গ্লোবাল ওয়ার্মিং আসলে একটি বিশুদ্ধ মিথ্যা? চমকে দেবে বিজ্ঞানীদের এই ব্যাখ্যা
Global Warming: গ্লোবাল ওয়ার্মিং যদি সত্য ঘটনা হয়, তবে ২০১৯ সালে আমেরিকায় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি কি ভূতুড়ে গল্প ছিল? কিংবা সারা পৃথিবীতে এত বৃষ্টিপাত? এমনকী এদেশের কাশ্মীরেও বন্যা কেন?
যে বিশেষ জ্ঞান আমাদের কর্মপন্থা-সরলীকরণের পথ বাতলে দেয় তা আসলে বিজ্ঞান। তবে সরলীকরণ মানে যে কেবল সেই বিজ্ঞানের অবুঝ-যথেচ্ছাচার নয়, সেকথা না বুঝলে আবার মনুষ্য-যাপনের চর্যাই বৃথা হয়ে পড়ে! আজকের উদার-বাজারে বিশ্বায়নের-গ্রাম্যতায় বেঁচে থাকার সমূহ উপকরণ এতই সুলভ যে, আমাদের মানসিক দূরত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মনের মধ্যেও যে শারীরিক-আধান থাকে, তাকে বড় একটা নাগালে পাওয়া দুষ্কর! ফলত অজান্তেই আপনি হয়তো আমার কিংবা আমি হয়তো আপনার চিন্তাচর্চার বাগানে অনধিকার প্রবেশ করে ফেলছি এবং ঠিক সেক্ষেত্রেই জ্ঞান ও অজ্ঞানতার কাঁটাতার ভিজে যাচ্ছে সুতলি-দড়ির মতো! ঠিক যেমন করে বান্ধবসঙ্কুল কোনও হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর-বাদাবনে ঘুরে বেড়ায় চিকিৎসকদের জন্য কঠোরভাবে পালনীয় কোভিডের-নিদান-প্রণালী! শুধু তাই নয়, মুড়ি-বাতাসার মতোই বাজারে বিক্রি হয়ে যায় নির্দেশ-বিহীন একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক। অর্থাৎ চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সংসর্গহীন যে কেউ অনায়াসেই নিজেকে অতিমারির নিয়ামক ভেবে ফেলতে পারছেন। ইন্টারনেটের সহজতা, কিঞ্চিৎ অর্থনৈতিক সবলতা তথা বোধ ও বিবেচনার দুর্বলতাই আমাদের জ্যাক অফ অল ট্রেডের জামা পরিয়ে দিচ্ছে কিন্তু সে জামার ভিতরে থাকা অন্তর্বাসে অদৃশ্য কালিতে লেখা থাকছে মাস্টার অফ নান...
কেবল রোগ-নিদান নয়, এভাবেই পার্থিব যাবতীয় বিষয়ের ছদ্ম-জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাল-গতিবেগে। ধরা এবং সরা, পাতি এবং স্পেশালিস্ট গুলিয়ে ফেলছি আমরা। আসলে আমাদের বাচালতার-স্ফুরণ অথবা অতি-সক্রিয়তার সামাজিক বাতাবরণ জ্ঞানগত আমির ও ফকিরের ব্যবধান মুছে দিতে চাইছে। তাই একাধিক সমাজমাধ্যমের প্রতুলতায় ছাপা কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একাধিপত্য যেমন হ্রাস পাচ্ছে ঠিক তেমনই আমাদের আমিত্ব জাহির করার বহুবিধ প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্কুর জেগে উঠেছে। আর আমরা মেতে উঠেছি না জেনে, না বুঝে অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিংবা সাধারণ বিজ্ঞানের মতো হাজারও বিষয়ে কথামৃত রচনার। পরিবেশ সচেতনতার নামে আমাদের অবুঝ-যথেচ্ছাচার তেমন আরও একটি জরুরি উদাহরণ।
আরও পড়ুন- দরিদ্র দেশের উপর দূষণের অভিশাপ চাপিয়ে দিচ্ছে ধনী দেশ
পলিথিন নিয়ে পাতলা চিন্তার অবসান হোক
আমাদের অবস্থা অনেকটা সেই বীরু সহশ্রবুদ্ধের মতো। র্যাঞ্চোকে যিনি অ্যাস্ট্রোনট পেনের লোভ দেখিয়েছিলেন। সাধারণ ভৌতবিজ্ঞান বুঝিয়ে যিনি বলেছিলেন, মহাকাশে ঝর্নাকলম কাজ করে না, তাই অ্যাস্ট্রোনট পেনের আবিষ্কার হয়। সেই মহামূল্যবান পেন তিনি উপহার দিতে চান তাঁর সফলতম ছাত্রকে। র্যাঞ্চো আবার কিঞ্চিৎ ত্যাঁদড় ও আপাত-বখাটে, পাশ-ফেল মোক্ষ নয় তাঁর। সে বিজ্ঞানের পূজারি, জ্ঞানলাভ তাঁকে পাগল করে! তবে মাদার্স-বেবি টাইপ নয় কোনও অর্থেই। উইট তাঁর বোধের ধার হয়ে ওঠে। আজকের হাতেগোনা তেমন ছাত্রের মতো স্যরকে প্রশ্ন করেন, মহাকাশে অ্যাস্ট্রোনট পেনের বদলে পেন্সিল ব্যবহার করলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত! স্যরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। স্যর তাঁর ছাত্রটির সদুত্তর উপলব্ধি করলেও মুখে কিছু বলতে পারেন না। দশচক্রী সমাজের আওতায় তিনি হতবাক থাকেন! ঠিক যেমন বিজ্ঞান বইও অনেক ক্ষেত্রে চিন্তার দানায় জল কিংবা ওম দিতে অপারগ থেকে যায়!
পৃথিবী জুড়ে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে দিস্তা দিস্তা রিপোর্ট, অষ্টপ্রহর সেমিনার এবং সরকারি-অসরকারি স্তরের বহুবিধ প্রচার-প্রহসন দেখে ও পড়ে আমাদের কারও কারও কি র্যাঞ্চোর মতো কোনও ছাত্রের কথা মনে আসে না যে জনসমক্ষে চিৎকার করে বলতে পারবে, প্লাস্টিক ব্যবহার ও দূষণ প্রতিরোধ না করে প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করলেই তো সব সমস্যা মিটে যায়! কিন্তু না। র্যাঞ্চোর মতো ছাত্ররা পাশ-ফেল বিষয়ক তত্ত্বে ও মননেই সুবাস ছড়ায় কেবল, তাঁরা থাকে সাহিত্যে-সিনেমায়। বাস্তবে তাঁদের অস্তিত্ব পাওয়া দুষ্কর!
ধরা যাক, বসন্তের কোনও এক মনোরম সকালে পলিথিনের টিউব থেকে দন্ত-উজালাকারী পেস্ট নিয়ে প্লাস্টিকের একটি ব্রাশে লেপটে দিলেন। এরপর দিনগতির পায়ে পায়ে মিনিটে মিনিটে কত প্রকার প্লাস্টিক-দ্রব্য ব্যবহার করেছেন তার ফর্দ তৈরি করতে থাকলেন। চলল খাওয়া-দাওয়া থেকে ঘুম, এমনকী জীবিকার দায় ও দায়িত্ব। সব পাখি যেমন ঘরে ফেরে, ফিরলেন আপনিও। রাতের খাবার সেরে প্লাস্টিকের ঢাউস বাক্স থেকে পলিথিনের ব্লিস্টার ভেঙে সেবন করলেন নির্বাচিত ঔষধের দানা। রাত ঘন হলে দরকার পড়ল ধরাধামে বিপ্লব এনে দেওয়া পরিবার পরিকল্পনার এক টুকরো রাবার! হায়, সেটাও সিন্থেটিক পলিমার! এবার বলুন, হাজার আইন, হাজার মিছিল জারি থাকলেও আপনি পরিহার করতে পারবেন তো ফর্দে লিখে রাখা লক্ষ লক্ষ প্লাস্টিকের টুকরো? অপরিহার্য তারা, বড়জোর সজাগ হতে পারেন কিন্তু হাত-পা বাঁধা আমাদের। চাহিদা ও অর্থনীতির গড়াপেটাই আমাদের প্লাস্টিকমুখী করেছে। জনসাধারণ বস্তুটিকে আদরণীয় ভাবেন, এমনটা নয়। বরং বলা যায় পরিহার করার উপায় নেই আমাদের। বস্তুত যে যে উপায়ের কথা বলা হয় তা অনেকাংশেই ফাঁকা আওয়াজ এবং তাৎক্ষণিক। যার কোনও সুদূরপ্রসারী ধারাবাহিকতাই নেই। যান্ত্রিকতা এবং আধুনিকতাই কাপড়ের বদলে পলিথিন এনেছে, এনেছে কাচের বদলে প্লাস্টিক। প্রায় সব ক্ষেত্রেই সে হয়ে উঠেছে একমাত্র বিকল্প। উপায় দু’টি। হয় প্লাস্টিকের বিকল্প ভাবা হোক, যার বাস্তবিক কোনও সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত অন্তত নেই। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, প্লাস্টিক বা পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করা। তা না হলে সস্তা আবেগ দেখিয়ে বুজে যাওয়া নর্দমার ছবি তুললে কিংবা গুগল ঘেঁটে গত বছর কত টন সামুদ্রিক মাছের পেটে কত টন প্লাস্টিক জমেছে তা নিয়ে প্রবন্ধ লিখলে সোশ্যাল বা বিশাল মিডিয়ায় কিছু লাইক জুটবে কেবল! সুরাহার ঝুলি থেকে যাবে পাতলাই...
উপায় কি সত্যিই নেই? আসলে প্লাস্টিকের পরিবর্তে বিকল্প যা যা বেরোচ্ছে, তা প্রথমত চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য এবং দ্বিতীয়ত ব্যবহার-বান্ধব নয় বলে তা চলে যাচ্ছে আমাদের অপছন্দের তালিকায়। প্লাস্টিক যেহেতু বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়, অর্থাৎ পরিবেশে স্বাভাবিকভাবে নষ্ট হতে পারে না, তাই পৃথিবীর পক্ষে এই বস্তুর ভার আসলে এক ধরনের দায়। আক্ষরিক অর্থেই এদের ভর নয় ভার আমাদের কাছে বিড়ম্বনার কারণ। মানুষ যেমন সেলফোন ছেড়ে টেলিগ্রামের যুগে ফিরে যেতে পারে না, আমরা যেমন আধুনিক যানবাহন এড়িয়ে পশু-বাহিত শকটে আর ফিরে যেতে চাইব না, তেমনই প্লাস্টিকের সহজতাকেও পৃথিবী জুড়ে আজ আর ত্যাজ্যবস্তু বলে দেগে দেওয়া সম্ভব নয়। সে কেবল লেগে থাকবে ভারী চিন্তাচর্চার গায়ে পাতলা আঁশের মতো। খানিক ঘষেমেজে দিলে মাছের চারটে আঁশ যেমন তাৎক্ষণিক খসে পড়ে, পলিথিনচর্চাও সেরকম। প্লাস্টিকের চাদর আসলে অনেকটা মাছের আঁশের মতোই, চেঁছে কিংবা টেনে-হিঁচড়ে যার পুরোপুরি উৎপাটন অসম্ভব!
আরও পড়ুন- মহাকাশ দখলের লড়াইয়ে বিপদ পৃথিবীরই? পরিবেশের যে ক্ষতি ডেকে আনছে রাশি রাশি উৎক্ষেপণ
আমাদের জল-চাতুরি ও জল-ভূত
ছল চাতুরির মধ্যে জল মিশে গেলেও পরিমাণে হ্রস্ব হয়ে যায় না সে! তাই, আমাদের সাধের পৃথিবীর মোট ক্ষেত্রফলের মাত্র ২৯ শতাংশ কেবল স্থলভাগ। এই অঞ্চলগুলিকেই শৈশবের ভূগোল বই আমাদের মহাদেশ হিসেবে ডাকতে শিখিয়েছে। সেই ভুবনডাঙার ৩৩ শতাংশই মরুভূমি আর ৩১ শতাংশ বনাঞ্চল। অর্থাৎ বাদবাকি হাতে থাকল ২৯ ভাগের ৩৬ শতাংশ, মানে গোটা পৃথিবীর মাত্র ১০.৪৪ শতাংশ, যা কেবল হোমো সেপিয়েন্সের বিচরণ ভূমি। তবে যদি প্রকৃতবিচার করা যায় দেখা যাবে ওই ১০.৪৪ শতাংশ স্থলভাগের অনেকটাই রাস্তাঘাট-কলকারখানা-অফিস-আদালত অধিকৃত। তাই প্রকৃতই মনুষ্য-বাস্তুজমি হিসেবে হয়তো হাতে থাকবে মোট পৃথিবীর মাত্র ৫-৭ শতাংশ।
এ তো গেল স্থলভাগের সহজ হিসেব। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে যে, ভূ-ভাগের উপরিতলের মোট ক্ষেত্রফলের ৭১ ভাগই জল। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ জলরাশি আছে পৃথিবীর পেটের ভিতর। তবে সেই জলরাশির স্তর-বিন্যাস স্থানিক ভূ-প্রকৃতি অনুসারে সর্বত্র সমান নয়, কোথাও কম কোথাও বেশি।
এবার বলুন, পৃথিবীর জল নাকি কমে আসছে, এ কথা মানা যায়! এ এক আজব গিমিক। আর সেই বক্তব্য না বুঝে, না ভেবে আবেগের মাথা খেয়ে শুধুই অপপ্রচার ফরওয়ার্ডেড হয়ে চলেছে হাজারে হাজারে। কখনও খবর, কখনও ভিডিও, কখনও ছবিরূপে সে দখল করছে আম-আদমির হোয়াইট ম্যাটার। আমরা যেন মাছিমারা কেরানির অভিনয় করছি। যেন খবরটি প্রত্যেকের কানে কানে না জানালে নিজের পরিবেশ-প্রেম অপ্রকাশিতই থেকে যাবে! যেন জনদরদের পায়ে পা মেলাতে পারব না আমরা! কিন্তু কোনও তথ্য প্রচার করার আগে তার বিচার ও বিশ্লেষণ জরুরি। হয়তো সে সময় নেই আমাদের! আসলে আবেগি ও ক্ষণিকজীবী মানুষের গ্রে-ম্যাটারে স্পর্শই করেনি বিষয়টি। হোয়াইট ম্যাটার থেকেই সে হয়ে উঠছে ভাইরাল... যেন দশচক্রে ভূত হয়ে উঠছেন জলের ভগবান!
পরিষ্কার এবং সোজাসুজি সাতদফা প্রশ্ন এক্ষেত্রে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এক) ২০৩০-৪০ নাগাদ কি প্রয়োজনীয় জল পাবেন না সাধারণ মানুষ? দুই) যদি তাই হয়, জলের অপচয় বন্ধ করাই কি একমাত্র মার্গ? তিন) জলের অপচয়ই কি জলাভাবের একমাত্র কারণ? চার) যদি তা না হয়, তবে আসল কারণ কী? পাঁচ) জলাভাব-পরিস্থিতি কি কেবল পানীয় জলের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত, না কি এটি সামগ্রিক জলাভাব? ছয়) যদি পানীয় জলের সমস্যা হয়, তবে সমুদ্রের জলকেই পানযোগ্য করা যাবে না কেন? সাত) সমস্যা মোকাবিলা কে করবে, জনগণ নাকি সরকার?
আমাদের নীতি-আয়োগ জানিয়েছিল, ২০২২-এর মধ্যে ভারতের ২১টি রাজ্যে জলাভাব দেখা দেবে এবং বর্তমানে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানায় জলের স্তর নাকি ‘ক্রিটিক্যাল’। নীতি-আয়োগ বলছে এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু কী সেই ব্যবস্থা তা স্পষ্ট নয়। ফলে বিশাল-মিডিয়ার বিজ্ঞানী তথা সৈনিকরা তাঁদের নিজেদের মতো তত্ত্ব ও তথ্যে আকাশ-বাতাস ছেয়ে ফেলেছেন। তাঁরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কে কত বড় প্রকৃতিপ্রেমিক তা প্রমাণ করতে! বিস্ময়করভাবে তাঁরা ধরেই নিয়েছেন যে জলের অপচয় থেকেই এই পরিস্থিতি। যেহেতু বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তাই সেই বিশ্বাসের ডানায় উপুড় হয়ে শুয়ে-বসে তাঁরা রচনা করতে শুরু করেছেন জল অপচয়-বিরোধী তথা সাশ্রয়কারী বিবিধ নিদান-তত্ত্ব।
কিন্তু কিছুতেই আমরা মাথায় আনছি না যে, ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং তারতম্যের কারণেই পৃথিবীপৃষ্ঠের গভীরে অঞ্চল-ভেদে আলাদা আলাদা জলস্তর থাকে। পৃথিবীর মোট জলভাণ্ডার যেহেতু ধ্রুবক তাই আক্ষরিক অর্থে জলসম্পদ বিনষ্ট করার কোনও ক্ষমতাই মনুষ্যকুলের নেই! আপাতভাবে যে জলরাশির অপচয় হচ্ছে বলে মনে করি আমরা তা কিন্তু কোনও না কোনও ভাবে পৃথিবীর চরণে ফিরে আসবেই। তা না হলে মেনে নিতে হবে ‘জলচক্র’ একটি মিথ্যে ধারণা। তেমন ধারণা মানতেও আমরা রাজি নই!
তবে এটা বহুলাংশে সত্যি যে সুপেয় জলরাশির আয়তন কমছে, কিছুটা হলেও দূষক বস্তুর কারণেই জলের এই মানগত বিচ্যুতি। প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার মোকাবিলা করা খুব ছোট কাজ নয়, একক বা জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। এই সমস্যা মোকাবিলার দায়িত্ব ও কৃতিত্ব সবটাই সরকারের হওয়া উচিত। উপায় একটাই, অপরিশোধিত জলরাশিকে পানযোগ্য করে তোলা। প্রয়োজন গবেষণা। সম্প্রতি পড়ছিলাম, মানুষকে পরিবেশ সচেতন বা বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে ২০১৯ সালের ৪মে বেশিরভাগ দেশের বড় বড় শহরে বিজ্ঞানীরা পথে নেমেছেন। আমার মনে হয়, বিবিধ প্রচারে সুশীলজনদের অনুকরণে বিজ্ঞানীদের ‘মার্চ ফর সায়েন্সের’ পরিবর্তে কালবিলম্ব না করে আজকেই বসে পড়া উচিত কীভাবে সমুদ্রের জলকেও সুপেয় করে তোলা যায়, সেই গবেষণায়। তারই সুফল কুড়িয়ে নিক আমাদের মতো রাষ্ট্র।
তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এও প্রচার করা হচ্ছে যে, এই পদ্ধতি নাকি বহুল ব্যয়সাপেক্ষ। বাড়ির পানীয় জলের আরও মেশিন ক্ষুদ্র সংস্করণ যা পারে, রাষ্ট্র পরিচালিত কাঠামোয় তা তো অসম্ভব নয়। বাগবিতণ্ডায় না গিয়ে শুধু দরকার সাগরের জল খরা-প্রবণ অঞ্চল পর্যন্ত নলপথে পাঠানো। দরকার জনদরদ। দরকার পপুলিস্ট প্রজেক্টে বাজেট না বড়িয়ে এমন গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধি। আর দরকার শান্তমতি প্রজা, যারা অন্তত হুজুগ বা আবেগের পরিবর্তে বোধ ও বিবেচনার পায়ে পাথর ঘষবেন।
শেষে মনে রাখতে হবে, পৃথিবী নিজেই একটা বাফার সিস্টেম। এই খরা-প্রবণতা চিরকালীন নয়। পৃথিবী নিজেই তার শুশ্রূষা করে। তাই খরার যেমন ইতিহাস আছে, ইতিহাস আছে ঝড়, বন্যা ও তুষারপাতেরও। আছে ভূমিকম্পেরও দীর্ঘ ইতিহাস! ২০২৪ সালে ভারতেই প্রবল দাবদাহ হয়েছে, আবার স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাহারার বুকে গজিয়ে উঠছে সবুজ বাগান!
শেষ পাতে ভেতো বাঙালি যেমন 'হট' গোলাপ জামুন পেতে চান, তেমনই একটি শেষ প্রশ্ন – হিমবাহ গলে যাচ্ছে, মেরুবরফ গলে যাচ্ছে, সম্ভবনা নাকি মহাপ্লাবনের! পৃথিবী সৃষ্টির সময় তো বরফ ছিল না। পৃথিবী তার উষ্ণ-পর্ব ও শীতল-পর্বের যাত্রাপথেই বরফ অর্জন করেছে প্রাকৃতিক জল থেকেই। কোটি কোটি বছরের যাত্রাপথে আবার হয়তো আসছে সেই উষ্ণ-পর্ব! এমন তথ্য তো অজানা নয়। আর জলের মোট পরিমাণের সৃষ্টি বা বিনাশ তো ঘটেনি। তা হলে বরফ গলে গেলেও মোট জলের পরিমাণ বাড়বে কি? তা যদি না হয়, তবে মহাদেশগুলো জলের তলায় চলে যাবে এই ভূতুড়ে কল্পনা কেন?
আরও পড়ুন- ভারতে এক বছরে ১৬ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে! যেসব ভয়াবহ সত্য প্রকাশ রিপোর্টে
উষ্ণায়নের কিছু শীতল কথা-বার্তা
ভুবনের কি সত্যিই জ্বর? না কি, উষ্ণায়ন আদতে এক কষ্টকল্পিত উপাখ্যান? আজকের মেজবয়সিরা তখন সদ্য চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আর একটু ছোটরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের। এই বাংলায় সেই নব্য-নয়ের দশক থেকেই পপুলার প্রশ্ন হয়ে উঠেছিল গ্লোবাল ওয়ার্মিং। শুধু বাংলা বা ইংরিজি রচনায় নয়, বিভিন্ন আঙ্গিকে সে হয়ে উঠেছিল অপরিহার্য এমসিকিউ। আমরা হয়তো তাকে চিনেছিলাম আট-দশকের শেষ ধাপে। চিনেছিলাম বলা ভুল, বিশ্ববাজার আমাদের হাড়ে হাড়ে জানিয়েছিল, যত বেশি কারখানা হবে, যত বেশি গাড়িঘোড়া চড়ব আমরা, তত বেশি কার্বন যৌগে ছেয়ে যাবে সুনির্মল পবন। ফলশ্রুতি, পৃথিবী তেতে উঠবে। এ ভুবনের তাপ নিয়ন্ত্রণে তাই যান্ত্রিকতায় লাগাম দিতে হবে, কিন্তু দাঙ্গা-রাহাজানি-রাজনৈতিক সন্ত্রাস যে গ্রিনহাউস গ্যাসের থেকেও পৃথিবীকে বেশি তপ্ত করে তোলে সে কথা পাঠ্যক্রমের বাইরেই থেকে গেল চিরকাল। আসলে সমূহ সত্যিই যে সর্বদা সমূহ মিথ্যের থেকে শক্তিশালী নয়, সে কথা জোর গলায় বলা চলে কি?
ফলা ও ফল
শক্তির এক ধরনের ধার থাকে। তার ফলা অনন্ত গতি নিয়ে দুর্বলকে পিষে দেয়। তাই বেনিয়া-ধনধর রাষ্ট্ররা উষ্ণায়নের ফাতনা নেড়ে গরিব দেশগুলিকে কার্বন এমিশনের দুর্নাম দিয়েছে কেবল। আর নিজেরা থেকেছে যন্ত্র উৎপাদন এবং ব্যবহারের অর্গাজমে। আমরা পিছড়েবর্গের দেশ, নতমস্তকে মেনে চলেছি চাপিয়ে দেওয়া সেই কল্পবিজ্ঞান! তারা বলেছে, উষ্ণায়নের জন্যই তো এত সঙ্কট পৃথিবীর অস্তিত্বে। এই একটি কারণেই নাকি বেড়ে যাচ্ছে তাপ। পৃথিবীর জ্বর হয়েছে আজ। গলে যাচ্ছে মেরুবরফ। অগ্ন্যুৎপাত থেকে ভূমিকম্প, ঝড় থেকে বন্যা সবই নাকি উষ্ণায়নের ফল। আমরা তৃতীয়-বিশ্ব, অবলীলায় গিলে ফেলেছি সে গল্প। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে যখন ঘনঘন ভূমিকম্প দেখেছি আমরা, মৃত্যুভয় বিশ্বস্ত করে তুলেছে আমাদের মতো দলিতদের। যেন এক কল্পিত মন্ত্রবল কব্জা করেছে আমাদের। প্রশ্ন করার শক্তি হারিয়েছি অনায়াসে। আমরা কোনওদিন প্রশ্ন করিনি, যানবাহন এবং কলকারখানাই যদি উষ্ণায়নের জন্য দায়ী হয় তবে কলকাতার তুলনায় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় গরম বেশি কেন? সেখানে না আছে কল না আছে কারখানা! আসলে ভূ-প্রকৃতিই যে নিয়ন্ত্রা সে কথা যুক্তির ধামায় চাপা পড়ে যায়।
প্রশ্ন ও যুক্তি
মেনে নিলাম গ্লোবাল ওয়ার্মিং সত্য ঘটনা। তবে ২০১৯ সালে আমেরিকায় মাইনাস ৬০ ডিগ্রি কি ভূতুড়ে গল্প ছিল? কিংবা সারা পৃথিবীতে এত বৃষ্টিপাত? এমনকী এদেশের কাশ্মীরেও বন্যা কেন? আর ভূমিকম্প! আমরা কি সাদা বুদ্ধিতে প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের দৈনন্দিন ব্যাবহারের পেট্রোলিয়ম প্রোডাক্ট কোথা থেকে এল? ভূগোল বা সাধারণ বিজ্ঞানের সামান্য ছাত্ররাও জানেন পৃথিবী সৃষ্টির আদি যুগ থেকেই ভূমিকম্প বা ভূ-স্তরের ওলটপালট একটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা। তারই ফলস্বরূপ বিস্তৃত বনাঞ্চল চাপা পড়ে তৈরি করেছে খনিজ তেল। সুতরাং ভূ-কম্পন নতুন ঘটনা নয়। এবার চিন্তকরা বলুন, সর্বঘটে উষ্ণায়ন মানা যায়?
গবেষণার ইতিহাস
তখনও বিশ্ব উষ্ণায়ন কথাটির প্রচলন হয়নি। ১৮৯৬ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস দেখেছিলেন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে তাপমাত্রা বাড়ে। তিনি বলেন জলীয় বাস্প এবং কার্বন যৌগ সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করে ‘প্রাকৃতিক গ্রিন হাউস প্রভাবে’ পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপ ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ধরে রাখে। সময়ের পলি এসে বিষয়টিকে চাপা দিয়ে রাখে। ১৯৪০-৫৫ নাগাদ বিজ্ঞানীরা বলেন, উৎপাদিত কার্বন ডাই অক্সাইডের বায়ুমণ্ডলীয় আয়ু মাত্র ১০ বছর। ছয়ের দশকে চার্লস কিপলিং-এর বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব লেখচিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার ছিল। লেখচিত্রে দেখা যায় ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পৃথিবীর বাৎসরিক গড় তাপমান কমেছে। আবার তুষার যুগ আসছে নাকি? ভয় পান তাঁরা। একাংশের বিজ্ঞানী ও গণমাধ্যমের বিরোধিতায় আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৭৬ সালে স্তিফেন স্নাইডার প্রথম গ্লোবাল ওয়ার্মিং শব্দের আমদানি করেন। আশ্চর্যজনকভাবে কিপলিং-এর লেখচিত্রও ১৯৮০ সালের পর থেকেই পৃথিবীর বাৎসরিক গড় তাপমাত্রার ঊর্ধ্বমুখ দেখাতে শুরু করে! এরপরেই জোর কদমে সামনে আসে আইপিসিসি, ইউএনইপি কিংবা ডবলুএমও-এর মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। নিন্দুকরা বলেন এ সবই নাকি সংখ্যাতত্ত্ব আর কপট বিজ্ঞানের কারসাজি। সবই নাকি গবেষণার নামে অনুদান প্রাপ্তির কৌশল। তবে বিজ্ঞানীরাই আবার বলছেন, পৃথিবীতে উষ্ণতম বছর ছিল ১৯৯৮ সাল, আর ধারে কাছে ছিল ২০০২, ২০০৩ ও ২০০১ সাল। সবই যেন কেমন গোলমেলে। তবুও শুধু ইউএসএ-তেই ২০০৯ পর্যন্ত এর পিছনে খরচ করা হয় সাড়ে সাত হাজার মিলিয়ন ডলার, যা ১৯৯০ সালে ছিল মাত্র একশো মিলিয়ন। এবার একবার গুগুলদা-কে জিজ্ঞেস করুন, সারা পৃথিবীর মানব সন্তানকে পেট পুরে দু’বেলা খাওয়াতে কত খরচ পড়ে? উষ্ণায়ন-গবেষণায় বিশ্বব্যাপী খরচপত্রের তুলনায় তা কম না বেশি? চিন্তা এবং গল্পের আরও এক বৈপরীত্য আপনাকে হাসাতেও পারে। এই বিজ্ঞান বলে, উষ্ণায়নের কারণে মরুবরফ গলে যাচ্ছে বলেই সমুদ্র স্তর উঁচু হচ্ছে। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে বন্যায় ভেসে যাবে পৃথিবী। তাই যদি হয়, তাঁরাই আবার পৃথিবীর জল-সংকট বিষয়ে বালতি বালতি শব্দ খরচ করেন! সংকট নাকি সুপেয় জলের! বাড়ি বাড়ি পিউরিফায়ার, পাড়ায় পাড়ায় কারখানা জলশুদ্ধি করতে পারে অথচ রাষ্ট্রীয় মেধা ও অর্থ সমুদ্রের নোনা জলকে পানযোগ্য করে তুলতে অপারগ! আজকাল ইন্টারনেটের তথ্য এক কাপ চায়ের থেকেও সুলভ। তাই গ্লোবাল ওয়ার্মিং যে ঠিক কথা নয়, তা নিয়ে অন্তত হাজার দুয়েক সৎ বিজ্ঞানী নিভৃতে কী কী কাজ করছেন এবং কতটা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় তাঁদের, তা একবার দেখে নেওয়া জরুরি নয় কি?
আত্মরতি
ভীমরতিধর মনুষ্যজাতির খুঁচিয়ে ঘা করার অভ্যেস চিরন্তন। তিল কে তাল কিংবা মশাকে হাতি বানানোয় জুড়ি নেই তার। এও এক আত্মকৌশল অথবা আত্মরতি। গবেষণাও জীবিকা। জীবিকার স্বার্থে প্রচার-পবন তাই নতুন কোনও কৌশল নয়। আমরা কপি-পেস্ট-প্রবণ আমজনতা কোনও কিছুই গভীরে ভাবার পরিবর্তে সোশ্যাল বা আন-সোশাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়াই।
প্রকৃতিই চালক
চালক বললে খানিক কম বলা হয়, বলা উচিত প্রকৃতিই নিয়ন্ত্রক। পৃথিবীর সৃষ্টিও তো প্রাকৃতিক ভাবেই। সেখানে কোনও রাজনীতির হাত ছিল না। সেই পৃথিবীর কোণায় কোণায় পড়ে থাকা উপাদান ছাড়া কিছুই নতুন করে আমদানি করা অ্যানথ্রোপজেনিক কারুকাজ বলে প্রমাণিত নয়। উষ্ণায়ন নিয়ে হাওয়া গরম আর না করে, এবার সেগুলো নিয়ে তলিয়ে ভাবা যাক। ততদিনে, যেন আমাদের এই ধরাধাম সুস্থতার মুখ দেখতে পারে।