মাতা হারি: লাস্যময়ী বিশ্বাসঘাতক যে গুপ্তচরের মস্তিষ্কও নিখোঁজ হয়ে যায়

Agent Mata Hari: কাটা মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে রাখা হলেও, পরে দেখা যায় সেটি নিখোঁজ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসে ২০০০ সালে, মিউজিয়ামের আর্কাইভ চেক করতে গিয়ে দেখা যায়, মাতা হারির মাথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ভোরের কুয়াশা তখনও গাঢ়। ফ্রান্সের কুখ্যাত সঁ লাজার জেল থেকে বেরিয়ে এলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবথেকে আলোচিত মহিলা ডবল এজেন্ট। তাঁকে বসিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল শহরের বাইরে। গন্তব্য ভিনসেন ফরেস্ট। বধ্যভূমি তৈরি। তাঁকে দাঁড় করানো হলো ফ্রান্সের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে। তিনি চোখ মেলেন সৈন্যদের দিকে, ঠোঁটে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, যেন মৃত্যুকেও অভিনয়ের শেষ দৃশ্য ভেবে নিয়েছেন। ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে চোখ ঢাকলেন না। তাদের উদ্দেশ্যে চুম্বন ছুঁড়ে দিয়ে ওই ৪১ বছরের নারী বললেন "আমি প্রস্তুত!" সোজা মাথার মাঝ বরাবর চলল গুলি। ধীরে ধীরে নতজানু হয়ে বসে পড়লেন তিনি, যেন চোখে কোনও অভিব্যক্তির পরিবর্তনই নেই। তারপর পিছন দিকে ঢলে পড়লেন।

এই নারীই ছিলেন মাতা হারি— প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমকালীন ইউরোপের সবথেকে আলোচিত নৃত্যশিল্পী, প্রণয়িনী এবং গুপ্তচর।

মাতা হারি ছিলেন মঞ্চের আলোয় ধরা পড়া এক নিষিদ্ধ মোহ, উচ্চশ্রেণির পুরুষদের কামনায় ঘূর্ণায়মান এক পুরাতনী বারবনিতা; পরবর্তীতে যিনি পরিণত হয়েছিলেন অন্ধকার ছায়াপথের এক গুপ্তচরে। তিনি যখন প্যারিসের মঞ্চে জাভানিজ রাজকুমারীর ছদ্মবেশে স্ট্রিপটিজ নাচ করতেন, উচ্চশ্রেণির পুরুষদের কাছে সঁপে দিতেন নিজের শিল্প ও শরীর, তখনও কেউ টের পায়নি এই নারী একদিন হয়ে উঠবেন ইউরোপিয় যুদ্ধরাজনীতির ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে পড়া এক দ্বৈত চর। প্রায় এক দশক ধরে নাচ, কামনা, অভিনয় আর আত্মপ্রতিষ্ঠার যে মঞ্চ তৈরি করেছিলেন তিনি, তা ধীরে ধীরে গড়ে তোলে আরও গভীর এক ছায়া— যেখানে নাচের জায়গায় আসে জার্মানির গুপ্ত সংকেত, প্রেমের জায়গায় আসে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ, আর মঞ্চের আলো বদলে যায় ফায়ারিং স্কোয়াডের বন্দুকের চোখে। এই রূপান্তর— এক কামনীয়া থেকে অভিযুক্ত গুপ্তচর হয়ে ওঠার নাট্যময় পথচলা মাতা হারিকে পরিণত করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় নারী চরিত্রগুলোর একটিতে।

মাতা হারির জন্ম ১৮৭৬ সালে নেদারল্যান্ডসের ফ্রিসল্যান্ড প্রদেশের লেউওয়ারডেন শহরে, মার্গারেথা গেরত্রুইডা জেলের নামে। তাঁর বাবা ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, ফলে শৈশবকাল কেটেছিল আর্থিক স্বচ্ছলতায়। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিনের ছিল না। হঠাৎ করেই একদিন তাঁর বাবার ব্যবসা দেউলিয়া হয়ে যায়, পরিবার ভেঙে যায় এবং কিছু বছরের মধ্যেই মার্গারেথার মা-ও মারা যান। পরবর্তীতে তাঁকে পাঠানো হয় লেইডেনে, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণে কিন্তু সেখানে তিনি জড়িয়ে পড়েন এক বিব্রতকর সম্পর্কে—স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। এই অনৈতিক সম্পর্ক আবিষ্কৃত হতেই তাঁকে বাধ্য করা হয় প্রশিক্ষণ ছেড়ে দিতে। তিনি ফিরে আসেন লেউওয়ারডেন শহরে।

আরও পড়ুন- লাস্য, যৌনতা আর ৫০ হাজার মৃত্যুর দায়! বিশ্বের ভয়াবহ এই গুপ্তচরের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও

১৮৯৫ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে একটি ডাচ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় একটি বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনে নিজের জন্য "মিষ্টি স্বভাবের বিয়ের উপযুক্তা নারী" খুঁজছিলেন ডাচ উপনিবেশিক সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন। এই বিজ্ঞাপন সামনে আসতেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন মার্গারেথা। তাঁকে সামনাসামনি দেখে রূপের জাদুতে মোহিত হয়ে যান ওই ক্যাপ্টেন। কিন্তু এই বিয়েই ছিল মার্গারেথার জীবনের সবথেকে খারাপ সিদ্ধান্ত। মার্গারেথার স্বামী ক্যাপ্টেন রুডলফ ম্যাকলিওড ছিলেন তাঁর থেকে প্রায় ২১ বছরের বড়। বিয়ের মাধ্যমে তিনি আবার ফিরে আসেন উচ্চবিত্ত ডাচ সমাজে কিন্তু বিবাহিত জীবন ছিল বিষাদময়। স্বামী ছিলেন মদ্যপ এবং অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা চলে যান জাভা, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ইন্দোনেশিয়ায়, যেখানে তাঁদের দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে— এক পুত্র ও এক কন্যা। তবে দু'জনেই বাবার থেকে পায় এক দুরারোগ্য ব্যাধি— সিফিলিস। সেই রোগের চিকিৎসা সময় মতো না হওয়ায় ১৮৯৯ সালে মৃত্যু হয় তাঁদের পুত্রসন্তানের।

বিবাহবিচ্ছেদের পর মার্গারেথা ফিরে আসেন ইউরোপে। কন্যা সন্তানকে স্বামীর জিম্মায় রেখে তিনি শুরু করেন জীবনের নতুন অধ্যায়, প্যারিসে। তিনি যখন ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন, সেখানে শিখেছিলেন সেখানকার ক্লাসিকাল নৃত্যশৈলী। এবারে ইউরোপে এসে সেই নৃত্যশৈলী কাজে লাগাতে শুরু করলেন মার্গারেথা। আত্মপ্রকাশ করলেন এক এক্সোটিক নৃত্যশিল্পী হিসেবে— নাম নেন ‘মাতা হারি’, যার অর্থ মালয় ভাষায় ‘ভোরের চোখ’। তাঁর নৃত্যে ছিল জাভানিজ প্রভাব, রহস্যময়তা এবং এক সুসজ্জিত, কামনাবাহী শরীরি ভাষা। ১৯০৫ সালে প্যারিসে প্রথম মঞ্চে আত্মপ্রকাশেই আলোড়ন ফেলে দেন। তাঁর নৃত্য কেবল পারফরম্যান্স নয়, এক শিল্প হয়ে ওঠে। মঞ্চে উঠে ধাপে ধাপে বস্ত্র উন্মোচন করে স্ট্রিপটিজ নৃত্যশৈলীকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান মাতা হারি। তিনি নিজেকে গড়ে তুললেন এক কল্পিত ‘প্রাচ্য’ রাজকুমারীর চরিত্রে, যার জন্ম ও প্রশিক্ষণ নাকি জাভার রাজপ্রাসাদে।

ফ্রান্সের নামজাদা পত্রিকাগুলিতে তাঁর নাম উঠে আসতে শুরু করল। তাঁর “বন্য প্রাণীর মতো লাবণ্যময় চলাফেরা” তাঁকে এক অনন্য পরিচয় দিল। একদিকে যেমন তাঁর নাচে থাকত ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রের ঢেউয়ের ছোঁয়া, অন্যদিকে কোথাও একটা লুকিয়ে থাকত এক দুঃখ ও অতৃপ্তির ছায়া। কোনও কোনও সাংবাদিক তাঁকে বলেছিলেন 'দুঃখময়ী দেবী'— যার শরীর কথা বলে, আর চোখে থাকে এক অনির্বচনীয় অভিমান। নর্তকী হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সমাজের উচ্চশ্রেণির পুরুষদের কাছেও কামনার পাত্রী হয়ে উঠলেন মাতা হারি। শরীর ও সাহচর্যের বিনিময়ে তিনি রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সম্পর্ক গড়ে তুললেন। রাজন্যবর্গ, শিল্পপতি, এমনকী মিলিটারি অফিসাররাও ছিলেন তাঁর প্রেমিকদের তালিকায়। বিখ্যাত ব্যারন হেনরি ডে রথচাইল্ড, সংগীতকার ম্যাসানে ও পুচিনি এবং চকোলেট সাম্রাজ্যের মালিক গাস্তোঁ মেনিয়ের— এরকম অনেকেই মাতা হারির শরীরের জাদুতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রতি।

আরও পড়ুন- উল-কাঁটার নকশায় গোপনে খবর পাচার! বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ধর্ষ গুপ্তচর হয়ে উঠেছিলেন বাড়ির মেয়েরাই

এই সম্পর্কের জালই তাঁকে এনে দেয় নতুন পরিচিতি— গুপ্তচর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়া যখন ইউরোপজুড়ে ঘনাচ্ছে, তখন তাঁর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও প্রভাব তাঁকে সন্দেহভাজন করে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নেদারল্যান্ড নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল। সে কারণে স্বাধীন ডাচ নাগরিক হিসেবে মাতা হারি ইউরোপের একাধিক জায়গায় শো করতে যেতেন কিন্তু জার্মানিতে এই শো সম্ভব হলো না। জার্মান সরকার তাঁকে আটকে দিয়ে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করে দেয়। সমস্যার সমাধান করতে তিনি যোগাযোগ করলেন জার্মান সরকারের অফিসারদের সঙ্গে। সেই সূত্রেই এক জার্মান কনসাল কার্ল ক্রোমার সঙ্গে পরিচয় হলো তাঁর। তিনি তাঁকে প্রস্তাব দিলেন জার্মানির জন্য গুপ্তচর হয়ে কাজ করার। বিনিময়ে তাঁকে দেওয়া হলো ২০,০০০ ফ্রাঁ। মাতা হারি টাকাপয়সা নিয়ে বিশেষ বাছবিচার করতেন না। তিনি কাজ করতে রাজি হয়ে গেলেন। ১৯১৬ সালে তিনি যুক্ত হলেন সেই জার্মান গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে, ‘এইচ২১’ ছদ্মনামে।

ফ্রান্সে ফিরে এসে যথারীতি নিজের পুরনো জীবনযাপনে ডুবে গেলেন মাতা হারি। অন্যদিকে, তাঁর জীবনে এই সময়েই এল এক নতুন প্রেম। রাশিয়ার পাইলট ভাদিম মাসলভের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেন মাতা হারি। বারবার ফ্রান্স থেকে তাঁর সঙ্গে রাশিয়ায় দেখা করতে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে রাশিয়ান সেনার নজরে আসতে শুরু করলেন মাতা হারি। সেখানেই ঘটে যায় এক অনভিপ্রেত ঘটনা। যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার হয়ে লড়াই করার সময় গুরুতর আহত হলেন মাসলভ। নিজের প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য সেই সময় মরিয়া হয়ে উঠলেন মাতা হারি। সরাসরি দেখা করলেন ফ্রান্সের সামরিক অফিসারদের সঙ্গে। সেখানেই ফ্রান্স সরকার তাঁকে এক প্রস্তাব দেয়। বলা হয়, তাঁর যৌনতার আবেদনকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে হবে। তাহলেই মিলবে রাশিয়ায় যাওয়ার ছাড়পত্র। নিরুপায় হয়ে এই কাজে রাজি হলেন মাতা হারি। বিনিময়ে চাইলেন ১০ লক্ষ ফ্রাঁ।

জার্মানির বিরুদ্ধে মিশনে যাওয়ার পথে স্পেনে আটক হলেন মাতা হারি। সেখানে নিজেকে জার্মান গুপ্তচর হিসেবে দাবি করে এক জার্মান কনসালকে যৌনতার টোপ দিয়ে উত্তর আফ্রিকায় জার্মানির রণকৌশল কিছুটা জেনে নিলেন মাতা হারি। বিনিময়ে তাঁকে ফ্রান্সের কিছু গোপন কথা জানিয়ে দিলেন। কিন্তু সময় সঙ্গ দেয়নি। মাতা হারি ভেবেছিলেন ফ্রান্সকে উত্তর আফ্রিকার খবর জানিয়ে দিয়ে তাঁদের থেকে টাকা নিয়ে প্রেমিককে নিয়ে অন্য দেশে পাড়ি দেবেন। সেখানে অন্য নাম নিয়ে বাকি জীবন কাটাবেন। কিন্তু হলো একেবারে উল্টো। ওই জার্মান কনসাল একটি রেডিও বার্তা পাঠালেন বার্লিনে যেখানে তিনি বলেন H-21 তাঁকে ফ্রান্সের কিছু গোপন খবর দিয়েছে। আর এই রেডিও বার্তা ফ্রান্স গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আসতে না আসতেই ফেঁসে গেলেন মাতা হারি।

১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে গ্রেফতার হন মাতা হারি। বিচারের পর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুখ্যাত সঁ লাজার জেলে। সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নানা জায়গায় চিঠি পাঠালেন মাতা হারি। কিন্তু, কোনও কাজ হলো না। তাঁকে যুদ্ধের বলি করা হলো। তাঁর উকিলকে সওয়াল করতে দেওয়া হলো না, চিঠি ঠিক জায়গায় পাঠানো হলো না, যত টাকা মাতা হারি পেয়েছেন সবটাকেই জার্মানির কাছ থেকে পাওয়া হিসাবে প্রমাণ করা হলো। দোষী সাব্যস্ত হলেন মাতা হারি। উচ্চমাত্রার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো এবং ১৯১৭ সালের ১৫ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।

তাঁর শরীর কেউ দাবি করেনি। ফলে মেডিকেল গবেষণার উদ্দেশ্যে তা হস্তান্তর করা হয় প্যারিসের অ্যানাটমি মিউজিয়ামে। সেখানেই ঘটে এক নীরব, অথচ অদ্ভুত ঘটনা— তাঁর কাটা মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে রাখা হলেও, পরে দেখা যায় সেটি নিখোঁজ। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসে ২০০০ সালে, যখন মিউজিয়ামের আর্কাইভ চেক করতে গিয়ে দেখা যায়, মাতা হারির মাথা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৫৪ সালে মিউজিয়াম স্থানান্তরের সময়েই সেটি হারিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। শুধু তাই নয়, ১৯১৮ সালের একটি রেকর্ডে বলা হয়েছিল তাঁর সম্পূর্ণ শরীরও মিউজিয়ামে রয়েছে কিন্তু সেটিও আর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন- অলড্রিচ এমস: আমেরিকার ইতিহাসে সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর আজও জেলে

মৃত্যুর প্রায় ১৪ বছর পরে, ১৯৩১ সালে, হলিউড প্রযোজনা সংস্থা এমজিএম তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি করে সিনেমা। গ্রেটা গার্বো মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই ছবি মাতা হারিকে করে তোলে এক বিশ্বপরিচিত আইকন। মাতা হারির জীবনের মূল্যায়ন আজও ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্কিত। অনেকের মতে, তিনি প্রকৃত অর্থে গুপ্তচর ছিলেন না বরং প্রেমে বিভ্রান্ত, স্বাধীনচেতা এক নারী, যিনি পুরুষশাসিত সমাজে নিজের জায়গা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন এবং সেই কারণেই তাঁকে বলি হতে হয়েছে। ফরাসি সেনাবাহিনী তাঁর বিচার সংক্রান্ত ১,২৭৫ পাতার নথিপত্র শতবর্ষ ধরে গোপন রেখেছিল। ২০১৭ সালে সেগুলি উন্মুক্ত হওয়ার পরেও, এই নারীর বিরুদ্ধে প্রকৃত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মাতা হারি জানতেন, রহস্যের শক্তি কতটা প্রবল। নিজের জীবনকে তিনি নির্মাণ করেছিলেন এক অন্তহীন অভিনয়ের মঞ্চ হিসেবে—যেখানে নৃত্যকলা, যৌনতা, ভান, এবং সম্পদস্পৃহা মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক অনন্য রূপ। তাঁর জীবন ছিল এক অভিনয়, এক বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আসলে সেই সময় যুদ্ধে কৌশলগত ভুলের কারণে জার্মানির কাছ থেকে প্রবল ধাক্কা খাওয়ার পর ফ্রান্স একটা অজুহাত খুঁজছিল। আর সেই অজুহাতটাই হয়ে উঠেছিলেন মাতা হারি। ফ্রান্সের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে বিশেষ কোনও প্রমাণ ছিল না, শুধুমাত্র ওই রেডিও বার্তা ছাড়া। তাই জোর করে হলেও মাতা হারিকে এই যুদ্ধের হারের প্রধান দায়ী হিসেবে উপস্থাপন করে ফ্রান্স।

সারা ফ্রান্স জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মাতা হারির কেচ্ছার কথা। যে মেয়ে নগ্ন হতে দু'বার ভাবে না, যাঁর পুরুষসঙ্গীর সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না, যে মেয়ে অর্থের লোভে সবার শয্যাসঙ্গী হয়ে ওঠে — সে তো গুপ্তচর হবেই! মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে তিনি যে যন্ত্রণা পেয়েছিলেন, সেটাই হয়তো মাতা হারিকে করে তুলেছে কিংবদন্তি। তাঁর পুরো জীবনটাই রহস্যে মোড়া। মৃত্যুর শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও, আজও তাঁর ব্যবহৃত জিনিস রেকর্ড দামে নিলামে ওঠে।

অনেকে বলেন, তাঁর বিচার ছিল প্রতীকী— এক নারীর উচ্ছ্বসিত স্বাধীনতাকে শাস্তি দেওয়ার উপায়। মৃত্যুর পরেও তিনি নিজের চিহ্ন মুছে রেখে গিয়েছেন কেবল এক দীর্ঘ, অমলিন ছায়া। আর সেই ছায়ার ভেতরেই আজও জেগে থাকে প্রশ্ন— কে ছিলেন মাতা হারি? এক গুপ্তচর? এক প্রতারিতা নারী? নাকি কেবল এক অভিনয়ের প্রতিমূর্তি, যিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুকেও রূপ দিতে তাঁর সর্বশেষ মঞ্চনাট্য হিসেবে!

More Articles