সন্ত্রাসের সুতো আইএসআই-এর হাতে! পাক জঙ্গিদের কীভাবে মদত জোগায় গুপ্তচর সংস্থা?
ISI Terrorism: ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে মহম্মদ আলি জিন্নাহর ছোট বোন ফাতিমা জিন্নাহর উপর আইএসআই গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে। আইএসআই এবং সেনাবাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে এবং ফাতিমা জিন্নাহ নির্বাচনে পরাজিত হন।
পহেলগাঁওয়ের হামলার দায় কাগজে কলমে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF)—এক পাক-সমর্থিত জঙ্গি সংগঠন—স্বীকার করেছে। কিন্তু তারা তো নিমিত্তমাত্র। ইতিহাস এবং বিশ্লেষণ বলে, আদতে এই ধরনের হামলার মূল কলকাঠি নাড়ে পাকিস্তানের প্রধান গুপ্তচর সংস্থা ISI—Inter-Services Intelligence। আইএসআই আসলে পাকিস্তানের এক ছায়ারাজ্য, যার অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণ করে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা নকশা। টিআরএফ, লস্কর, জৈশ, হিজবুল—এরা কেউ স্বতন্ত্র নয়; এরা ছায়া-পুতুল, যার সুতো ধরে রেখেছে রাওয়ালপিন্ডির এই ধূসর ভবনের লোকেরাই।
শুধুমাত্র হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যেই আইএসআই ক্ষান্ত থাকে না। আইএসআই দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে তৈরি করে চলেছে এক জেহাদি শিল্পসভ্যতা—যার জ্বালানি হলো ধর্ম, কূটনীতি, সেনা ও ষড়যন্ত্রের এক মিশ্র দ্রব্য। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতিতে আইএসআই এখন এক বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তানের মাটি থেকে পরিচালিত টিআরএফ, লস্কর, জৈশের মতো সংগঠনগুলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে আইএসআই-এর সঙ্গে, যা গত চার দশকে রূপ নিয়েছে এক পরোক্ষ যুদ্ধনীতিতে। বর্তমান পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এক রক্তাক্ত শাখা। একটি ভারত বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থা জঙ্গি কার্যকলাপে মদত দিয়ে দিয়ে পাকিস্তানে তৈরি করে ফেলেছে এমন বিরাট ছায়াসাম্রাজ্য, যা সরাসরি জর্জরিত করে দিচ্ছে খোদ পাকিস্তানসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে।
পাকিস্তান—জঙ্গি—আইএসআই: এক রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেকার সম্পর্ক এক বহুমাত্রিক জাল, যা দেশটির রাষ্ট্রীয় নীতি, গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) কৌশলগত স্বার্থ এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিস্তৃত। এই সম্পর্ক কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকেই বিপন্ন করেনি, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকেও জটিল করে তুলেছে। আইএসআই এবং পাকিস্তান সেনার সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে পাকিস্তান হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কাছে এক নিরাপদ আশ্রয়। এই অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির জন্য হয়ে উঠেছে এক গভীর সমস্যার কারণ।
আরও পড়ুন- আইএমএফ ঋণের অপব্যবহার: ঋণ নয়, রাষ্ট্রের ছদ্মবেশী যুদ্ধ তহবিল
প্রথম পরাজয় ও আইএসআই-এর জন্ম
১৯৪৭ সাল, ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। স্বাধীনতা ও দেশভাগের মতো দু'টি বড় ঘটনা এই বছরেই ঘটেছিল। নতুন দেশের সীমানা নির্ধারণ, সম্পদ বণ্টন এবং সেনাবাহিনীর বিভাজন নিয়ে জোর আলোচনা চলছিল। বেশিরভাগ বিষয়ের সমাধান হলেও, মেজর জেনারেল ওয়াল্টার জোসেফ কওথর্ন কোন দেশের হয়ে কাজ করবেন সেটা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়।
অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত কওথর্ন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স উইং-এর দায়িত্বে ছিলেন। দেশভাগের পর তিনি কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত হবেন, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় এবং অবশেষে কওথর্ন পাকিস্তানে যোগ দেন। কওথর্ন দেশভাগের সময় পাকিস্তানে আসা সৈন্যদের একটি দলের সঙ্গে ছিলেন এবং সেখানে পৌঁছে তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি পান।
তবে কওথর্ন একা নন, দেশভাগের সময় বহু অমীমাংসিত বিষয়ের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীর ছিল পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান মাথাব্যথার কারণ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার কারণে পাকিস্তান এই রাজ্যের অধিকার দাবি করে, কিন্তু ভারত তা ছাড়তে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি জম্মু ও কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের উপর নির্ভর করে। রাজা হরি সিং ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়া অথবা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন। তবে, রাজা বেশি সময় পাননি। দেশভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মদতপুষ্ট পশতুন উপজাতি যোদ্ধারা জম্মু ও কাশ্মীর দখলের জন্য হামলা চালায়। রাজা হরি সিং ভারতে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরই ভারতীয় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে পিছু হটতে বাধ্য করলে পাকিস্তানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে তারা আন্তর্জাতিক সীমানা র্যাডক্লিফ লাইন অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঘাঁটি স্থাপন করে। ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যেখানে যুদ্ধ থেমেছিল, সেই রেখাটি যুদ্ধবিরতি রেখা (Ceasefire Line) নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিতে সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে এই যুদ্ধবিরতি রেখাটি নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control) নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৭ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের কোনও উন্নত সামরিক অবকাঠামো ছিল না। ফলে তারা বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে থাকা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর উপর নির্ভরশীল ছিল। যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাকিস্তান অনুভব করে যে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি সুসংহত গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজন। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আইবি এবং মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি নতুন গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জেনারেল কওথর্নকে, যিনি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ ছিলেন। কওথর্নের এই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিতে ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ শাহিদ হামিদ তাঁকে সহযোগিতা করেন। কয়েকদিনের চেষ্টায় এই দুই কর্মকর্তা একটি নতুন সংস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন, যার নাম থেকেই বোঝা যায় যে এটি বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান করবে। সংস্থাটির নাম দেওয়া হয় ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (ISI)। এর প্রাথমিক কাজ ছিল অভ্যন্তরীণ নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ এবং কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স অপারেশন পরিচালনা করা। এইভাবেই বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থার জন্ম হয়।
১৯৫০ সালে কওথর্ন আইএসআই-এর কমান্ড গ্রহণ করেন এবং এর কাজের পরিধি বিস্তার করেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক গোয়েন্দা তথ্যের জন্য পৃথক উইং তৈরি করা হয় এবং মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা কাঠামো তৈরি হয়, যা তিনটি প্রধান ফ্রন্টে সক্রিয় থাকার জন্য প্রস্তুত ছিল - ভারত সীমান্ত, আফগানিস্তান সীমান্ত এবং দেশের অভ্যন্তরে চলমান ছোট-বড় আন্দোলন।
আইএসআই-এর রক্তাক্ত উত্থান
আইএসআই তার আসল ক্ষমতা লাভ করে ১৯৫৮ সালে। এই বছর পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার আলি মির্জার সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন এবং নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে আইএসআই-এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যে সংস্থাটি দেশের নিরাপত্তার জন্য তৈরি হয়েছিল, সেটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর স্বার্থে কাজ করতে শুরু করে। জেনারেল আইয়ুব খান তাঁর বিরোধীদের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ভীত ছিলেন। ফলে আইএসআইকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের উপর নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। আইএসআই স্থানীয় সাংবাদিক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর উপরও নজরদারি শুরু করে। তবে সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে মহম্মদ আলি জিন্নাহর ছোট বোন ফাতিমা জিন্নাহর উপর আইএসআই গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে। আইএসআই এবং সেনাবাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে এবং ফাতিমা জিন্নাহ নির্বাচনে পরাজিত হন। আইয়ুব খান পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন।
তবে ১৯৬৫ সালে আইএসআই শুধু নির্বাচন কারচুপিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই বছর আইএসআই ভারতের বিরুদ্ধে একটি গোপন পরিকল্পনা শুরু করে, যার নাম ছিল অপারেশন জিব্রাল্টার। ১৯৬২ সালে ভারত চিনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর আইএসআই সেনাবাহিনীকে জানায় যে ভারতের মনোবল দুর্বল এবং সেনাবাহিনীও ভালো অবস্থায় নেই। ফলে কাশ্মীরের উপর পুনরায় দখল নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। আইএসআই সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেয় যে এই সময়ে যদি সাধারণ কাশ্মীরি মুসলিমদের উস্কে দেওয়া যায়, তবে তারা ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত হতে পারে।
এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে কিছু সৈন্য ও এজেন্ট ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা শুরু করে। ভারত এই খবর জানতে পারলে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়। উভয় পক্ষে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং জেনারেল আইয়ুব খানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করায় এবং পরবর্তীতে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাস
আইএসআই-এর ব্যর্থতার তালিকা এখানেই শেষ নয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধও আইএসআই-এর ভুল তথ্যের কারণে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই বছর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সরকার এই জাতীয়তাবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলন শুরু হয় এবং 'মুক্তি বাহিনী' নামে একটি সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। শোনা যায়, আইএসআই পূর্ব পাকিস্তানে এই আন্দোলনের উত্থানের খবর দেরিতে পায় এবং খবর পাওয়ার পর আইএসআই যেভাবে কাজ শুরু করে, তা ছিল অকার্যকর এবং লজ্জাজনক। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে 'সার্চলাইট' নামে একটি অভিযান শুরু করে। আইএসআই এবং সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনের পরিবর্তে হিন্দু বাঙালিদের গণহত্যা শুরু করে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়, সেটিও ছিল আইএসআই-এর ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা একটি পদক্ষেপ। এই আক্রমণে ভারত ক্ষুব্ধ হয় এবং ফলস্বরূপ যুদ্ধ ও বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই যুদ্ধে চরম পরাজয়ের পর আইএসআই কিছুটা সতর্ক হয়। ১৯৭২ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন। তার পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) শাসনামলে আইএসআই বালুচিস্তান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে। বালুচ বিদ্রোহীদের হত্যা করা হয় এবং তাদের জেলে বন্দি করা হয়। পাকিস্তান কোনওভাবেই আরেকটি দেশের জন্ম মেনে নিতে রাজি ছিল না। এই দমন-পীড়ন কিছু সময় ধরে চলতে থাকে।
অর্থের নেশা ও ক্ষমতার মোহ
১৯৭৭ সাল ছিল আইএসআই-এর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। সংস্থাটি বিপুল ক্ষমতা লাভ করে। এই বছর আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউল হক পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের আসনে বসেন। ১৯৭৯ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আখতার আবদুর রহমান আইএসআই-এর প্রধান হন এবং এটিকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগান মুজাহিদদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। আফগান মুজাহিদরা একা ছিল না; তারা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছিল এবং এই অর্থ সরবরাহের মাধ্যম ছিল আইএসআই। সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে মিলে আইএসআই আফগান মুজাহিদদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে এবং পাকিস্তানে তাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে।
১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আইএসআই প্রধান হামিদ গুলের সময়কালে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আইএসআইয়ের সম্পর্ক প্রগাঢ় হতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক এবং কৌশলগত সহায়তা ব্যবহার করে আইএসআই তাদের দেশের এবং আফগানিস্তানের সুন্নি মুজাহিদদের সংগঠিত করা এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। এই মুজাহিদদের মধ্যে ছিলেন বেশ কয়েকজন বিদেশি যোদ্ধা, যারা পরবর্তীতে আল-কায়েদার মত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিলেন। এই সময়কালে পাকিস্তান জিহাদের একটি উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বিস্তার লাভ করতে শুরু করে।
দেশের অভ্যন্তরে, আইএসআই ১৯৮৫ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করে, বেনজির ভুট্টোর দলের উপর নজরদারি চালায় এবং ইসলামি জোটগুলোকে উৎসাহিত করে।
কাশ্মীরে জঙ্গি অনুপ্রবেশ
১৯৮৯ সালে যখন সোভিয়েত সেনারা আফগানিস্তান থেকে সরে যায়, তখন পাকিস্তানের হাতে সিআইএ-র দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী যোদ্ধাদের একটি বিশাল জঙ্গিবাহিনী ছিল। আফগানিস্তানে এদের আর প্রয়োজন ছিল না। ফলে আইএসআই এই অস্ত্র ও জঙ্গিদের কাশ্মীরে পাঠাতে শুরু করে। কাশ্মীরের রাজনীতি তখন অস্থির। রাজ্যের মানুষ মনে করছিল নির্বাচনে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। রাজীব গান্ধি ও ফারুক আবদুল্লাহর জোট ইসলামি ফ্রন্টকে অন্যায়ভাবে পরাজিত করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। হাজার হাজার কাশ্মীরি যুবক হাতে বন্দুক তুলে নিতে প্রস্তুত ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই সৈয়দ সালাউদ্দিন জেল থেকে বেরিয়ে আসে এবং জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের গঠনের পথ প্রশস্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে যদি প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করত, তবে আইএসআই-এর কাশ্মীর পরিকল্পনা সফল হতে পারত। আইএসআই ঠিক সেটাই করে।
শত শত জঙ্গিকে ভারতে অনুপ্রবেশ করানো শুরু হয়। এই অনুপ্রবেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিএসএফ-এর মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জন্য পাকিস্তান রেঞ্জার্স ও পাক সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সীমান্তে গুলি বিনিময় শুরু করে। সরাসরি নির্দেশ আসে আইএসআই অফিস থেকে। বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে, কিন্তু প্রাপ্ত প্রমাণগুলি ভিন্ন গল্প বলে।
তবে ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আইএসআই-এর নিজেদের দেশেও ভালো ভাবমূর্তি ছিল না। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানে একটি নতুন শক্তির উত্থান হয়। জুলফিকার আলি ভুট্টোর কন্যা বেনজির ভুট্টো রাজনীতিতে নিজের স্থান তৈরি করছিলেন। তাঁর বাবার দল পিপিপি তাঁর সঙ্গে ছিল। নিজের বক্তৃতায় তিনি এক নতুন ও প্রগতিশীল পাকিস্তানের ভিত্তি স্থাপনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন এবং বারবার পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলছিলেন। তাঁর এই পদক্ষেপ প্রশংসিত হয় এবং বেনজির ও তাঁর বাবার কারাবাসের গল্প জনগণের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। জনসমর্থনের একটি স্পষ্ট সুর শোনা যাচ্ছিল। আইএসআই প্রমাণ গোনে।
আরও পড়ুন-৭৭ বছরেও কেন স্থায়ী শান্তির পথে যেতে পারল না ভারত-পাকিস্তান?
আইএসআই: বোমা, সন্ত্রাস ও দ্বৈত নীতি
১৯৯৩ সালে নওয়াজ শরিফের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার সময়, আইএসআই ছিল একেবারে অন্য ভূমিকায়। মুম্বইয়ে লাগাতার বোমা হামলার ঘটনার পিছনেও আইএসআইয়ের হাত ছিল বলেই জানা যায় একাধিক রিপোর্টে। আইএসআই-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা দাউদ ইব্রাহিম ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে মুম্বইয়ে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, যাতে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। এই হামলার ঠিক আগে দাউদ ও তার পুরো পরিবার পাকিস্তানের করাচিতে পালিয়ে যায় এবং আজও সেখানেই বসবাস করছে।
এর পাশাপাশি কাশ্মীরে যখনই জঙ্গিবাদ বেড়েছে, তখনই আইএসআই-এর নাম উঠে এসেছে। পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করা আইএসআই-এর অন্যতম প্রধান কাজ ছিল।
এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলা হয় এবং এর পিছনে ছিল আল-কায়েদা। এই ঘটনার কিছু মাস পর আমেরিকা আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ও তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং পাকিস্তানের সাহায্য চায়। আইএসআই এগিয়ে আসে এবং আল-কায়েদার কিছু জঙ্গিকে গ্রেফতার করে। তবে প্রধান নেতা ওসামা বিন লাদেন নিখোঁজ ছিল। দশ বছর ধরে অনুসন্ধানের পর আমেরিকা স্তম্ভিত হয় যখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়া যায়, যা পাকিস্তান সামরিক আকাডেমির কাছেই অবস্থিত। শুধু তাই নয়, ৯/১১ হামলার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত খালিদ শেখ মহম্মদকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে এবং রমজি বিন-আল-শিবাকে করাচি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
২০০১ সালে যখন জৈশ-ই-মহম্মদের জঙ্গিরা ভারতের সংসদ ভবনে হামলা চালায়, তখন এই জঙ্গিদের গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের পেছনে আইএসআই-এর নাম উঠে আসে।
২০০৬ সালের বেনারস ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৬ সালের মুম্বই ট্রেন বোমা বিস্ফোরণ এবং ২০০৮ সালের মুম্বই সন্ত্রাসী হামলাতেও আইএসআই-এর নাম জড়ায়। এবং প্রতিবারের মতো পাকিস্তান ও আইএসআই এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
২০১০ সালের জুলাইয়ে আইএসআই-এর মুখোশ খুলে যায়। জানা যায়, এর কর্মকর্তারা তালিবানদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। এবং ২০১১ সালে উইকিলিকস কিছু নথি প্রকাশ করে, যেখানে লেখা ছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য আইএসআই একটি 'সন্ত্রাসী সংগঠন'। একই বছর মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফ অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন এই বলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন যে, আইএসআই মার্কিন সৈন্যদের হত্যাকারী এবং আফগান মুজাহিদ জালালউদ্দিন হাক্কানির গোষ্ঠীকে অর্থ সাহায্য করছে। ২০১০ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বলেন, যখনই সন্ত্রাসবাদের কথা আসে, আইএসআই দ্বৈত আচরণ করে।
এছাড়াও পাকিস্তানে চলমান বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান বা নির্বাচনে কারচুপি - সর্বত্র আইএসআই-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
মাদক, বোমা ও অস্ত্রের মালিক আইএসআই
খালিস্তান আন্দোলন এবং তার সঙ্গে জড়িত গ্যাংওয়ারকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের এই গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা ছিল। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে পঞ্জাব অঞ্চলে যখন খালিস্তান আন্দোলনের উত্থান ঘটে এবং ভারত সরকার এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়, তখন আইএসআই খালিস্তানি সংগঠনগুলোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। খবর অনুযায়ী, আইএসআই পাকিস্তান এবং ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সুবিধা নেয় এবং লাহোর ও শিয়ালকোটে খালিস্তানি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। খালিস্তান গোষ্ঠী বাব্বর খালসার জঙ্গি ওয়াধওয়া সিং এবং পরমজিৎ সিং পানজওয়ারকে পাকিস্তান তাদের দেশে আশ্রয় দেয়। কিন্তু কোনও বিশেষ লাভ ছাড়াই পাকিস্তান এত অস্ত্র ও অর্থ ব্যয় করবে কেন এই খলিস্তান আন্দোলনের জন্য? মূল কারণ হলো মাদকের চোরাচালান নেটওয়ার্ক। আফগান-পাক সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে আফিমের চাষ হয়, যা 'গোল্ডেন ক্রিসেন্ট' নামে পরিচিত। পাকিস্তান এই বিপুল পরিমাণ আফিম সারা বিশ্বে পাচার করে এবং এর বিনিময়ে মোটা অর্থ লাভ করে।
এই কারণেই পঞ্জাবে মাদকের ব্যবহার বেশি। সীমান্ত থেকে রাতের অন্ধকারে মাদকের প্যাকেট এপারে ফেলে দেওয়া হয় এবং হ্যান্ডলাররা সেগুলো বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। এই হ্যান্ডলাররাই ড্রোন থেকে ফেলা অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করে এবং তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এই পুরো ঘটনার পেছনে একটিই নাম - আইএসআই।
কাশ্মীর সমস্যায় আইএসআই-এর সক্রিয় ভূমিকা
কাশ্মীর উপত্যকায় দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএসআই-এর সক্রিয় ভূমিকা বহুবার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয়েছে। লস্কর-ই-তৈবা (LeT) ও জৈশ-ই-মহম্মদের (JeM) মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এমনকী পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে পাকিস্তানের মাটি থেকে পরিচালিত 'non-state actors'-রা মুম্বই হামলার মতো ঘটনায় জড়িত ছিল।
পহেলগাঁও হামলার তদন্তে আইএসআই-এর যোগসূত্র
সাম্প্রতিক পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার তদন্তে আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ যোগসূত্রের জোরালো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) ইলেকট্রনিক প্রমাণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জানতে পেরেছে, লস্কর-ই-তৈবার জঙ্গিরা, যারা পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল এবং আইএসআই কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে কাজ করছিল, তারা এই হামলার ষড়যন্ত্র করেছিল। ব্যবহৃত অত্যাধুনিক যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং হামলাকারীদের গতিবিধি আইএসআই-এর জড়িত থাকার সম্ভাবনা আরও জোরালো করে।
জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সরঞ্জাম ও আর্থিক মেরুদণ্ড
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র মারফত জানা যায়, আইএসআই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়, প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ এবং গোয়েন্দা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে। জঙ্গিরা প্রায়শই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবকাঠামো ব্যবহার করে এবং দেশের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে অবাধে প্রবেশাধিকার পায় বলেও অভিযোগ। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর আর্থিক উৎসগুলোর মধ্যে আইএসআই-এর সরাসরি অনুদান একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী: জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক?
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক আইএসআই-এর মতোই গভীর ও বিতর্কিত। ঐতিহাসিকভাবে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের কিছু অংশ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিকাশ ও সমর্থনে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ
প্রাক্তন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে কাশ্মীর অপারেশনের জন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এই সহায়তার মধ্যে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য এবং আর্থিক অনুদানও অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন
সম্প্রতি ভারতের অপারেশন সিঁদুরে নিহত জঙ্গিদের জন্য পাকিস্তানে একটি রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে পাকিস্তানের সেনাকর্মীদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন আমেরিকার কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি হাফিজ আব্দুল রউফও। এই উপস্থিতি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর সম্পর্কের একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
হামলায় সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার প্রমাণ
পহেলগাঁও হামলার মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তদন্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরের কিছু অংশের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক্তন পাকিস্তানি সেনা কর্মীরা, যারা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল, তারা এই হামলায় সরাসরি জড়িত ছিল। ব্যবহৃত সামরিক সরঞ্জাম এবং তাদের কৌশলগত জ্ঞান সেনাবাহিনীর যোগসাজশের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তোলে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী: জঙ্গিবাদের উত্তরাধিকার
পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্সের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর পারিবারিক ইতিহাস জঙ্গিবাদের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাঁর বাবা সুলতান বশিরউদ্দিন মাহমুদ, একজন পরমাণু বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সন্ত্রাসীদের কাছে পরমাণু অস্ত্র প্রযুক্তি হস্তান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন বশিরউদ্দিন মাহমুদ। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর নামও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর তাঁর পুত্রই পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র।
পাকিস্তান, তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, সেনাবাহিনী এবং বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্পর্ক একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়, যার ঐতিহাসিক, কৌশলগত এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আইএসআই এবং সেনাবাহিনী বহু বছর ধরেই পাকিস্তানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন পালন করে আসছে এবং সমস্ত ধরনের সুবিধা দিয়ে আসছে। এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘস্থায়ী হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত নীতি খতিয়ে দেখছে, তখন এই জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো ভেঙে ফেলা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য পাকিস্তানের উপর আরও কঠোর চাপ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই জটিল সম্পর্কের গতিশীলতা বোঝা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য।