আজও! নোটবন্দির ছ’বছর পর কী অবস্থা ঋণখেলাপিদের
ইডি নীরব মোদি ও তাঁর কোম্পানির প্রায় ১,৪০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে রয়েছে মুম্বই, দিল্লি ও আলিবাগের রিয়েল এস্টেট, মূল্যবান হিরে ও গয়না, বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, শিল্পকর্ম ও বিলাসবহুল সামগ্রী। এছাড়াও ইডি একটি অতিরিক্ত চার্জশিটে জানায়, নীরব মোদি ১৫-২০টি শেল কোম্পানির মাধ্যমে হংকং, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছেন এবং এসব অর্থ বিভিন্ন অফশোর অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগ করেছেন। ২০১৯ সালে নীরব মোদিকে লন্ডনে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ভারত সরকার ব্রিটেনে তাঁর প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করে। ২০২১ সালে ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট তার প্রত্যর্পণের আদেশ দেয় কিন্তু নীরব মোদি সেই আদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল চলমান থাকায় এখনও তাঁর প্রত্যর্পণ সম্পন্ন হয়নি।
নীরব মোদি ও মেহুল চোক্সি, ভাগ্নে ও মামা একই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ২৪,৫৭৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাগুলি পৃথক, কারণ তাঁরা আলাদা কোম্পানি ও সংস্থা ব্যবহার করেছেন এবং তদন্তের আওতাও ভিন্ন। এই কেলেঙ্কারি কেবল ভারতীয় ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও নজরদারির অভাব, শাসনক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতাদের স্ব-আরোপিত 'অপদার্থতা'-ও তুলে ধরে।